লেখক হিসেবে কেমন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান

শেখ মুজিবুর রহমান লেখক হিসেবে হাজির হয়েছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন—আত্মস্মৃতিমূলক তিনটি বইয়ের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর লেখার বৈশিষ্টগুলো কী কী? তাঁর লেখকসত্তার তত্ত্বতালাশ।

শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫ )
ছবি: নাসির আলী মামুন,১৯৭২, ফটোজিয়াম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখক ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ; জাতীয়তাবাদী নেতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তিনি বরাবর এত বেশি রাজনীতিলিপ্ত ছিলেন যে আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত পত্রিকা রাখা একটা পরবিারে বেড়ে উঠেও পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে ‘আউটবুক’ পড়াশোনায় খুব একটা মনোনিবেশ করার অবসর পাননি। তিনি একই দেহে ছিলেন নেতা ও কর্মী। কখনোই তিনি পড়াশোনা করে পণ্ডিত, তাত্ত্বিক হতে চাননি। চেয়েছিলেন রাজনীতির ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষের মুক্তি।

পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তিনি মনে করতেন, ‘পাকিস্তান না আনতে পারলে পড়ালেখা শিখে কী করব?’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ৩২) কলকাতায় আবুল হাশিমের রাজনৈতিক দর্শনের ক্লাস সম্পর্কে তিনি বন্ধুদের বলতেন, ‘তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপরে বসে বসে আলোচনা করা যাবে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ৪১) সর্বক্ষণ জনগণনিষ্ঠ একজন নেতা ও কর্মীর বক্তব্য যা হওয়ার, এ হয়তো তাই-ই। নিজে পড়াশোনা করার খুব একটা অবসর না পেলেও তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন নামে তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। নিজে পড়াশোনার খুব একটা অবসর না পাওয়ায় তাঁর রচিত বইগুলোতে তাঁর লেখকসত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কৌতূহল হতেই পারে, নিজের লেখা বইগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান লেখক হিসেবে কেমন!

বলে রাখা দরকার, বই তিনটি শেখ মুজিবের জেলজীবনের অবসরে লেখা। এগুলো মূলত তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা। আত্মজৈবনিক গ্রন্থে আমরা সাধারণত লেখকসত্তার খোঁজ কম করি। সেখানে সময় ও ব্যক্তির বেড়ে ওঠার পথরেখার দিকেই আমাদের নজর বেশি থাকে। কিন্তু এসব বই পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আত্মজীবনের বিবরণের ফাঁকে ফাঁকে একজন লেখক মুজিবও উঁকি দিয়েছেন।

যিনি কোনো কিছু লেখেন, আক্ষরিক অর্থে তিনিই লেখক। কিন্তু এখানে আমরা সেই অর্থে ‘লেখক’ শব্দটিকে ব্যবহার করছি না। আসলে লেখকসত্তা একটি বিশেষ সত্তা। ইংরেজিতে যাকে ‘অথরশিপ’ বলতে পারি। এই লেখকসত্তাকে কীভাবে চিনব?

লেখকসত্তাকে চিনব তার চারপাশকে লেখকের চিহ্নিতকরণের ধরন দেখে। উচ্চারণের মধ্যে কতটুকু স্বাধীনতা নেন বা স্বাধীনতার প্রয়োজন বোধ করেন, তা দেখে লেখক চিনি। আর চিনি প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা দেখে। একজন অন্য সত্তার মানুষ (ধরা যাক, রাজনৈতিক সত্তার)—যখন কোনো কিছু লেখেন, তখন তাঁর লেখকসত্তা চেনার আরও একটি উপায় আছে। রাজনৈতিক সত্তার কেউ যখন কোনোকিছু রচনা করেন, তখন সেই লেখা যদি তাঁর মূল সত্তাকে (রাজনৈতিক সত্তা) কখনো কখনো ভুলিয়ে দেয়, তখন তাঁকে আমরা লেখক বলতে চাইব। আর সংযমশিল্পের কথা নাহয় না-ই বললাম।

লেখকসত্তাকে চিনব তার চারপাশকে লেখকের চিহ্নিতকরণের ধরন দেখে। উচ্চারণের মধ্যে কতটুকু স্বাধীনতা নেন বা স্বাধীনতার প্রয়োজন বোধ করেন, তা দেখে লেখক চিনি। আর চিনি প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা দেখে। একজন অন্য সত্তার মানুষ (ধরা যাক, রাজনৈতিক সত্তার)—যখন কোনো কিছু লেখেন, তখন তাঁর লেখকসত্তা চেনার আরও একটি উপায় আছে। রাজনৈতিক সত্তার কেউ যখন কোনোকিছু রচনা করেন, তখন সেই লেখা যদি তাঁর মূল সত্তাকে (রাজনৈতিক সত্তা) কখনো কখনো ভুলিয়ে দেয়, তখন তাঁকে আমরা লেখক বলতে চাইব।

আগেই বলেছি, শেখ মুজিব মূলত রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতির জন্য তিনি তাঁর পুরো জীবন ব্যয় করেছেন। ফলে তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা হবে মূলত রাজনৈতিক জীবনেরই আলেখ্য। প্রতিটি শব্দ, বাক্য, উচ্চারণের মধ্যে থাকবে রাজনীতির ঘ্রাণ ও নিশানা; শত্রু–মিত্র খেলা। শেখ মুজিবের তিনটি বইই এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কোথাও কোথাও আমরা লক্ষ করি, মুজিবের রাজনৈতিক সত্তাকে ছাপিয়ে ওঠে আপাত–অযৌক্তিক মানবিক সত্তা। মুজিব যখন ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি সচেতন যে তিনি ইতিহাসের খুব গুরুতর সময়ের বয়ান হাজির করছেন। তাঁর বয়ানে মুসলিম লীগকে ‘জাস্টিফাই’ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এটা তাঁর সেই সময়কার রাজনীতিরই মূলত ‘জাস্টিফিকেশন’। কিন্তু দাঙ্গার বর্ণনার মাঝেমধ্যেই দেখি, তিনি যেন ছেড়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁর রাজনৈতিক সত্তাকে ভুলে যাচ্ছেন। ভুলে যাচ্ছেন যে তিনি একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। হিন্দু আর মুসলমান বর্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সবকিছুকে একটি বর্গের মধ্যে ফেলে বলে উঠছেন, ‘মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়!...মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ৬৬) আবার কারাগারের রোজনামচা বইয়ে তিনি অকপটই বলে ওঠেন, ‘তাই ভাবি রাজনীতি মানুষকে কত নিষ্ঠুর করে!’ এসব জায়গায় সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিসত্তা। আত্মজীবনীর মধ্যে এই যে ব্যক্তি অবাধ্যভাবে কলমের ডগাকে আশ্রয় করে সজ্ঞানতাকে ছাপিয়ে ওঠার জন্য বেয়াড়াভাবে লাফিয়ে উঠছে, একেই তো আমরা বলি লেখকসত্তা। আসলে মুজিবের জীবনের মধ্যেই সম্ভবত এই ব্যাপার অত্যন্ত প্রবল ছিল যে রাজনৈতিক সত্তাকে টপকে তিনি যখন–তখন ব্যক্তি মুজিব হয়ে উঠতে পারতেন।

পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে মহাবয়ান তৈরি হয়েছে, তাতে আমরা দেখি এ এক সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ফল। এই ভেদবুদ্ধির প্রধান কারিগর হিসেবে ইতিহাসের মহাবয়ানে সাব্যস্ত করা হয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ২ জুলাই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে শেখ মুজিবুর রহমান যে কথা বলছেন, তাতে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন ইতিহাসের ইশারা। তিনি ১৯২১, ১৯২৪, ১৯২৮, ১৯৩০-৩১ ও ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের মনোভাব ব্যাখ্যা করে অবশেষে বলতে চাইছেন, ভারতভাগের পেছনে মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ প্রধান নিয়ামক নয় বরং কংগ্রেস ও বর্ণহিন্দুর ভূমিকাই এখানে মুখ্য। বলেছেন, ‘ভারতের মুসলমানরা যখনই তাদের অধিকারের জন্য দাবি করেছে তখন বর্ণহিন্দু পরিচালিত কংগ্রেস তার বিরুদ্ধাচারণ করে বলেছে, “মুসলমানরা স্বাধীনতা চায় না”। মুসলমানরা ফেডারেল ফর্মের সরকার দাবি করেছিল, কিন্তু কংগ্রেস এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল।...তার পরই ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করে। যার ফলে আজ ভারতবর্ষ দুই দেশে ভাগ হয়েছে।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা: ১৪০-১৪২) তিনি এ ক্ষেত্রে প্রথমত তাঁর রাজনৈতিক সত্তার কাছে স্পষ্ট থাকতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত তাঁর লেখকসত্তার কাছেও। কারণ, কলমের একখোঁচায় দিনকে রাত করা যেত। কলম দারুণ এক প্রতারক। ভিন্ন বাস্তবতা তৈরির জন্য সে সতত লেখককে চাপ দিতে থাকে। একটা বড় অংশের লেখক এই প্ররোচনা আর দুর্বলতার খপ্পরে পড়েন। প্রচলিত বয়ানের অনুগামী থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখেন। কিন্তু মুজিব তা করেননি। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি এই সত্য গোপন করতে পারতেন। অথবা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে বাড়তি পানি ঢালতে পারতেন এই বলে যে জিন্নাহই যত নষ্টের মূল। কারণ, ধর্মের দোহাই পেড়ে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের দমনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত বাঙালির একটা বড় অংশ তখন কলকাতার বাঙালির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলেছে। বা এই পথে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গেছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে তিনি কংগ্রেস তথা কলকাতার হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণিকে দায়ভার চাপিয়ে লিখলেন, বাংলা ও ভারতভাগের জন্য মূলত কংগ্রেসই দায়ী। এই স্বাধীনতা নেওয়ার তাগিদই শেখ মুজিবের লেখকসত্তাকে বড় করে তুলেছে। ব্যাপারটা আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা দুটি বইয়েই লক্ষ করব। ব্যক্তিত্বের এই ফর্মই অন্যভাবে আমরা দেখি তাঁর বইগুলোর গদ্যের মধ্যেও।

নন-ফিকশন লেখক দুই ধরনের। এক ধরনের লেখক পড়ে, শিখে ও দেখে নিজের পর্যবেক্ষণ হাজির করেন। এই ধরনের লেখকদের বলা যায় অনেকটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষিত গদ্যলেখক। আরেক ধরনের লেখক থাকেন, যাঁরা শুধু নিজের অভিজ্ঞতা ও অভিযাত্রাকে সঞ্চয় করে লেখেন। হাজির করেন একান্ত নিজস্ব মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ। এগুলো পরবর্তী সময়ে প্রথমোক্ত শ্রেণির লেখকদের জ্ঞানের আকরে পরিণত হয়। প্রথমোক্ত লেখকদের ভাষার মধ্যে, বর্ণনার মধ্যে, স্বরের মধ্যে একটা মার্জন-ঘর্ষণের ছাপ স্পষ্ট থাকে। আর দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণির লেখকদের ভাষার মধ্যে, বর্ণনার মধ্যে, তাদের স্বর প্রক্ষেপণের মধ্যে একধরনের আলাদা উত্তাপ থাকে। আন্তরিকতা সেখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণির লেখক। তাঁর তিনটি বইয়ের গদ্যের মধ্যে একটা আলাদা আন্তরিক ভঙ্গি আছে। এই গদ্যের ভঙ্গি, বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন—সবই মুখের খুব কাছাকাছি। ঘরের কথা, মাঠের কথার মতো সরল। সম্ভবত পণ্ডিত হওয়ার বাসনা থেকে দূরে থাকার কারণেই তাঁর গদ্য ‘অতিজ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে’ ভোগেনি। শুধু তা–ই নয়, শেখ মুজিবের গদ্যের মধ্যে পূর্ব বাংলার ভাষার একটা আকাঁড়া ব্যাপার বেশ প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে। গদ্যের এই বিশিষ্টতার মধ্যেই লেখক মুজিব বেশ উচ্চকিত হয়ে উঠেছেন বলে মনে হয়। তিনি এমন এক গদ্যভঙ্গিতে তিনটি বই–ই রচনা করেছেন, যে গদ্য খুব সহজেই এমনকি উপন্যাসের মতো একটি কাহিনিকে ঠোঁটে করে নিয়ে সবেগে উড়াল দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। বিশেষত আমার দেখা নয়াচীন বইয়ে ভ্রমণের বৃত্তান্ত বর্ণনা দেখে তাই-ই মনে হয়। শেখ মুজিবের গদ্যের ভঙ্গি আর ভাষার মধ্যে একটা নিজস্বতা আছে।

এই নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ছাপ প্রকাশিত হয়েছে বর্ণনার সংযমেও। সাধারণত আত্মজীবনীমূলক রচনায় অধিকাংশ মানুষ নিজের সংযমটা ধরে রাখতে পারেন না। কারণ, তিনি তথ্য ও ব্যক্তিগত উপলব্ধি প্রকাশের ভাড়া খাটেন। পাঠকের ধৈর্য বা পাঠের আনন্দ দেখা তাঁর যেন কাজ নয়। কিন্তু শেখ মুজিবের তিনটি বইয়েরই প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, লেখক হিসেবে তিনি দারুণ সংযমী। গল্পরস জমিয়ে কথা বলার দিকে তাঁর বিশেষ নজর ছিল বলে মনে হয়। এই গুণ বোধ করি তিনি বালকবেলায় বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা পড়ার ভেতর দিয়ে আয়ত্ত করে থাকবেন। এমনকি জেলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ও অপরাপর সাহিত্যপাঠের ভেতর দিয়েও আয়ত্ত করে থাকতে পারেন। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে বেশ কয়েকবার ফিকশন পড়ার ইঙ্গিত থেকে এই অনুমান করা যেতে পারে। যেখান থেকেই তিনি সংযমশিল্পের গুণটি আয়ত্ত করেন না কেন, এটি যে তাঁর লেখকসত্তার পরিচায়ক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারাগারের রোজনামচা থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘ভোরের দিকে বৃষ্টি হতেছিল। তাড়াতাড়ি উঠেছি জানালা বন্ধ করতে। বিছানা ভিজে যাবে। উঠে দেখি মেট উঠে জানালা বন্ধ করেছে। আমি আবার শুয়ে পড়লাম। বিজলি পাখা বন্ধ করতে বললাম, কারণ বেশ একটু ঠান্ডা পড়েছে। আবার ঘুমাইয়া পড়লাম, উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল। উঠেই দেখি চা প্রস্তুত। খেয়ে বাইরে হাঁটতে বেরুলাম। মুরগিটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে যেন কী কী ওষুধ খাইয়েছে বাবুর্চি। বলল, একটু ভালো। আমাকে বলল, “মোরগটা জবাই দিয়ে ফেলি।” বললাম, না, দরকার নাই। ও বেশ বাগান দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভালো লাগে।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা: ৮৮) ক্রিয়াপদের পূর্ববঙ্গীয় রূপ, কথ্যভঙ্গির বাক্যবিন্যাস আর মোরগের অকুতোভয় ভঙ্গিমার মধ্যে সংগ্রামী চেতনার প্রতীকায়ন বিশিষ্ট গদ্যলেখকের পরিচায়কই বটে।

শেখ মুজিবুর রহমানের লেখকসত্তা নিয়ে কথা বলার একটা মুসিবত বা সংকটের কথা বলে শেষ করা যাক। এই সংকট মুজিবকে নিয়ে যিনি লিখবেন সেই লেখকের। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসের জন্য শেখ মুজিব নিঃসন্দেহে বহুপাঠের সম্ভবনাময় এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। শুধু ইতিহাসের মধ্যে নয়, এই নেতার অনুপস্থিতিতেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে তিনি এমন এক জীবন্ত সত্তা যে তাঁকে বিষয় হিসেবে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুজিবকে নিয়ে যিনি লিখবেন, সেই লেখকের নিজস্ব সত্তা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যায়। এত বড় সত্তার নিচে লেখকের চাপা পড়ার নজিরই বাংলাদেশে বেশি লক্ষ করা যায়। এদিক খেয়াল রেখে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখকসত্তা নিরূপণের চেষ্টা করাও এক দুরূহ কাজ। এই দুরূহতা মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখকসত্তা নিয়ে আরও কথা হতে পারে বলে মনে করি।