১৯৪১ সালে চীনে মাদাম চিয়াং কাইশেকের (বাঁয়ে) সঙ্গে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও মার্থা গেলহর্ন
ছবি: সংগৃহীত

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গুপ্তচরবৃত্তির বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে একাধিক গবেষক তাঁদের নিজ নিজ বইতে বিভিন্ন বিষয় তুলে এনেছেন, সেসবের কিছু ধারণানির্ভর এবং কিছু তথ্যপ্রমাণভিত্তিক। সোভিয়েত রাশিয়ার হয়ে কেজিবির পক্ষে কাজ করার যেসব অদৃঢ় প্রমাণ কেউ কেউ হাজির করেছেন, সেসব দিয়ে আবছা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে প্রবল প্রতাপান্বিত এই মার্কিন লেখক কখনো রুশ গুপ্তচরদের সহায়তা করেছিলেন। ১৯৪১ সালে যখন তিনি চীন–জাপান যুদ্ধের সংবাদদাতা হিসেবে তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্নের সঙ্গে হংকং হয়ে চীনের দুর্গম অঞ্চলে মাস তিনেক চষে বেড়িয়েছেন, সেই ভূমিকাতেও কেউ তাঁকে গুপ্তচর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। তবে চীনের বিরুদ্ধে কথিত গুপ্তচরবৃত্তির এই কাজে তিনি আমেরিকা না রাশিয়ার হয়ে নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেটিও কোনো গবেষক দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করতে পারেননি।

জাপানের মেইজো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিদেও ইয়ানাগিসাওয়া তাইওয়ানে অবমুক্ত করা চীনের সরকারি গোপন নথির ভিত্তিতে অন্তত এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে হেমিংওয়ের ছিলেন চীনা কুওমিনটাংয়ের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য তাদের ভাষায় ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু’ হিসেবে চিহ্নিত ইউরোপ ও আমেরিকার সাংবাদিক, লেখক এবং বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন।

একাধিক সূত্রের এ রকম একটা ধারণা রয়েছে যে হেমিংওয়ের চীনযাত্রার আগে আমেরিকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বড়কর্তা হেনরি মর্গেনথাউ ও বিশেষ করে মেজকর্তা হ্যারি হোয়াইটের কাছ থেকে অনুরোধ পেয়েছিলেন যে তিনি যাতে চীনের ভেতরের খবরাখবর, যেমন কুয়োমিনটাং ও কমিউনিস্টদের মধ্যকার সম্পর্ক, চীনা পরিবহনব্যবস্থা, বার্মা রোডের অবস্থা ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। রাইটার, সেইলর অ্যান্ড স্পাই গ্রন্থে দেওয়া সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা নিকোলাস রেনল্ডসের তথ্য অনুযায়ী, হ্যারি হোয়াইট মারা যাওয়ার পর আবিষ্কৃত হয় যে সন্দেহাতীতভাবে তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আমেরিকার গোপন তথ্য পাচার করতেন। এতৎসত্ত্বেও আমেরিকা ও রাশিয়া—উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করতেন তিনি। কারণ, তিনি মনে করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই উভয় দেশের আর্থব্যবস্থা পুনর্গঠন করা সম্ভব।

আমেরিকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই অনুরাধে সাড়া দিয়ে চীন থেকে কিউবা ফেরার পর মর্গেনথাউর কাছে লেখা চিঠিতে হেমিংওয়ে দীর্ঘ একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। আরেক গবেষক পিটার মোরেইরার হেমিংওয়ে: অন দ্য চায়না ফ্রন্ট বইতে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত সেই চিঠিতে হেমিংওয়ে উল্লেখ করেছিলেন, চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার ও কমিউনিস্টদের মধ্যে যে সংঘাত, সেটি গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি লেখেন, ‘আমার বিশ্বাস, যত দিন পর্যন্ত জেনারেলিসিমো কাইশেকের সরকার এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কমিউনিস্টরা কোন কোন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করবে, এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য না হয়, তত দিন কমিউনিস্ট সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। দেশপ্রেমী চীনা হিসেবে কমিউনিস্টরাও তত দিন জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাবে এবং কাগজে–কলমে যতই একটা ভৌগোলিক সীমানা মেনে নিক না কেন, অনুগত চীনা হিসেবে তারা তাদের প্রভাববলয় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে।’ চিঠিতে তিনি জানান, কুয়োমিনটাংয়ের নেতারা তাঁকে জানিয়েছেন, কমিউনিস্টরা তাঁদের কাছে ‘হৃদ্​রোগ,’ আর জাপানিরা হচ্ছে ‘চর্মরোগ’। পরামর্শ হিসেবে তিনি লেখেন যে একটা সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব, যদি মার্কিন প্রতিনিধিরা এটা পরিষ্কার করে দেন যে আমেরিকা কোনো গৃহযুদ্ধে অর্থায়ন করব না।

তিনি এ কথাও বলেন যে চীনারা আমেরিকানদের বোঝাতে চাইবে যে অল্প সময়ের মধ্যে কমিউনিস্টদের ধ্বংস করে দেওয়ার সক্ষমতা চীনা সেনাবাহিনীর আছে এবং এই হৃদ্​রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য শল্যচিকিৎসাটি প্রয়োগ করা উচিত। হেমিংওয়ে সাবধান করে দিয়ে লেখেন, ‘হৃৎপিণ্ডের কোনো রোগ এ রকম সহিংস উপায়ে কখনো নিরাময় করা গেছে কি না, ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা নেই, এবং আমি মনে করি উত্তর–পূর্বাঞ্চলে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কোনো বড় সামরিক অভিযান হবে চীনের জন্য সবচেয়ে বড় সর্বনাশা ঘটনা।’

অভ্যন্তরীণ বহু তথ্য ও পর্যবেক্ষণে ঠাসা দীর্ঘ এই চিঠিকে কেউ গোপন গোয়েন্দা রিপোর্ট বলে ধারণা করলেও আরেক গবেষক নিকোলাস রেনল্ডস তাঁর বইতে স্পষ্ট লিখেছেন, ‘হেমিংওয়ে চীনে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন না।’

তবে চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার যতই বিদেশি বুদ্ধিজীবীদের জামাই আদর দিয়ে ‘বিদেশি বন্ধু’ বলে ভজাতে চেষ্টা করুক না কেন, হেমিংওয়ের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দৃষ্টির চোখে ধুলো দিতে পারেনি। তাই কমিউনিস্ট ও চিয়াং কাইশেক সরকার একযোগে জাপানকে প্রতিহত করছে এ রকম সাজানো খণ্ডযুদ্ধ দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা হেমিংওয়ের সতর্ক দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। এমনকি নিজের কমিউনিস্টপ্রীতিও সেই চিঠিতে লুকানোর চেষ্টা করেননি তিনি।

বিদেশি বন্ধুদের খাতির নিয়ে হেমিংওয়ের তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্ন তাঁর আত্মজীবনী ট্রাভেলস উইথ মাইসেলফ অ্যান্ড অ্যানাদার বইতে লিখেছেন, তাঁদের যখন বিভাগীয় সদর দপ্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই পাঁচ মাইল রাস্তার ওপর অনেকগুলো বিজয় তোরণ তৈরি করা হয়েছিল। সেগুলোতে লেখা ছিল ‘ন্যায়নিষ্ঠা ও শান্তির প্রতিনিধিদের স্বাগত,’ ‘আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদের স্বাগত,’ ‘চূড়ান্ত বিজয় না আসা পর্যন্ত আমরা প্রতিরোধ করব’ ইত্যাদি। মার্থা লেখেন, ‘সাংবাদিকদের জন্য বিজয় তোরণের কথা এ যাবৎ কখনো শুনিনি বা দেখিনি।’

হেমিংওয়ের কথিত গুপ্তচরবৃত্তির পক্ষে তৃতীয় পক্ষের কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া না গেলেও রেনল্ডস সবচেয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন হেমিংওয়ের ভাষ্য থেকেই। ১৯৪৮ সালের ২৪ নভেম্বরে বন্ধু জেনারেল চার্লস ল্যানহামের কাছে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় কেবল রিপাবলিকানদের স্বার্থে তিনি ‘রুশকি’দের পক্ষ হয়ে এমন কিছু ‘বাজে কাজ’ করেছেন, যাতে তাঁর ফাঁসি হতে পারে, তবে তিনি স্বদেশের প্রতি কখনোই আনুগত্যহীন ছিলেন না। পরের চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে কিছু বিষয় সম্পর্কে তিনি লিখতে চান না, কারণ চিঠি বা টেলিফোনের ওপর তাঁর কোনো আস্থা নেই। শেষজীবনে এফবিআই-ভীতি তাঁর এই একান্ত স্বীকারোক্তির সাক্ষ্য দেয়।

কার পক্ষ হয়ে নিজের অজান্তে চীনের ভেতরের তথ্য আমেরিকান কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করেছেন হেমিংওয়ে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া না গেলেও স্ত্রী মার্থা আত্মজীবনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, তাঁদের ওয়াশিংটনের নৌবাহিনী সদর দপ্তরে গিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে চীন সম্পর্কে নানান প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। সেখানে তাঁরা বলেছেন যে এই গৃহযুদ্ধের পর কমিউনিস্টরা চীনের ক্ষমতা দখল করবে। কারণ, চীনা গণতন্ত্রের কথা বলতে গেলে চিয়াং কাইশেক আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ‘ভণ্ড বাকোয়াজ।’ তিনি লেখেন, দেশের সবচেয়ে ভালো মানুষটি একজন কমিউনিস্ট এবং তাঁর মতো কিছু কমরেড আছে তাঁর। এ কথা বলে তিনি চৌ এনলাইকে বুঝিয়েছেন, যাঁর সঙ্গে তাঁদের যেভাবে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটা থ্রিলার ছবিকেও হার মানায়।

চিয়াং কাইশেক সরকারের তরফ থেকে চীন সফরকারী ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু’দের যথাযথ সম্মান ও সহযোগিতা দেওয়া হলেও অতিথিদের তালিকায় ‘ভিআইপি’ হিসেবে গণ্য আরেকটা শ্রেণি ছিল, যাঁরা কুয়োমিনটাং সরকারের প্রচারণার প্রকৃত বাহক ছিলেন।

হিদেও ইয়ানাগিসাওয়া চীনের অবমুক্ত করা গোপন নথি থেকে আবিষ্কার করেন যে হেমিংওয়েকে ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু’ হিসেবে মেনে নেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ের শ্রেণীকরণে তাঁকে ‘ভিআইপি’ তালিকায় রাখা হয়নি। তাঁর বামঘেঁষা মনোভাব এবং নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণেই তাঁকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে প্রতিভাত হয়। এ ধারণা আরও পোক্ত হয়, যখন ইয়ানাগিসাওয়া তাঁর গবেষণাপত্রে চিয়াং কাইশেক সরকারের তথ্য দপ্তরের উপমন্ত্রী হলিংটন টংকে উদ্ধৃত করেন, ‘কোনো কোনো মহলে অনুমান করা হয় যে স্পেনে রিপাবলিকান সরকারের সমর্থক হিসেবে অভিজ্ঞতা হেমিংওয়েকে বামঘেঁষা করে ফেলেছে, তাই চীন সরকার ও কমিউনিস্টদের মধ্যকার মতপার্থক্য বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রমাণ করবেন তিনি।’

যাঁরা ভিআইপি মর্যাদা পেয়েছিলেন, তাঁদের পাঠানো সংবাদভাষ্য ও রিপোর্টে সঙ্গে হেমিংওয়ের লেখাগুলো তুলনা করলেই তাঁকে ভিআইপি ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু’ তালিকায় না রাখার কারণ বোঝা যায়। বিষয়টি হলিংটন টং নিজেও খোলাসা করে লিখেছেন তাঁর লেখায়: ‘হেমিংওয়ে বিশাল সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলের অসংগতিটা শনাক্ত করেছেন। তিনি এ কথাও লিখেছেন, কমিউনিস্টদের প্রচারণা কৌশলের সঙ্গে তাঁর ভালো পরিচয় আছে।’ হেমিংওয়েকে ‘নিরপেক্ষ ও সৎ পর্যবেক্ষক’ বলে স্বীকার করলেও কুয়োমিনটাং সরকারের প্রোপাগান্ডায় তাঁর অনাগ্রহের বিষয়টা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন টং। ‘ভিআইপি’ অতিথিরা যেখানে চিয়াং কাইশেককে মহান ও যোগ্য নেতা হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করেছেন, সেখানে হেমিংওয়ে এই নেতার যোগ্যতা বর্ণনা করতে তাঁকে হিটলার ও মুসোলিনির সঙ্গে এক কাতারে ফেলে তুলনা করেছেন।

এসব বিচার-বিশ্লেষণ থেকে চীনে হেমিংওয়ের গুপ্তচরবৃত্তির কোনো নিরঙ্কুশ প্রমাণ উপস্থাপন করা না গেলেও তাঁর পাঠানো রিপোর্ট থেকে আমেরিকা (এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের হ্যারি হোয়াইটের মাধ্যমে হয়তো রাশিয়াও) কমিউনিস্ট বিপ্লবের জ্বালামুখের কাছে পৌঁছে যাওয়া দেশটির ভেতরের খবরাদি পেয়ে উপকৃত হয়েছিল—এটা নিশ্চিত। জেনারেল ল্যানহামের কাছে লেখা চিঠিতে হেমিংওয়ে স্পেনে তাঁর রুশ যোগাযোগের বিষয় খোলাখুলি স্বীকার করলেও চীনে জ্ঞাতসারে কিংবা অজান্তে কোনো ধরনের গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার বিষয়টি অমীমাংসিত। সর্বোপরি, চীনে যাওয়ার কোনো অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মার্থা কর্মোপলক্ষে যাচ্ছিলেন বলেই তিনি নিতান্ত অনিচ্ছায় তাঁর সঙ্গ নিয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে মার্থা সেটা স্পষ্ট করে লিখেছেন, ‘এই মারাত্মক রোমহর্ষ যাত্রায় আমি একজন অনিচ্ছুক সঙ্গীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম, যেখানে যাওয়ার কোনোই ইচ্ছে ছিল না তাঁর।’ উল্লেখ্য, পুরো বইতে মার্থা একবারও স্বামীর নামোল্লেখ করেননি, বরাবরই লিখেছেন ‘আনউইলিং কমপ্যানিয়ন’ কিংবা সংক্ষেপে ‘ইউসি।’