মেয়ের সঙ্গে কেমন ছিল জীবনানন্দের সম্পর্ক

১৭ ফেব্রুয়ারি কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন। আর তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশের জন্মদিন ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি। মেয়েকে নিয়ে তেমন কিছুই লেখেননি বরিশালের এই কবি। কবির জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে বাবা-মেয়ের সম্পর্কের একটি অবয়ব তৈরির চেষ্টা

জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশেরছবি অবলম্বনে কোলাজ সৈয়দ লতিফ হোসাইন

ছোটবেলায় মঞ্জুশ্রীর আমাশয় হলো। কিছুতেই সারে না। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে মেয়েটা। অবস্থা এমন হলো যে কিছুতেই আর বিছানায় শুতে চায় না। কেবলই বলত, ‘কোলে শুয়ে ঘুরব।’ কিন্তু সাংসারিক নানা কাজের চাপে মা লাবণ্যের পক্ষে সারাক্ষণ মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘোরা সম্ভব নয়। জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য দাশ লিখছেন, ‘আমি অবাক হয়েছি কবির ধৈর্য দেখে। মেয়েকে কাঁধের ওপরে শুইয়ে রাতের পর রাত তিনি ঘরের ভিতরে ঘুরে বেড়াতেন। একটু ক্লান্তি বোধ করতেও কোনো দিন দেখিনি।’ (মানুষ জীবনানন্দ, লাবণ্য দাশ, ভাষাচিত্র, ২০১৫, পৃ. ৩৭)।

জীবনানন্দ-লাবণ্য দম্পতির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম তাঁদের বিয়ের প্রথম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের আগেই ১৯৩১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে, সর্বানন্দ ভবনে, যখন জীবনানন্দ বেকার, আর্থিক টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত। সংগত কারণেই সংসারের প্রথম সন্তানের আগমনের আনন্দ সেভাবে উদ্‌যাপিত হয়নি। মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যরা মঞ্জুশ্রীকে সংক্ষেপে ‘মঞ্জু’ বলে ডাকতেন।

জীবনানন্দ ও তাঁর মেয়ের জন্মতারিখ কাছাকাছি সময়ে—বাবার ১৭ ফেব্রুয়ারি, মেয়ের ১৫। মঞ্জুশ্রী লিখেছেন, ‘বাবা আমাদের পরম বন্ধু ছিলেন। কোনো সময়ে কিছুদিন আমি কাকামণি-কাকিমার বাড়িতে ছিলেম। আমার বসন্ত হলো। বাবা রোজ সকালে বিকালে আসতেন। আশীর্বাদের মতো হাতখানি আমার মাথায় রাখতেন। আমার ছোট ভাই বিছানায় বাবার পায়ের কাছে বসে গল্প করত। একবার আমায় বললেন, “তোর বইয়ের লিস্ট দে, কিনে দেব। ভালো করে পড়ছিস তো? ফার্স্ট ক্লাস পেতে হলে কিন্তু ভালো করে পড়তে হয়।”’ (‘জীবনানন্দ দাশ: আমার বাবা’, জীবনানন্দ আকাদেমি পত্রিকা, ৩ আগস্ট ১৯৯৫)।

বাবা ও মেয়ের সবচেয়ে বড় মিল হলো দুজনই ‘সকল লোকের মাঝে বসে নিজের মুদ্রাদোষে একা।’ দুজনই তাঁদের সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে বেমানান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম এবং এরপর আরও একাধিকবার মঞ্জুশ্রী দাশ ঢাকায় এসেছেন। রেডিওতে কাজের সুবাদে তখন কবি জাহিদুল হকের সঙ্গে মঞ্জুশ্রীর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। মঞ্জুশ্রীর ঢাকা সফর নিয়ে জাহিদুল হকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছিলেন অনেক কথা। ‘ঢাকায় মঞ্জুশ্রী’ নামের একটি লেখায় আমি লিখেছিলামও মঞ্জুশ্রী ও জাহিদুল হকের সেই আলাপন, ‘মঞ্জুশ্রীকে দেখে আমার মনে হতো সারা পৃথিবীর সকল অন্ধকার তিনি জড়িয়ে আছেন। এত চুপচাপ মানুষ আমি আগে দেখিনি। সব সময়ই গম্ভীর। একবার রিকশায় যেতে যেতে তাকে সাহস করে বললাম, “তোমাকে একটা কথা বলি যদি মনে কিছু না করো।” মঞ্জুশ্রী বলল, “বলো।” বললাম, “তোমাকে দেখলেই মনে হয়, তুমি বুঝি আত্মহত্যা করতে চাও। আত্মহত্যা করো না। জীবন মূল্যবান।”’ (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০ মে ২০২৩)

জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য দাশ লিখেছেন, ‘আমি অবাক হয়েছি কবির ধৈর্য দেখে। মেয়েকে কাঁধের ওপরে শুইয়ে রাতের পর রাত তিনি ঘরের ভিতরে ঘুরে বেড়াতেন। একটু ক্লান্তি বোধ করতেও কোনো দিন দেখিনি।’

জীবনানন্দের মা-বাবা দুজনই মঞ্জুশ্রীকে খুব স্নেহ করতেন। ১৯৪২ সালের ৭ অক্টোবরের ডায়েরিতে জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দাশ লিখেছেন মঞ্জুশ্রীর পরীক্ষার ফলের কথা, মঞ্জু তখন তমলুকে পিসির কাছে, ‘মঞ্জুর পরীক্ষার নম্বর বাহির হইয়াছে, অঙ্কে ফার্স্ট হইয়াছে। মোটের ওপর মন্দ করে নাই। কাল হইতে মঞ্জুর অল্প জ্বর।’

কুসুমকুমারীর ১৪ এপ্রিল ১৯৪৩ তারিখের ডায়েরিতেও আছে মঞ্জুর প্রসঙ্গ, ‘মঞ্জু, আমার সোনার মঞ্জু, ওকে তোমরা কেউ বুঝিলে না। ওর দাদু বুঝিয়াছিলেন ও কী জিনিস। উহাকে তোমরা শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত করিও।’ মঞ্জুর মা-বাবার প্রতি কুসুমকুমারীর এই আকুতি।

মেয়েকে নিয়ে জীবনানন্দের নিজেরও আকুতি কিছু কম ছিল না। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই কলকাতা শহরের ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে বসে মঞ্জুশ্রীকে তিনি যে চিঠি লেখেন, সেখানে আছে মেয়ের জ্বরের খবর পেয়ে বাবার দুশ্চিন্তা ও সাবধানে থাকার পরামর্শ। কবি লিখেছেন, ‘বিদেশে অসুখ করলে আমাদের খুব উদ্বেগ।’ (পত্রালাপ: জীবনানন্দ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, এবং মুশায়েরা, ২০১৭, পৃ. ১৬৬)।

বাবা সম্পর্কে মঞ্জুশ্রী যা লিখেছেন, সেখানে রয়েছে তাঁর ঝরঝরে গদ্যভাষার নমুনা। বলার ঢংটি খুবই হৃদয়গ্রাহী। বাবার চারিত্রিক নীরবতা বা অনেক লোকের মাঝখানে বসে একা বা আলাদা হয়ে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটাই মঞ্জুশ্রীর ভেতরে ছিল এবং লেখালেখিতে তিনি সিরিয়াস হলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঞ্জুশ্রী দাশও হয়তো একটি উল্লেখযোগ্য নাম হতে পারত।

মানুষ জীবনানন্দ বইয়ের বিভিন্ন স্থানে প্রাসঙ্গিকভাবে মেয়ে মঞ্জুশ্রীর কথাও লিখেছেন লাবণ্য দাশ। তিনি মনে করতেন: কবির কবিত্ব শক্তির কিছুটা অংশ নিয়েই মঞ্জুশ্রী জন্মেছে। আট বছর বয়স থেকেই মেয়েটি কবিতা লিখতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ভালো না হলেও সে হতাশ হয়নি। দশ বছর বয়সে ভালোই লিখতে শিখল। মঞ্জুর সেই সময়কার একটি কবিতা তাঁর পিসেমশাই শ্রী চিদানন্দ দাশগুপ্ত কোনো একটি পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন। মেয়ে যত না পড়াশোনা করেছে, কবিতা লিখছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ বিষয়ে সে তার বাবার কাছ থেকে যথেষ্ট উৎসাহ পেত, ‘বহুবার কবিকে বলতে শুনেছি—লেখ, তুই লেখ। তোর মাকে দিয়ে তো আর এসব কাজ হবে না। তুই-ই আমার নাম রাখবি।’ (মানুষ জীবনানন্দ, লাবণ্য দাশ)

তবে মঞ্জুশ্রী লেখালেখিতে নিয়মিত না হলেও জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন।

মঞ্জুশ্রীর কর্মজীবন ছিল তাঁর বাবার মতোই অস্থির, অনিশ্চিত। কোথাও যেন নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তিনিও শিক্ষকতা করেছেন। বাবার মতোই চাকরি খুইয়েছেন। রেডিওতে কাজ করেছেন। জার্মানিতেও চাকরি করেছেন কিছুদিন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারেননি। জীবনানন্দ দাশের ভাইয়ের ছেলে অমিতানন্দ দাশ জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করে মঞ্জুশ্রীকে আরেকটি চাকরি পাইয়ে দেওয়া হয় লেবার ডিপার্টমেন্টে। সম্ভবত অফিসটা ছিল উত্তর কলকাতায়। শেষ জীবনে মঞ্জুশ্রী পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতেও চাকরি করেন। সেই চাকরিটা পাওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতায় কয়েকজন জীবনানন্দ অনুরাগীর ভূমিকা ছিল।

বাংলাদেশে একটা চাকরি নিয়ে (রেডিও বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে) স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চেয়েছিলেন মঞ্জুশ্রী। বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদকে লেখা একাধিক চিঠিতে তাঁর সেই আগ্রহের কথা রয়েছে।

মঞ্জুশ্রী বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নানা কারণে মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে ছিলেন। সেই টানাপোড়েন একপর্যায়ে মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়। কলকাতা শহরে ‘বাউল মন’ নামে একটি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালের ১৯ মার্চজীবনানন্দের মৃত্যু হয় এর ৪১ বছর আগে, ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর। তারও অন্তত ২০ বছর আগে জীবনানন্দ লিখেছিলেন ‘মেয়ে’ শিরোনামে একটি কবিতা। এটি তাঁর ধূসর পাণ্ডুলিপি সময়কার লেখা। অর্থাৎ ১৯৩৬ সালের আগে। মঞ্জুশ্রীর জন্ম ১৯৩১ সালে। কবিতায় মেয়েটি মৃত। লিখছেন—

‘আমার চোখের ‘পরে, আমার মুখের’ পরে মৃত মেয়ে;

আমিও তাহার মুখে দু’হাত বুলাই;

তবু তার মুখ নাই—চোখ চুল নাই।

কবিতার শুরুটা এ রকম—

আমার এ ছোটো মেয়ে—সবশেষ মেয়ে এই

শুয়ে আছে বিছানার পাশে

শুয়ে থাকে—উঠে বসে—পাখির মতন কথা কয়

হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে মাঠে মাঠে আকাশে আকাশে।

কিন্তু জীবনানন্দ এই মেয়ের কথা ভুলে যান।

          একদিন ‘মেঘ দিয়ে ভেসে’ এসে মেয়েটি বলে,

‘বাবা তুমি ভালো আছ? ভালো আছ? ভালোবাসো?’

বাবা বলছেন, ‘হাতখানা ধরি: ধোঁয়া শুধু কাপড়ের মতো শাদা মুখখানা কেন!’

মেয়ে বলছে, ‘কবে আমি মরে গেছি—আজো মনে

                                                          করো?’

দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই

আমার চোখের ‘পরে, আমার মুখের পরে’ মৃত মেয়ে;

আমিও তাহার মুখে দু’হাত বুলাই।

কবিতাটির একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, মৃত মেয়েটি আসলে একটি পাখি। এখানে নিজের মেয়েকে পাখির সঙ্গে তুলনা করেছেন, নাকি পাখিকে মেয়ের সঙ্গে—সেটি এক রহস্য।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতা শহরের রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর আহত হওয়ার পর জীবনানন্দকে যেদিন অদূরেই এলগিন রোডে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, মঞ্জুশ্রী তখন কলকাতা শহরেই। বাবার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে যান হাসপাতালে। দেখেন, মলিন কাপড়ে রক্তের দাগ। জীবনানন্দ যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন মেয়ের কাছে গান শুনতে চেয়েছিলেন।

ব্যথা পেল সেই প্রাণ—খানিক দাঁড়াল চুপে—তারপর

                                                          ধোঁয়া

সব তার ধোঁয়া হয়ে খ’সে গেলো ধীরে ধীরে তাই,

শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়ায় সে একবার

কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক—

চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে—

                                                আর কেউ নাই।