তাহলে গরু কোথায় রাখব
কোরবানি ঈদ মানেই গরু নিয়ে কায়কারবার, ঘুরে আসা যাক নানা রঙের গরুর বাজার...
মতিন সাহেব অবশেষে সত্যি সত্যিই আস্ত একটা গরু কিনে ফেললেন। সব সময়ই তিনি ভাগে গরু কোরবানি দেন। এবার একাই একটা গরু কোরবানি দেবেন, যা থাকে কপালে। দুই ঈদের বোনাস একসঙ্গে পাওয়ায় এই সুবিধা। হৃষ্টচিত্তে গরু নিয়ে হাট থেকে ফিরে গ্যারেজে বাঁধতে যাচ্ছেন, তখন অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার হাউ মাউ খাউ করে করে ছুটে এল।
: স্যার, স্যার, আমার চাকরিডা খাইয়েন না।
: মানে?
: মানে কোরবানির গরু গ্যারেজে রাখা যাইব না। ওয়াসেক স্যারের কড়া নির্দেশ।
: তাহলে আমি গরু রাখব কোথায়? এ্যাঁ?
: খাড়ান স্যাররে একটা ফোন দেই।
ফোন পেয়ে দ্রুতই নেমে এলেন ওয়াসেক সাহেব। আলহাজ আবদুল ওয়াসেক। তিনি এই ১০ তলা অ্যাপার্টমেন্টের ল্যান্ড ওনার প্লাস টোটাল ২০ ফ্ল্যাটের ১২টাই তাঁর। আর মতিন সাহেব ভাড়ায় থাকেন।
: কী ব্যাপার? আপনি এখানে গরু রাখতে পারবেন না।
: তাহলে আমি কোথায় গরু রাখব?
: সেটা আমার জানার বিষয় না। তবে এখানে রাখতে পারবেন না
: কারণটা জানতে পারি?
: কারণ জানাতে আমি বাধ্য নই। বাইরে গরু রাখুন, রাস্তায়...।
: রাস্তায় গরু রাখব মানে? চুরি হলে?
: চুরি হলে থানা-পুলিশ আছে...।
এই নিয়ে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হলো। তবে লাভ হলো না। উল্টো ওয়াসেক সাহেবের দলের লোক ভারী হলো। শেষ পর্যন্ত মতিন সাহেব একটা কাণ্ড করলেন। যখন গ্যারেজে কেউ নেই, তখন কেয়ারটেকারের হাতে নগদ কিছু দিয়ে লিফটে করে গরু সোজা তাঁর ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে নিয়ে তুললেন। কপাল ভালো গরুটা শান্তশিষ্ট, কোনো ঝামেলা করল না।
কিন্তু ঝামেলা করলেন মতিন সাহেবের স্ত্রী।
: মানে কী! ড্রয়িংরুমে গরু নিয়ে এসেছ? ঈদের দুদিন আগে এসব কি ফাজলামো?
: দেখো গ্যারেজে গরু রাখতে দিচ্ছে না। মাত্র তো দুটো দিন।
: গ্যারেজে গরু রাখতে না দিলে ছাদে নিয়ে যাও।
স্ত্রী ক্ষিপ্ত হলেও ফোর আর সিক্সে পড়ুয়া তাঁর দুই ছেলেমেয়ে মহাখুশি। ছেলে তো বাবাকে প্রস্তাবই দিয়ে বসল, গরুটাকে কিছুক্ষণের জন্য তাদের বেডরুমে রাখা যাবে কি না। সে ওর সঙ্গে একটা সেলফি তুলবে।
ওদিকে অ্যাপার্টমেন্টে খবর রটে গেছে, মতিন সাহেব লিফটে করে গরু তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়াসেক সাহেব দলবল নিয়ে হাজির হলেন ‘সেভেন বি’ ফ্ল্যাটে, মানে মতিন সাহেবের ফ্ল্যাটে। সাথে কয়েকজন অতি উৎসাহী ভাড়াটে।
: কী ব্যাপার মতিন সাহেব, আপনি নাকি লিফটে করে গরু এখানে নিয়ে এসেছেন?
: হ্যাঁ, কী করব! গ্যারেজে রাখতে দেবেন না, তা ছাড়া লিফটের দরজায় লেখা আছে, ‘বুয়া-ড্রাইভার আর হকার লিফট ব্যবহার করতে পারবে না।’ গরুর ব্যাপারে তো কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
: আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন? এখনই গরু নিয়ে বের হন, নইলে...।
: নইলে কী করবেন? মামলা করবেন?
: দেখুন, এই ফ্ল্যাটের মালিক আমার মামাশ্বশুর রিটায়ার্ড কর্নেল। তাঁকে খবর দেওয়া হয়েছে...তিনি আসছেন। তিনি আসার আগেই আপনি গরু সরান। সিঁড়ি দিয়ে গরু নামিয়ে নিয়ে যান।
: দেখুন ভাই, ভাড়ার চুক্তিপত্রেও কিন্তু নিজের ফ্ল্যাটে গরু রাখা যাবে না, এ রকম কোনো শর্ত নেই।
আবার ধুন্ধুমার তর্কবিতর্ক শুরু হলো। এর মধ্যে একজন প্রস্তাব করল, ‘আমার মনে হয় গরু যখন গ্যারেজে রাখা যাবে না, তখন ছাদে রাখা হোক। ছাদ খোলামেলা আছে। ওখানে গরু ভালোই থাকবে।’
: কে কে বলল কথাটা?
ক্ষিপ্ত ওয়াসেক সাহেব ঘুরে তাকালেন। দেখলেন, এইট বির সেই সাংবাদিক লোকটা। ব্যাটা মহা ফাজিল। তার বিরুদ্ধে লেগে থাকে সব সময়।
: আপনিও কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন?
: ইয়ার্কি করব কেন? গ্যারেজে যখন রাখা যাবে না, তখন এ ছাড়া আর উপায় কী?
: ঠিক ঠিক এটা ভালো বুদ্ধি।
আরও দু-একজন সমর্থন দিল, ‘ছাদেই নেওয়া হোক।’
: খবরদার ছাদে আমার ছাদবাগান আছে, অনেক দামি দামি গাছ আছে।
: তাহলে তো আরও ভালো গরুর গোবরে ফ্রি ফ্রি ভালো সার পাবে আপনার গাছ।
: আরে বাবা ছাদ তো ২৪ ঘণ্টাই তালা মারা থাকে...আমরা কেউই যেতে পারি না। ওখানে নেবে কীভাবে?
: ঠিকই তো, আচ্ছা ওয়াসেক সাহেব, প্রসঙ্গটা যখন উঠলই, তখন বলি, আপনি ছাদের দরজা খুলতে দেন না কেন? ২৪ ঘণ্টাই তালা মারা। ছাদ কি আপনার একার? আমরাও তো ফ্ল্যাটের মালিক, হতে পারে আপনার থেকে সংখ্যায় কম।
: ঠিক, ঠিক...এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। ছাদ কেন বন্ধ থাকবে? আরও বেশ কয়েকজন ‘ঠিক, ঠিক’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।
ওয়াসেক সাহেব দেখলেন ঘটনা অন্য দিকে যাচ্ছে-গরু থেকে ফোকাস চলে যাচ্ছে ছাদে। এর মধ্যে কে একজন বলে বসল, ‘আচ্ছা, ছাদে গাঁজার গাছ নেই তো? আমি কিন্তু আমার ফ্ল্যাট থেকে মাঝেমধ্যে গাঁজার গন্ধ পাই।’
ক্ষিপ্ত ওয়াসেক সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখন দেখা গেল সেই বৃদ্ধ রিটায়ার্ড কর্নেলকে। তিনি এসেই একটা হুংকার দিলেন ইংরেজিতে, ‘হু দ্যাট রাস্কেল?’
এই সময় মতিন সাহেব কেশে গলা পরিষ্কার করে শান্ত স্বরে বললেন, ‘দেখুন, আপনারা শান্ত হোন। সিদ্ধান্তটা আগে ফাইনাল করুন, গরু কি ছাদে নেব, না আমার ড্রয়িংরুমেই রাখব; আমার ছেলে অবশ্য চাচ্ছে ওদের বেডরুমে নিতে...তবে গরুটা শান্ত আছে। আপনাদের চেঁচামেচিতে ক্ষেপে গেলে কিন্তু ঝামেলা হবে।’
: ঝামেলার দেখেছেন কী? আমি এখন পুলিশকে ফোন দিচ্ছি, আমার ফ্ল্যাটে গরুবাজি!...‘হ্যালো রমনা থানা, আমি রিটায়ার্ড কর্নেল...’
এবং কী আশ্চর্য, সত্যি সত্যি খানিক বাদে পুলিশ এসে হাজির! তারা অবশ্য মতিন সাহেবের ফ্ল্যাটের দিকে গেল না। সোজা উঠে গেল ছাদে। পিছে পিছে ওয়াসেক সাহেব এবং তার দলবল, আর উৎসাহী জনতা।
: আপনিই ওয়াসেক সাহেব? এই অ্যাপার্টমেন্টের ল্যান্ড ওনার? ওসি সাহেব ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন।
: জি, জি, কিন্তু কেস তো সেভেন বিতে, ওখানে চলুন...ওখানে গরু...
ওয়াসেক সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই পুলিশের এক কর্মকর্তা বললেন, ‘ছাদের দরজা খুলুন।’
: কেন?
: আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে, ছাদে গাঁজার চাষ হচ্ছে।
: কী! ক্কী! কী বলছেন?
ছাদ খোলা হলো। মতিন সাহেবের ফ্ল্যাট ছেড়ে সবাই এখন ছাদে। না, ছাদবাগানে গাঁজার কোনো গাছ পাওয়া গেল না। তবে একটা টবে পপি গাছের চারা পাওয়া গেল। ওয়াসেক সাহেবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলল থানায়। তাঁকে ঘিরে ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করেছে। রিটায়ার্ড কর্নেল মামাশ্বশুরকেও আর দেখা গেল না।
একফাঁকে কেয়ারটেকার এসে লিফটে করে গরুটাকে নিয়ে গেল ছাদে। খুব শিগগির দু-তিনটে ছাগলও এসে হাজির হলো এখানে। গ্যারেজেও দুটো গরু আছে এখন। এখন আর কোনো বাধা নেই। লিফটের দরজায় ‘বুয়া-ড্রাইভার আর হকারের লিফট ব্যবহার নিষিদ্ধ’ নোটিশটাও কে যেন ছিঁড়ে ফেলেছে।
মনে হচ্ছে, এই অ্যাপার্টমেন্টে ঈদটা এবার বেশ ভালোই হবে।