২৫ মার্চ রাতে ৩২ নম্বরে কী ঘটেছিল

ঢাকা শহরে ঘন অন্ধকার। বাইরে প্রচণ্ড শব্দে যেন সমস্ত পৃথিবীতে কেয়ামত নেমে আসছে, এই রকম অবস্থায় তাঁরা চারজন—রেনু, মুজিব, জামাল আর রাসেল এক ঘরে রইলেন। কী ঘটেছিল ২৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে…

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বাড়ি। বাড়িটি এখন জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

হাজি মোরশেদ ফোন রিসিভ করেই চলেছেন।

এরপর বাড়িতে এলেন পাবলিক কমিশনের ডিরেক্টর তবীবুর রহমান।

‘মুজিব ভাই পালান। ওরা মেরে ফেলবে আপনাকে।’

মুজিব বললেন, ‘ইফ দে ডোন্ট গেট মি, দে উইল ম্যাসাকার অল দ্য পিপল, অল মাই পিপল অ্যান্ড ডেস্ট্রয় দ্য সিটি। তুমি চলে যাও। এই বাড়ি যেকোনো সময়ে অ্যাটাকড হবে। নাউ, লিভ।’

মুজিব ওপরে গেলেন। একটা ফোন এল। ‘রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে বলছি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আর্মি অ্যাটাক করেছে। পুলিশ পাল্টা জবাব দিচ্ছে। ভীষণ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে।’

‘রাজারবাগ পুলিশ লাইন অ্যাটাক করেছে? দেন, ফ্রম নাউ, বাংলাদেশ ইজ ইনডিপেন্ডেন্ট। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

রাত্রি ১২টা। ক্রিং ক্রিং। হাজি মোরশেদ ধরলেন, ‘হ্যালো।’

‘হ্যালো, বলধা গার্ডেন থেকে বলছি।’

‘আমি শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে বলছি।’

‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। মেশিন কী করব?’

‘আপনি একটু ধরেন। মুজিব ভাইকে জিগ্যেস করে আসছি।’

হাজি মোরশেদ দৌড়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে, মেশিন কী করবে জানতে চায়।’

মুজিব বললেন, ‘মেশিন ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’

হাজি সাহেব বুঝলেন, বলধা গার্ডেন একটা কোড। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ পাঠানো হয়ে গেল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লোকেরা সেই বার্তা ধরে ফেলতে পারল। তারা তাদের সে-রাতের স্মৃতিকথায় লিখবে:

‘পাকিস্তান রেডিওর পাশের ওয়েভ লেংথে শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন মুজিব। অনুচ্চ স্বরে শোনা গেল সেই ঘোষণা।

‘দিস মে বি মাই লাস্ট মেসেজ। ফ্রম টু ডে বাংলাদেশ ইজ ইনডিপেনডেন্ট।

‘হয়তো এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি যে যেখানে আছ, যার কাছে যা আছে, তা নিয়ে দখলদার সৈন্যদের শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষজনকেও বিতাড়ন করে বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’

সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে গেল টেলিপ্রিন্টারগুলো। সারা দেশে বার্তা যেতে লাগল শেখ মুজিবের নামে। টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার, টেলেক্সের মাধ্যমে সারা দেশের থানায় থানায় পৌঁছে যেতে লাগল ঘোষণা।

শেখ মুজিব নিজের শোবার ঘরে ঘুমন্ত রাসেলকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। রেনু জানালার কবাট লাগতে গিয়ে দেখলেন, হেলমেট পরা সৈন্যরা ধুপধুপ করে তাঁদের বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে অবস্থান নিচ্ছে।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলবে, চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে গেল বার্তা, বার্তা পেলেন কাদের সিদ্দিকী, বার্তা পেলেন কদিন পরে সীমান্ত অতিক্রম করবার সময়ে তাজউদ্দীন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রাম ওয়্যারলেস পাঠাতে লাগল বিদেশি জাহাজগুলোর কাছে। (১৯৭২ সালের ওয়্যারলেসের কর্মীরা তাদের পাঠানো ওয়্যারলেস মেসেজের একটা কপি বাঁধাই করে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেবেন।) ২৬ মার্চ ভোর হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, সিলেট, শেরপুর, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া—নানা জায়গায়।

ইংরেজিতে বার্তা এল:

‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহাঘ্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ—দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহাঘ্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়ন করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’

ঢাকা শহরে ঘন অন্ধকার। ঢাকা শহরজুড়ে ভয়, আতঙ্ক। ট্যাংকের চাকার ঘর্ষণের গমগম আওয়াজ। নরকের দরজা খুলে দেওয়া হলো। পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাংক, কামান, মর্টার নিয়ে ঘেরাও করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর, সব থানা, সব বস্তি, পুরান ঢাকার হিন্দু-অধ্যুষিত মহল্লাগুলো। তারা টেলিফোন, টেলিগ্রাম, ওয়্যারলেস লাইন কেটে দিল, এক্সচেঞ্জগুলো দখলে নিল, বেতার-টিভি ভবনে ঢুকে পড়ল; ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্ররা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো গুলি। পুলিশ লাইনে পুলিশরা রাইফেল হাতে পাল্টা গুলি চালাতে লাগল, কিন্তু ট্যাংক মর্টার বাহিনীর সামনে টিকে থাকা কতক্ষণ সম্ভব! আগুন জ্বলছে বস্তিতে বস্তিতে, মহল্লায় মহল্লায়, ঘুমন্ত নারী-পুরুষ-শিশুরা দৌড়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য বাইরে আসতেই তাদের ওপরে চলল নির্বিচার গুলি; জ্বলন্ত মানুষ গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, গুলিবিদ্ধ মানুষ পুড়ে যাচ্ছে, জ্বলন্ত শিশু ছুটছে, গুলিবিদ্ধ নারী কাতরাচ্ছে, থানায় থানায় পুলিশরা মরে পড়ে রইল টেবিলে টেবিলে, লাশে লাশে ছেয়ে গেল বুড়িগঙ্গা, যেন মাছের মড়ক লেগে গেছে, মড়া মাছে ছেয়ে গেছে পানি, তেমনিভাবে মানুষের লাশে ছেয়ে গেল নদী।

 বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষক কোয়ার্টারে গিয়ে নাম ধরে ধরে ডেকে ডেকে বের করা হলো শিক্ষকদের, আর সঙ্গে সঙ্গে চালানো হলো গুলি। ছাত্রাবাসের তলায় তলায় রুমে রুমে গিয়ে গুলি চালানো হলো, বালিশ আর বিছানা ভেসে গেল রক্তে। জগন্নাথ হল থেকে ছাত্রদের ধরে আনা হলো, লাইন করে সকালবেলা তাঁদের মাঠে আনা হবে, আর মারা হবে গুলি করে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার থেকে সেই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করবেন একজন অধ্যাপক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যাগুলোর একটা সংঘটিত হচ্ছে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর থেকে সেই কালরাতটিতে।

শেখ মুজিব নিজের শোবার ঘরে ঘুমন্ত রাসেলকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। রেনু জানালার কবাট লাগতে গিয়ে দেখলেন, হেলমেট পরা সৈন্যরা ধুপধুপ করে তাঁদের বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে অবস্থান নিচ্ছে।

বাইরে প্রচণ্ড শব্দে যেন সমস্ত পৃথিবীতে কেয়ামত নেমে আসছে, এই রকম অবস্থায় তাঁরা চারজন—রেনু, মুজিব, জামাল আর রাসেল এক ঘরে রইলেন। প্রচণ্ড শব্দ, আর আলো-আগুনের বিস্ফোরণ, যেন এক লক্ষ বজ্রপাত ঘটছে একসঙ্গে, এমনি শব্দ আর বিদ্যুচ্চমক। একটা গুলির খোসা এসে পড়ল জামালের পায়ে, রাসেলের পাশে। মুজিব বের হলেন। নিচে হাজি মোরশেদ। তাকে জিগ্যেস করলেন, গুলি এল কোন দিক থেকে? যেকোনো একদিক থেকেই আসতে পারে। কী বলবেন হাজি মোরশেদ!

বঙ্গবন্ধু ওপরে চলে গেলেন। বাইরে অবিশ্রান্ত গুলির শব্দ।

এই সময় সৈন্যরা ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। সামনে পেল হাজি মোরশেদকে। মোরশেদ তখন ফোন তুলেছেন কাউকে খবরটা দিতে হবে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আন্ডার অ্যাটাক, আওয়াজ এল, হ্যান্ডসআপ। মোরশেদ হাত দুটো ওপরে তুলতে চাইছেন, কিন্তু কিছুতেই উঠছে না। টেলিফোনের তার ছিঁড়ে ফেলে সেটটা তারই মাথায় প্রচণ্ড শক্তিতে আছড়ে মারল একজন, তার মাথায় নেমে এল আঘাত, তিনি শুধু শুনতে পেলেন, মাত মারো। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাসায় আশ্রিতদের একজনের বাচ্চা কেঁদে উঠল, উর্দুভাষী সৈনিক চিৎকার করে উঠল: এই বাচ্চা, মায়ের কাছে যাও।

শেখ সাহেব বেরিয়ে এলেন দোতলা থেকে, হাউ ডেয়ার ইউ হিট মাই ম্যান। আই ওয়ান্ট হিম অ্যালাইভ।

শেখ সাহেব এমন জোরে চিৎকার করে উঠলেন যে পাশের বাড়িতে মেঝেতে শুয়ে মোশাররফ সাহেব এই কথা শুনতে পেলেন।

নিচতলার বারান্দায় খাঁচায় ময়না পাখিটা চিৎকার করে উঠল, হ্যালো জয় বাংলা।

অমনি গুলি। ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ শব্দ তার দুই ঠোঁট চিরে গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আত্মার সঙ্গে উড়তে লাগল আকাশময়, আর বলতে লাগল জয় বাংলা জয় বাংলা। উন্মত্ত সৈন্যরা ট্রেসার গান শুট করতে লাগল আকাশে, পুরো ঢাকা শহরের আকাশ এক লাখ ফ্লাশ লাইটের আলোয় ঝলসে গেল যেন।

আনিসুল হকের উপন্যাস ‘এখানে থেমো না’
এখানে থেমো না, আনিসুল হক, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২৭২ পৃষ্ঠা, দাম: ৫৩০ টাকা।

শেখ মুজিব চিৎকার করে বললেন, ‘স্টপ ফায়ার। কী চাও।’

কয়েকজন সৈনিক ছুটে যাচ্ছে শেখ মুজিবের দিকে। সিঁড়ির কাছে যাওয়ার আগেই তাদের অধিনায়ক বললেন, ‘কেউ গুলি করবে না।’

তাঁর প্রতি নির্দেশ আছে, শেখ মুজিবকে জীবন্ত ধরতে হবে।

মেজর বলল, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে স্যার।’

মুজিব বললেন, ‘ওকে, আমি তৈরি হয়ে আসছি। তখন তাঁর পরিধানে ছিল লুঙ্গি গেঞ্জি। তিনি ভেতরে ঢুকে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে নিলেন।

নিচে সৈন্যরা মহিউদ্দীনের মাংস থেঁতলে দিতে লাগল পিটিয়ে।

রেনু স্যুটকেস গুছিয়েই রেখেছিলেন। ওষুধপথ্য, পাইপ, তামাক, কাপড়চোপড়, পেস্ট, ব্রাশ, চিরুনি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দরকারি ছোটখাটো যা যা লাগে। রাসেল ভীষণভাবে কাঁদছে। সে বুঝতে পেরেছে, আব্বাকে নিয়ে যাচ্ছে। আব্বা আবার বহুদিন তাদের মধ্যে থাকবে না। সে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, ‘আব্বা যাবে না। আব্বা যাবে না।’

জামাল স্যুটকেস হাতে করে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।

বাইরে সৈন্যদের গাড়িতে আব্বাকে তুলে দিল সে। পাশে রাসেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রেনু।

সৈন্যদের নেতা জামালকে বলল, ‘ইয়াং ম্যান, সরি। তোমাদের পিতাকে তোমাদের মধ্যে থেকে নিয়ে যেতে হচ্ছে।’

জামাল বলল, ‘বিহেভ লাইক আ হিউম্যান, হোয়াই আর ইউ বিহেভিং লাইক অ্যান অ্যানিমাল?’

রেনু জোরে জামালের হাত চেপে ধরলেন। বঙ্গবন্ধু মেজ ছেলের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

হাজি মোরশেদকে পাঁজাকোলা করে আরেকটা গাড়িতে তোলা হলো। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো আম্বিয়ার মা, গৃহপরিচারক রমা, ফরিদ, বাবুর্চি নিয়াজ, আজিজ মিয়াকেও। ফজলুল হক মুন্সি ড্রাইভার, মুনছুর ড্রাইভার বাসার পেছনের দিকে ছিল। গোলাগুলি শুরু হতেই তারা দেয়াল টপকে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সেলিম ওরফে আবদুল গিয়েছিল রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া দেখতে। গোলাগুলি শুরু হলে কলাবাগানের গলিতে ঢুকে একটা দোকানের পেছনে বাউন্ডারি ওয়ালের ফাঁকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

গাড়িতে উঠে রেনুর দিকে তাকিয়ে মুজিব বললেন, ‘আসি।’

রেনু বললেন, ‘এসো। আল্লাহ ভরসা।’

মুজিব চলে গেলেন। দানবের মতো গর্জন করতে করতে চলে গেল মিলিটারি কনভয়। বাড়িতে এখন রেনু, জামাল, রাসেল আর আহত মহিউদ্দীন। জগৎ নীরব। জগৎ যেন মানবশূন্য। অথচ বিকলেবেলাতেও বাড়িটা ছিল সরগরম। সন্ধ্যার পরেও এসেছিল মিছিল। শেখ সাহেবকে একটা টুলে উঠে তাদের উদ্দেশে বলতে হয়েছে ‘জয় বাংলা’।

রেনু, জামাল, রাসেল ঘরে ফিরে এলেন। বাইরের ঘরের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। দেয়াল থেকে খসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের ছবি। ভাঙা কাচের টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। মহিউদ্দীন আর হাজি মোরশেদের সঙ্গে সৈন্যদের ধাক্কাধাক্কি-ধস্তাধস্তিতে জিনিসপত্র সব এলোমেলো।

মহিউদ্দীনকে মেরেছে। সে ব্যথায় কাতর। বাড়িতে আশ্রিত আরও কিছু লোক একজন-দুজন করে ফিরে আসছে। রেনু হতাশ হয়ে বসে আছেন সোফায়। লোকজন কে কোথায় আছে, কেমন আছে, বোঝার চেষ্টা করছেন।

কাঁদতে কাঁদতে রাসেল ঘুমিয়ে পড়ল সোফায়।

রেনুর মনে হলো, হাসুর আব্বাকে নিয়ে গেছে, যাক। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন।

কিন্তু কামাল কোথায় গেল? তিনি বলতে লাগলেন, ‘জামাল, কামাল যে ফিরল না!’

পাশের বাসা থেকে দেয়াল টপকে এলেন ডাক্তার সামাদ খান চৌধুরীর ছেলে বাবু। বললেন, ‘আব্বা নারায়ণগঞ্জ আটকা পড়েছেন। উনি ফোন করে বলে রেখেছিলেন, ‘আপনাদের খোঁজ নিতে। আপনাদের কিছু লাগবে কি না। আপনারা তো এখানে সেফ না। আমাদের বাসায় চলেন।’

রেনু বললেন, ‘দেখতেই পাচ্ছ, সাহেবকে নিয়ে গেছে। আমরা তো আছিই। ঠিক আছে। কিছু লাগলে জানাব।’

বাবু ফিরে গেলেন।

রেনুর মনে হলো, এই বাসায় থাকা ঠিক নয়। এবারকার পরিস্থিতি অন্যবারের মতো নয়। এবার শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। গুলির শব্দ, গোলার শব্দ আসছেই।

তিনি উঠলেন। তাঁদের বাড়িতে আশ্রিত একজন মহিলাকে পাঠালেন পাশের বাড়িতে। সে দেয়াল টপকে গিয়ে ওই বাড়ির খালাম্মাকে ডেকে তুলল। বলল, ‘আম্মা বলছে, আমরা সবাই আপনাগো বাড়িতেই রাতে থাকুম।’

বাবু আর তাঁর ভাইয়েরা মিলে দেয়ালের দুই পাশে চেয়ার আর মোড়া পাতলেন। রেনু, রাসেল, জামাল, মহিউদ্দীন আরও কিছু নারী-পুরুষ-শিশু একে একে পার হলেন দেয়াল। পুরুষেরা একটা ঘরে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুলেন। মহিলারা আরেক ঘরে। রেনু আর রাসেলকে বাবুর মা তাঁর বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন।

রেনু বিছানায় শুয়ে এতক্ষণে উপলব্ধি করতে লাগলেন, ঘটনা কী ঘটে গেল!

হাসুর আব্বাকে তিনিই নিষেধ করেছেন আপস করতে, মানা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। উনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন। এর একটাই মানে—দেশ স্বাধীন হবে, কিন্তু শেখ মুজিব আর ফিরবেন না। শেখ মুজিব হয়তো আর ফিরবেন না, কিন্তু দেশ স্বাধীন হবে।

আর একটা উপায় আছে। দেশের মানুষ লড়াই করবে দেশের জন্য, তারা দেশকে মুক্ত করবে, মুজিবকেও মুক্ত করবে।

কী দাঁড়াল অঙ্কটা?

রেনু অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, তিনি দেখতে পাচ্ছেন তাঁদের ময়না পাখিটা চিৎকার করে বলছে, জয় বাংলা জয় বাংলা জয় বাংলা...তিনি ময়না পাখিটাকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন, রাসেল খিলখিল করে হাসতে লাগল...হাসু প্রেগন্যান্ট, রেহানাই-বা কই, কামাল কই, হাসুর আব্বা কই, জয় বাংলা জয় বাংলা জয় বাংলা...টেলিপ্রিন্টারে টেলেক্সে টরেটক্কায় মেসেজ যাচ্ছে সারা বাংলাদেশে, হয়তো এটা আমার শেষ বার্তা, বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন, ময়না পাখির কণ্ঠ চিরে বেরোচ্ছে রক্তাক্ত জয় বাংলা, মুজিবের কণ্ঠ থেকে টরেটক্কা, টেলিপ্রিন্টার, ট্রান্সমিটার, ওয়্যারলেস, টরেটক্কা, মাইকিং, রেডিও ঘোষণা, ইংল্যান্ডের কাগজ, আমেরিকার পত্রিকা, সিআইএর প্রতিবেদন: শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। প্রতিরোধ করো। লড়াই করো। স্বাধীন করো। শত্রুকে বিতাড়িত করো। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়াও...রাজারবাগ পুড়ছে, পিলখানা জ্বলছে, রাজারবাগ পাল্টা গুলি ছুড়ছে, ছাত্রাবাস ধ্বস্ত, লাশ আর লাশ আর আগুন, বাংলাদেশ স্বাধীন...বাংলাদেশ স্বাধীন...জয় বাংলা...

রেনু জ্ঞান হারালেন। অচেতন ঘোরের মধ্যেও তাঁর বোধিজুড়ে বাজতে লাগল ময়নাপাখির ডাক, স্বাধীনতা, জয় বাংলা, স্বাধীনতা... 

আনিসুল হকের উপন্যাস ‘এখানে থেমো না’ থেকে