মুক্তিযুদ্ধের সময় বেরিয়েছিল যে বইগুলো

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার মাটিতে জন্ম নিল একটি প্রকাশনী—মুক্তধারা। এরপর তারা শুরু করল এক অন্য রকম যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের একটি ছবি, মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ও মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তধারা থেকে বেরোনো কয়েকটি বইয়ের ছবি অবলম্বনে কোলাজ

১৯৭১ সাল। দেশ থেকে পালিয়ে কলকাতা শহরে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে। শিল্পী-কবি-লেখকেরাও আছেন সেই তালিকায়। হঠাৎ একদিন বাংলাদেশের সেই শিল্পী-কবি-লেখকদের নিয়ে কলকাতায় একটি মতবিনিময় সভা হলো। লেখকদের সংগঠিত করে সভাটির আয়োজন করলেন মধ্যবয়সী এক প্রকাশক। সেই সভায় নির্দিষ্ট দিনে শিল্পী-কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘এ বয়সে হয়তো আমার পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই যাঁরা লেখক আছেন, আপনারা লিখুন, চিত্রশিল্পীরা আঁকুন, প্রকাশক হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে সেসব ছাপানো।’

যুদ্ধদিনের বাস্তবতায় লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে সে সময় যিনি এমন সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন, সেই প্রকাশকের নাম চিত্তরঞ্জন সাহা (১ জানুয়ারি ১৯২৭-২৬ ডিসেম্বর ২০০৭)। মুক্তিযুদ্ধই শুধু নয়, বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের ইতিহাসের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে, এর সংগঠন ও বিজয়ে দেশে-বিদেশে এবং দেশের ভেতরে থেকেও কতজন কতভাবে যে অবদান রেখেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, সে এক ভিন্ন ইতিহাস। সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও আত্মত্যাগের ইতিহাস যেমন উজ্জ্বল, তেমনিই সমুজ্জ্বল দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক, গায়ক-গীতিকার, অভিনয়শিল্পী এবং প্রকাশকদেরও।

আদতে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলেছিল নানা ক্ষেত্রে। ‘যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার মানসে অগ্নিগর্ভ সেই সময়ে প্রকাশক-লেখকেরাও এতে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের সপক্ষে বইপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে মুক্তধারা প্রকাশনীর অধিকর্তা চিত্তরঞ্জন সাহার নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই বাংলাদেশের পক্ষে বই প্রকাশের আন্তরিক কর্তব্যবোধ থেকে প্রকাশনী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল মুক্তধারা।

চিত্তরঞ্জন সাহার প্রকাশনা ব্যবসা অবশ্য সেই সময়ই শুরু হয়নি। জীবনের প্রথমভাগে, অর্থাৎ ষাটের দশকে তখনকার নোয়াখালী জেলার ফেনী শহরে তিনি শুরু করেছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পুস্তকের পাঠসহায়ক বা নোট বইয়ের ব্যবসা। তাঁর সেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘পুথিঘর’। ব্যবসাটি ছিল বেশ জমজমাট। একদা মফস্সল শহরে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা, ১৯৬৬ সালে তা তিনি ঢাকায় স্থানান্তর করলেন—প্রথমে ঢাকার পাটুয়াটুলীতে, পরে ১৯৬৭ সালে তা স্থানান্তরিত হলো ৭৪ ফরাশগঞ্জে। এরপর চিত্তরঞ্জন সাহা যখন পুথিঘরকে ‘পুথিঘর প্রাইভেট লিমিটেড’-এ রূপান্তরিত করলেন, তখন তিনি নোটবুক ইত্যাদির পাশাপাশি সৃজনশীল বইও প্রকাশ করতে থাকেন।

এভাবেই কালপঞ্জির পাতায় আবির্ভূত হলো ১৯৭১ সাল। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাতেই ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ৩১ মার্চ সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পরামর্শে ঢাকা ছাড়েন তিনি। এরপর অনেক বিপদৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ৫ মে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম হয়ে রাধানগর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসেন ভারতের আগরতলায়। ১৮ মে আগরতলা থেকে তিনি পা রাখেন কলকাতার মাটিতে।

প্রকাশকদের মধ্যে অনেকেই তখন কলকাতায় গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের কারও তৎপরতা তেমন চোখে পড়েনি। কিন্তু চিত্তরঞ্জন সাহা কলকাতায় পৌঁছেই শতাধিক সাহিত্যিক, শিল্পী ও কবির দেখা পান। অচিরেই জানতে পারেন, তাঁদের বেশির ভাগই দিন যাপন করছেন অর্ধাহার-অনাহারে। অনেকে তখনো আশ্রয়হীন। বেশির ভাগই সময় কাটান রাস্তায়।

চিত্তরঞ্জন সাহা স্মারকগ্রন্থ মারফত মোহাম্মদ আমির হোসেনের একটি লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, এ সময়েই এই শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করেন তিনি। তাঁদের কাছে রাখেন সেই আহ্বান, ‘...আপনারা লিখুন। ...প্রকাশক হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে সেসব ছাপানো।’

বলাবাহুল্য, এ ঘটনার পরপরই কলকাতার মাটিতে জন্ম হলো ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনীর। ব্র্যাকেট বা বন্ধনীতে লেখা থাকত ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’।

মুক্তধারা প্রকাশনী জন্ম নিল ১৯৭১ সালের ২৮ মে পার্ক সার্কাসের ৪ নম্বর পাস অ্যাভিনিউতে। সেদিন এ উপলক্ষে যে সভা ডাকা হয়েছিল, তাতে ছিল বাংলাদেশের শিল্পী-কবি-লেখকদের বিপুল উপস্থিতি—কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, লেখক আবু সায়ীদ, আবদুল হাফিজ, আহমদ ছফা, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, সুব্রত বড়ুয়া, আসাদ চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, মুস্তাফা মনোয়ার, খালেদ চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু, আশীষ চৌধুরী, কবি মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণসহ নবীন-প্রবীণের মিলনমেলায় এখানে এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে আগুয়ান হয়েছিলেন সবাই।

জানা যায়, মূলত রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেনের প্রেরণাতেই চিত্তরঞ্জন সাহা সেদিন এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তবে বলা দরকার, ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ তথা মুক্তধারা গড়ে তুলতে এমন সব সভা-সমাবেশ আয়োজনে বেশ কিছু ব্যক্তির আবাসস্থল ও ডেরার কথাও ভোলার নয়। এর মধ্যে আছে সৈয়দ আলী আহসানের অস্থায়ী বাসভবন, ব্যারিস্টার আবদুস সালামের ৯ অ্যান্টনি বাগান লেনের স্থায়ী বাসভবন প্রভৃতি।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ভাষ্যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘কলকাতায় প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রথমেই “মুক্তধারা”র কথা উল্লেখ করতে হয়। কারণ, সারবস্তু আছে এমন সব বই মুক্তধারাই প্রকাশ করেছিল। এর মালিক ছিলেন বাংলাদেশের এবং নিজ দেশ সম্পর্কে তিনি জানতেন।’

‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতি–প্রকৃতি বুঝতে হলে বাংলাদেশের লেখকদের বই পড়ুন’—এই স্লোগান ধারণ করে একাত্তরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত মুক্তধারা প্রকাশ করেছিল মোট ৩৩টি বই। জুলাই মাসে ৫টি, আগস্টে ৪টি, সেপ্টেম্বরে ৩টি, অক্টোবরে ১টি, নভেম্বরে ৩টি ও ডিসেম্বরে ১৬টি। এসবের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যথার্থতা সঠিকভাবে তুলে ধরার মানসে যে বইগুলো প্রকাশ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে একটি লেখক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বইয়ের নাম তিনমাসের দিনলিপি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত আরেকটি বই হলো বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিকদের লেখা ১৬টি ছোটগল্পের সংকলন বাংলাদেশ কথা কয়। মূলত এই ১৬টি গল্পের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের যে নিপীড়ন, তা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। আর কবিতার সংকলনটি হলো আবদুল হাফিজ সম্পাদিত রক্তাক্ত মানচিত্র। এখানে বাংলাদেশের প্রবীণ ও নবীন কবিদের কবিতা ছিল। উপরন্তু বইটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে এই কবিতাগুলোকে নির্বাচন করা হয়েছিল মোট ছয়টি বিষয়কে কেন্দ্র করে, ছয়টি শিরোনাম যুক্ত করে। শিরোনামগুলো হলো—‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘বাংলাভাষা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘ঊনসত্তরের বাংলাদেশ’, ‘এপার বাঙলা ওপার বাঙলা’এবং ‘বিদ্রূপ, ঘৃণা, ক্রোধ, হরতাল, মিছিল, মৃত্যু ও সংগ্রাম’।

বলা দরকার, রক্তাক্ত মানচিত্র বইটি পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। আর অন্য বইগুলো ছিল—আবু সায়ীদের বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ, আহমদ ছফার জাগ্রত বাংলাদেশ, ধনঞ্জয় দাশের আমার জন্মভূমি স্মৃতিময় বাংলাদেশ, যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সম্পাদিত গ্রন্থ রক্তাক্ত বাংলা (সম্পাদক ছিলেন আনিসুজ্জামান। আর মুখবন্ধ লিখেছেন এ আর মল্লিক), সত্যেন সেনের প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ এবং সরলানন্দ সেনের ঢাকার চিঠি। এই বইগুলো ছাড়া আর যেসব বই বের হয়েছিল, সেগুলো ছিল পুনর্মুদ্রণ।

চিত্তরঞ্জন সাহা কেন কলকাতায় গিয়ে মুক্তধারার মতো একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে তার বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে জানবার ও বুঝবার জন্যে তাই একান্ত প্রয়োজন এর সাহিত্যের সঙ্গে একাত্মতার। ওপার বাংলার সঙ্গে এপার বাংলার সমঝোতাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা সাধ্যমতো বাংলাদেশের সমস্ত ধরনের প্রগতিশীল লেখা প্রকাশে ব্রতী হয়েছি। কারণ, বাংলাদেশ আন্দোলন ও প্রতিরোধের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্যে।’ এ সংকলনে প্রবন্ধ লিখেছিলেন এ আর মল্লিক, সত্যেন সেন, জহির রায়হান, রণেশ দাশগুপ্ত, অনুপম সেন, আনিসুজ্জামান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, জাফর সাদেক, আবদুল হাফিজ ও রঞ্জন ছদ্মনামে লিখেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা নিজে।

এ ছাড়া একাত্তরের যুদ্ধদিনে পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রকাশকও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন লেখকের বই প্রকাশ করেছিলেন। এই লেখকদের মধ্যে ছিলেন আবুবকর সিদ্দিক, গাজীউল হক, বেদুইন, মেসবাহ আহমেদ, হাসান মুরশিদ (গোলাম মুরশিদ), শামসুর রাহমান, বদরুদ্দীন উমর, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ।

আবার সে সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের কবি-লেখক-ঔপন্যাসিকেরাও কম লেখেননি। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মনোজ বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সোমেন পাল, কৃত্তিবাস ওঝা, যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ চৌধুরীসহ অনেকেই।

একাত্তরের রক্তাক্ত প্রহরে লেখালেখির মধ্য দিয়ে যে যোদ্ধারা তখন যুদ্ধ করছিলেন, তাঁদের সংগঠিত এবং তাঁদের বই প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন সাহা ছিলের সেই যুদ্ধের অগ্রনায়ক। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে এই মনীষীর নাম।