বিশ্বজুড়ে কেন বাড়ছে স্মৃতিকথার বিকিকিনি

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী স্মৃতিকথার বিক্রি বাড়ছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী স্মৃতিকথার বিক্রি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। তবে একজন লেখকের স্মৃতিকথায় সত্য ও কল্পকাহিনির মধ্যে ভেদরেখাটি কোথায় আঁকা উচিত? অন্তর্জাল ঘেঁটে তার সুলুক সন্ধান করেছেন হাসান ইমাম

মিশেল ওবামার বিকামিং, প্রিন্স হ্যারির স্পেয়ার, জো বাইডেনের প্রোমিজ মি, ড্যাড ও এবেন আলেক্সান্দারের প্রুফ অব হ্যাভেন: আ নিউরোসার্জন’স জার্নি ইনটু দ্য আফটারলাইফ—এসব স্মৃতিকথামূলক বই অবলম্বনে
কোলাজ: অন্য আলো

স্মৃতিকথা কী? স্মৃতিকে কথায় প্রকাশ করা?

কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘থমথমে রাত,—আমার পাশে বসল অতিথি,—/বললে,—আমি অতীত ক্ষুধা,—তোমার অতীত স্মৃতি!’কে অস্বীকার করবে, স্মৃতি তথা অতীতেই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের বর্তমান। খেলনা যেমন প্রিয় সঙ্গী শিশুর, বয়সীদের তেমনই স্মৃতি। কিন্তু সব স্মৃতিই কি আমরা প্রকাশ্যে আনতে পারি, নাকি আনা যায়! তাহলে যে ফি বছর এত এত মানুষের স্মৃতিকথা বই আকারে বের হচ্ছে, তা কি শুধুই সুখস্মৃতির সমাহার? প্রশ্নটা যত সহজে তোলা গেল, উত্তর এতটা সরল নয়।

তবে এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, আত্মজৈবনিক লেখা বা স্মৃতিকথা সাহিত্যের জনপ্রিয় একটি ধারা। দিনকে দিন পাঠকসমাজে এর কদর বাড়ছে, ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে এর বেচাবিক্রিও। কবিতা, গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি পাঠকের বইয়ের তাকে এখন জায়গা করে নিচ্ছে স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী। হঠাৎ স্মৃতিকথার বিকিকিনি বৃদ্ধির কারণ কী?

শিশু বয়সে ডালিম কুমার-জলপরি থেকে রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। এরপর একটু বড়বেলায়, স্কুলে যাওয়ার বয়সে মা-বাবাসহ গুরুজন ও শিক্ষকেরা নানা অসিলায় বড় বড় মানুষের জীবনীর চুম্বক অংশ শোনাতেন। সেসব ছিল মূলত শিক্ষামূলক, যা অনুকরণ করা যায়; যাতে পরোপকারের মানসিকতা পোক্ত হয়, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ে। শিশুমন যেন ভরে যায় ভালোবাসায়, বড় কিছু করার তাগিদ অনুভব করে, সে জন্য মনীষীদের আত্মজীবনী পড়ার উপদেশ দেওয়া হতো। কে না জানে, বৈরী সময় পেছনে ফেলে কারও এগিয়ে যাওয়ার গল্প হয়ে ওঠে অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা। তবে দিন বদলেছে, এখন মনীষীদের জায়গা ‘দখল’ করে নিয়েছেন সেলিব্রিটিরা।

প্রিন্স হ্যারির স্মৃতিকথা স্পেয়ার-এর কথাই ধরা যাক। বইটি গত জানুয়ারিতে প্রকাশের পর মাত্র কয়েক দিনেই প্রায় ১৫ লাখ কপি বিক্রি হয়ে গেল। অবশ্য এই রেকর্ড বিক্রির পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে নেটফ্লিক্সে প্রচারিত একটি বিতর্কিত ওয়েব সিরিজ। তবে ব্রিটিশ রাজপরিবার নিয়ে মানুষের ঔৎসুক্য কম নয় মোটেও। হ্যারি যেভাবে তাঁর স্মৃতিকথায় কিছু ‘গোপনীয়তা’ প্রকাশ করেছেন, তাঁর মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর প্রভাব নিয়ে যেভাবে অকপটে আলাপ তুলেছেন, পাঠককে আকৃষ্ট করার পক্ষে এগুলোই যথেষ্ট। ১৯৯২ সালে লেখা হয়েছিল ডায়না: হার ট্রু স্টোরি। অ্যান্ড্রু মর্টনের লেখা সেই জীবনী নাড়া দিয়েছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভিতে। সেই একই অস্ত্র যেন আরেক দফায় শান দিলেন হ্যারি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মহৎ কোনো ভাবনার উদ্রেক করে, জীবনের দিশা সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করে—মলাটবন্দী এমন সত্যের প্রতিফলনের চেয়ে ‘কেচ্ছা’ই বরং বেশি বিকোয়।

অথচ স্মৃতিকথায় কি না থাকতে পারে—ধর্মবিশ্বাস থেকে যৌনতা, রাজনীতি, যুদ্ধ, শোক, অর্জন—সবই। কারও জীবনসংগ্রাম, নির্দিষ্ট এক সময়কালে তাঁর উপলব্ধি, আত্মত্যাগ বা বিশেষ কোনো বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি গোপনীয়তাও জায়গা করে নিতে পারে স্মৃতিকথায়। জীবনের ড্রয়িংরুম থেকে যাপনের খোলা ময়দান—সবকিছুই হতে পারে স্মৃতিকথার বিষয়বস্তু।

মহৎ কোনো ভাবনার উদ্রেক করে, জীবনের দিশা সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করে—মলাটবন্দী এমন সত্যের প্রতিফলনের চেয়ে ‘কেচ্ছা’ই বরং বেশি বিকোয়।

কিন্তু নানা জরিপে দেখা যায়, সাধারণত তিন ধরনের স্মৃতিকথা বেশি বিক্রি হয়। এক্ষণে আর কারও বুঝতে বাকি নেই যে নানা ক্ষেত্র ও খাতে তারকা বনে যাওয়া ব্যক্তিদের, অর্থাৎ সেলিব্রিটিদের স্মৃতিকথাই এখন রয়েছে বিক্রির শীর্ষে। এরপর রয়েছে দুঃসহ অতীত বা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসার গল্প—মোটাদাগে কারও ‘জয়গাথা’এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে উপন্যাসের আদলে লেখা স্মৃতিকথা।

মিশেল ওবামার বিকামিং যেভাবে মানুষ হুমড়ি খেয়ে কিনেছে, কিংবা জো বাইডেনের লেখা প্রোমিজ মি, ড্যাড: আ ইয়ার অব হোপ, হার্ডশিপ অ্যান্ড পারপোজ যেভাবে মুড়িমুড়কির মতো বিকিয়েছে, তার প্রধান কারণ লেখকদের ব্যক্তিপরিচয়। আবার এবেন আলেক্সান্দারের লেখা প্রুফ অব হ্যাভেন: আ নিউরোসার্জন’স জার্নি ইনটু দ্য আফটারলাইফ-এর বিক্রির সংখ্যাও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। স্মৃতিকথাটির নামই বলে দেয়, এতে রয়েছে জীবনযুদ্ধের গল্প। ২০০৮ সালে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর কোমায় চলে গিয়েছিলেন এবেন আলেক্সান্দার। মৃত্যুর কাছাকাছি সেই অবস্থান থেকে ফিরে আসার গল্পই বিবৃত হয়েছে বইটিতে। আর টারা ওয়েস্টওভারের এডুকেটেড উপন্যাসের গুণে ভরপুর স্মৃতিকথার অন্যতম সেরা উদাহরণ।

ওয়ার্ল্ডসরেটেড-এর জরিপ বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী স্মৃতিকথার বিক্রি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। বলা বাহুল্য, মানুষের পাঠাভ্যাস বাড়ছে, লাভবান হচ্ছেন লেখক-প্রকাশকও। পরিসর বাড়ছে ঘোস্টরাইটার বা আড়ালচারী লেখকদের কাজের; তাঁদের প্রতিষ্ঠা পাওয়াও সহজ হচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, যখন আপনার স্মৃতিকথার সঙ্গে সত্যের মিলমিশ সেভাবে ঘটে না, তখন কীভাবে জীবনের গল্প লিখতে পারেন আপনি? অতিরঞ্জন ও মিথ্যা বলার অভিযোগ উঠেছিল জেমস ফ্রেকের বিরুদ্ধে। ২০০৩ সালে প্রকাশিত আ মিলিয়ন লিটল পিসেস নামের তাঁর স্মৃতিকথাকে পরবর্তী সময়ে সেমি-ফিকশনাল বলা হয়। বইটির কাহিনি নিয়ে ২০১৮ সালে একই নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।

ওই ঘটনার পর কোনো লেখকের স্মৃতিকথায় সত্য ও কল্পকাহিনির মধ্যে ভেদরেখাটি কোথায় আঁকা উচিত, তা নিয়ে আরেক দফায় বিস্তৃত হয়েছিল আলোচনা। পরে নানা সময়েও সেই আলোচনা সজীব হয়েছে।

হিলারি মান্টেল তাঁর স্মৃতিকথা গিভিং আপ দ্য ঘোস্ট সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি মনে করতাম যে আত্মজীবনী একধরনের দুর্বলতা, এবং সম্ভবত আমি এখনো তা-ই মনে করি। কিন্তু আমি এটাও মনে করি, আপনার যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, তাহলে শক্তিমত্তা দেখানোর ভান করাটাও শিশুসুলভ।’

ম্যান বুকারজয়ী এই ঔপন্যাসিক শেষ পর্যন্ত ‘ভানমুক্ত’ স্মৃতিকথার পক্ষেই সওয়াল করেছেন।