শামসুর রাহমানের কবিতা: ‘সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ’

২৩ অক্টোবর বাংলা ভাষার অন্যতম কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। তাঁর কাব্যজগতে বিপ্লবী বাঙালিত্বের প্রকাশ যেমন আছে, তেমনি তিনি লিখেছেন অন্য স্বরের কবিতাও। কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর কবিতাপ্রাঙ্গণের বর্ণিল বিভায় ফিরে তাকিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের এক কবি।

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬)ছবি: প্রথম আলো

স্মৃতি থেকে ঘুরে আসা যাক। ছোট্ট মফস্​সল শহর। হারিকেন আর কুপিবাতি জ্বলা সেই শহরের কোণে ছোট্ট একটা পাঠাগার। পাঠাগারের সবচেয়ে পুরোনো দুটি আলমারির তাকে শীর্ণ সব বইয়ের সারি—সব কটি বই কবিতার। মলিন প্রচ্ছদ, পোকায় কাটা পাতা। অধিকাংশ বই পাঠকের স্পর্শবিহীন। লাজুক মুখ করে কেউ কেউ আলমারি খুলে বসেন। যাঁরা বসেন, তাঁদের বেশির ভাগই মূলত কবিযশোপ্রার্থী। নবীন কবি দলের সদস্য হিসেবে আমরাও গিয়ে বসতাম কালো সেই আলমারি দুটির সামনে। থরে থরে সাজানো বইয়ের ভান্ডারে ছিল শামসুর রাহমানের প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটীতে, নিজ বাসভূমে, বন্দী শিবির থেকে, ইকারুসের আকাশসহ আরও অনেক কবিতার বই।

একবার একটা বইয়ের নাম দেখে খুব হেসে উঠেছিলাম—টেবিলের আপেলগুলো হেসে ওঠে। তখনো গদ্যকবিতা চোখ ও মন সওয়া হয়ে ওঠেনি; মনের মধ্যেই দোনোমনা ভাব। নাম দেখে তাই মুচকি হেসেছিলাম—শামসুর রাহমানের কবিতায় আপেল কী করে হাসে? ভবিষ্যতে কবিতার পথ মাড়াব এমন কোনো জোরদার ইচ্ছাও তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। কিন্তু যখন কবিতার ঘুণপোকা আমাদের কল্পনা ও অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিল, তখন পরম হৃদয় দিয়ে আমরা একে একে পড়ে ফেললাম আল মাহমুদের সোনালী কাবিন, সৈয়দ শামসুল হকের পরানের গহীন ভিতর, নির্মলেন্দু গুণের প্রেমাংশুর রক্ত চাই, আবুল হাসানের পৃথক পালঙ্ক, আবিদ আজাদের ঘাসের ঘটনা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ছোবল—বাংলাদেশের আরও কত কবিতার বই! কবিতার বইয়ের তাকে সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করত শামসুর রাহমানের বই।

মনে মনে ভাবতাম, অনেক বড় কবি, তাঁকে পড়া দরকার। দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী আর বিশেষ সংখ্যা খুললেই তাঁকে পাই। দেখা যেত, প্রথম কবিতাটিই শামসুর রাহমানের। কিন্তু কীভাবে পড়ব তাঁকে? সব তো বুঝে উঠতে পারি না। অনেক কথাই থেকে যায় অধরা মাধুরীর মতো। উপমা, প্রতীক আর চিত্রকল্পের ধাঁধাগুলো ভেঙে ঢুকতে পারি না কবিতার প্রাণভোমরায়। ভাবি, আহা, কবিতার কী অদ্ভুত নাম—‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’! ল্যাজারুসের মতো পুনর্জীবন পেয়ে অচেনা গলায় কে যেন বলে ওঠে, ‘এই সেই পৃথিবী সাবেকি?’ প্রায় তিন দশক আগের বইপুস্তকহীন মফস্​সলীয় পরিসরে আমরা জানব কী করে, কে সেই ল্যাজারুস? তার মতো করে কবি কেন বলেন, ‘সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ।’

আমরা তখন কৈশোরের শেষ সীমানায়; মৃত্যু, বিষাদ ও বিচ্ছেদ আমাদের জন্য মর্মান্তিক ঘটনা। শামসুর রাহমানের কবিতা পড়তে পড়তে আমরা ঢুকে গেলাম সেই বিচ্ছেদ-বিষাদের ভেতর। চেনা দুঃখকে আরও যেন গভীরভাবে চিনতে পারলাম। কারণ, শ্রেণিকাঠামোর বিচারে আমাদের জীবনের চার দেয়ালও ছিল মধ্যবিত্তের। শামসুর রাহমানের মতো করে বারান্দায় অথবা ঘরের চৌকাঠে আমরাও দেখতে পেলাম দুঃখের স্বাক্ষর, ‘দুঃখ তার লেখে নাম’। আর তারই পুনরাবৃত্তি দেখতে পেলাম যার যার অন্তর্গত জীবনে। শামসুর রাহমান যাকে বলেছেন ‘মধ্যবিত্তের পাঁচালি’, আমরাও সেই পাঁচালির ছোটখাটো অংশ।

প্রকৃতপক্ষে আধুনিক কবিতার খোঁজে নেমে প্রথমেই হাতে পেয়েছিলাম শামসুর রাহমানের কবিতার বই। সেই সূত্রে পরিচিত হতে পেরেছিলাম আধুনিকতাবাদী কবিতার সঙ্গে। আর সে সময় আমাদের ভেতর চলছিল আধুনিকতাবিষয়ক বাহাস। আধুনিকতা কী? আধুনিকতাবাদের সঙ্গে কী সম্পর্ক নাগরিকতার? গ্রামীণ হলে কি আধুনিক বলা যাবে? শামসুর রাহমান যদি আধুনিক হয়েই থাকেন, আল মাহমুদের কবিতাকে কীভাবে ভাবব? আল মাহমুদ তো আসন গেড়ে বসে আছেন শামসুর রাহমানের প্রায় উল্টো দিকে—গ্রামীণ সংস্কৃতিতে। গ্রাম আর শহরের মধ্যবিন্দুতে বাস করি বলে হয়তো দুজনের কবিতাই আমাদের ভালো লাগত। আধুনিক কবিতার ভাব ও ভাষাকে বুঝতে চাইতাম প্রধানত এই দুজনের মানদণ্ডে।

মনে পড়ে, কড়ায়-গন্ডায় আমরা মেপে দেখতাম শামসুর রাহমানের ছন্দ। নবীন কবিরা যেমন করে ছন্দ শেখে, তেমন করে ছন্দের বই হাতড়ে মিলিয়ে দেখেছিলাম শামসুর রাহমানের কবিতার ছন্দকে। কী চমৎকারভাবে তিনি মিলিয়ে ফেলেছেন ১০ ও ৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। ৭ ও ৫ মাত্রার ছকে লেখা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে যে স্বরবৃত্তের চটুলতা মিশে যেতে পারে, তার নজির পেলাম ‘কবর-খোঁড়ার গান’ কবিতায়। বিস্মিত হয়েছিলাম ‘রুপালি স্নান’ কবিতা পড়ে। ৬ মাত্রায় অসম পার্বিক মাত্রাবৃত্তে লেখা কবিতাটি চমকে দিয়েছিল। একদিকে আছে তার ছন্দের দুলুনি, অন্যদিকে আছে ভাষার কারুকাজ। একটি খরগোশ একটু আগে যে ঘাসে শুয়েছিল তার উত্তাপ মনে রেখে শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘এখনও যে শুই/ ভীরু-খরগোশ-ব্যবহৃত ঘাসে’। ‘ভীরু-খরগোশ-ব্যবহৃত’—তিনটি শব্দের সমবায়ে গড়া একটি বিশেষণ নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।

কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলোতে কীভাবে যেন আমাদের শ্রুতির কাছে গড়িয়ে এসেছিল জীবনানন্দ দাশের কথাটা, ‘উপমাই কবিত্ব’। শামসুর রাহমান যেন ঠিক এ পথেই হেঁটেছেন। উপমার সম্ভারে ভরে উঠেছে তাঁর কবিতা। বুদ্ধি ও কল্পনার অভাবিত মিশ্রণে তিনি উপহার দিয়েছেন মনোহর সব চিত্রকল্প। আর আন্তরিকভাবে কাছে টেনেছিল তাঁর কবিতার ভাষা। চলতি কথার বুলি, গালি ও বাক্​ভঙ্গি ঘুচিয়ে দিয়েছিল ভাষার দূরত্ব। মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম তাঁর ‘মাতোয়ালা এই রাইত’, ‘হালায় আইজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের/ লগে দোস্তি আমার পুরানা...।’

আমরা খেয়াল করলাম, শামসুর রাহমান হেঁটেছেন কবিতার বিচিত্র পথে। ‘বাংলা কবিতার প্রতি’, ‘খেলনার দোকানের সামনে ভিখিরি’র মতো কবিতা লিখেছেন, আবার লিখেছেন মাতাল ঋত্বিক-এর মতো সনেট সংকলন। সংহত পদ্যের পাশে তিনিই লিখেছেন টানা গদ্যের কবিতা। টানা গদ্যে লেখা কোনো কোনো কবিতার নাম দিয়েছেন ‘গদ্যসনেট’। তাঁর অনেক কবিতার গায়ে লেগে থাকত গল্পের আভাস।

গল্প বলতে গিয়ে শামসুর রাহমান দৃশ্যচিত্রের মতো সূক্ষ্ম বিবরণ তৈরি করেছেন। যে জীবন তিনি যাপন করছেন, চোখের সামনে নড়েচড়ে উঠছে যে বাস্তববিশ্ব, তিনি সেই প্রত্যক্ষ জীবনকে একমুহূর্তে এঁকে ফেলেছেন। কবিতার ভেতর দুলে ওঠে তাঁর নিজের জীবনের ছায়া-সাংবাদিকতা, শিল্প-সাহিত্যের জমিন, দেশকালের কোলাহল, ঘরোয়া জীবন। আমাদের কাছে অমোঘ উচ্চারণের মতো লেগেছে তাঁর এই চরণ, ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।’ আমরা কি এভাবে তাকিয়েছি মায়ের দিকে?

আমাদের মতো কবিযশোপ্রার্থীর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল শামসুর রাহমানের গুপ্ত ও প্রকাশ্য ‘আমি’; দেখতে চেয়েছিলাম কীভাবে তিনি কবির ‘আমি’র সঙ্গে খেলেন। শিল্পের বড় একটি কাজ জগৎ-সংসারে আমার ‘আমি’কে চিহ্নিত করা। দেখতে পাই, শামসুর রাহমান বহুভাবে নিজেকে শনাক্ত করেছেন রূপান্তরশীল স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে। কখনো তিনি শৈশবের বাতিওয়ালা, কখনো জনৈক সহিসের ছেলে, কখনোবা তিনি ইকারুস; তিনি ছুঁয়ে দেখেন ডেডেলাস, ইলেকট্রা কিংবা চাঁদ সওদাগরের মন।

শামসুর রাহমান পড়তে গিয়ে জিজ্ঞাসা জাগে, পরিবর্তমান সময়ে কবির ভূমিকা কী? মনের ভেতর থেকে জবাব পাই, ওই সময়-পরিধিতে নিজের চিহ্ন খুঁজে ফেরা, নিজের ‘হয়ে ওঠা’র ইতিহাসকে খুঁজে ফেরা। অন্য অনেক কবির মতো শামসুর রাহমানও নিজেকে খুঁজেছেন ও উপস্থাপন করেছেন, কবিতায় প্রতিস্থাপিত করেছেন অন্যের জীবন।

কেউ কেউ সংশয়ের সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন, একালে সব কবি মিলে একই ভাষায় একটি কবিতাই লিখে যাচ্ছেন কি না। প্রশ্নকারীরা সম্ভবত বলতে চান, স্থান ও কালের পাটাতনে কবির সত্তাগত অবস্থান কোথায়? হয়তো এই প্রশ্নও তাঁরা ঊহ্য রাখেন, এ কালের কবিতায় কবিব্যক্তিত্ব ঘোরতরভাবে অনুপস্থিত কেন? কবিতায় সময়ের চিহ্ন কেন ক্রমশ ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যাচ্ছে? প্রতীক ও রূপকের আড়ালে, ভাষার আচ্ছন্নতায় ‘আমি’ কি হারিয়ে গেছে? এসব প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই কবিরা জানেন।

আমাদের সৌভাগ্য শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রশ্নগুলোর জবাব মেলে। আর তাই নতুন কবি ও কবিতার জন্য কবির সত্তাগত অবস্থান খুঁজে পাওয়ার দার্শনিক ইশারা মিলতে পারে শামসুর রাহমানের কবিতায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, শামসুর রাহমানের কবিতাকে আমরা প্রধানত মাপতে শিখেছি জাতীয়তাবাদী সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে।

এই একমুখী তত্ত্বঘোর রাজনীতির পক্ষে যেমন মারাত্মক, কবিতার জন্যও তেমন ক্ষতিকর। শামসুর রাহমান হোন, আর আল মাহমুদই হোন—তাঁরা মূলত কবিতাই লিখতে চেয়েছেন। তাঁদের কবিতার শিল্পকৃতি স্বীকার করে নিয়েই প্রবেশ করা যায় অন্য আলাপে, হোক তা প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতা, রাজনীতি কিংবা ভাবাদর্শের বিরোধ।

আপাতত এটুকু আশা করা যাক, ভবিষ্যতের কবিরা নিশ্চয়ই এসব সংঘাত উজিয়ে পৌঁছে যাবেন অন্যতর উপলব্ধিতে, কবি হিসেবে নিজের ভূমিকাটিকেও জানান দেবেন কবিতায়। শামসুর রাহমানের কবিতা এ ক্ষেত্রে হতে পারে নিশ্চিত সহায়ক।