গোপনীয়তার মালিকানা

আমি এখন যে বইগুলো পড়ি, সেসবের অনেকটা অংশজুড়ে আছে আত্মজীবনী, ডায়েরি, স্মৃতিগদ্য বা ভ্রমণগদ্য। অবশ্য সেগুলো সুলিখিত হওয়ার একটা শর্ত থাকেই। পাঠযোগ্য না হলে কেই–বা অত কষ্ট করে বই পড়তে যায়? পড়ার ধরন সব সময় এক রকম থাকে না। একসময় প্রচুর গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়েছি, এখনো পড়ি, তবে সংখ্যার দিক থেকে কম। তা আত্মজীবনী-ডায়েরি-স্মৃতিগদ্য ধরনের বইগুলোতে কী পাই যে তা আমার পাঠতালিকায় এতখানি জায়গাজুড়ে রয়েছে? পাই ব্যক্তিকে, তার সময়কে, সেই সময়ের জীবন ও সমাজকে, যার সঙ্গে হয়তো আমার পরিচয়ই নেই। একটা দীর্ঘ সময়ের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজব্যবস্থা আর ব্যক্তিজীবন মিলেমিশে থাকে এই বইগুলোতে এবং সেসব বর্ণিত হয় অন্তরঙ্গ ভাষায়, বৈঠকি ঢঙে—পড়তে ভালো লাগে। পড়তে গিয়ে কি অস্বস্তিও হয় না কখনো কখনো? হ্যাঁ, হয়। পাঠকের স্বস্তি উৎপাদন করার দায় অবশ্য লেখকের নেই, কোনো কোনো লেখক দুর্বিষহ জীবনের ছবি এঁকে পরিকল্পিতভাবেই অস্বস্তি তৈরি করতে চান। এ সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের যে দুর্বহ-দুর্যোগপূর্ণ জীবন উপহার দেয়, তার সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা তো অস্বস্তি তৈরি করবেই। কিন্তু আমি গল্প-উপন্যাসে বর্ণিত অস্বস্তির কথা বলছি না, বলছি অন্য ধরনের অস্বস্তির কথা। কী রকম?

ধরা যাক ডায়েরির কথা। আমি নিজে ডায়েরি লিখি না, কিন্তু লেখকদের মৃত্যুর পর যেসব ডায়েরি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, সেগুলো পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি, আদৌ এই ডায়েরিগুলো প্রকাশিত হওয়া উচিত হয়েছে কি না! নিজের গহন-গোপন যে কথাগুলো কাউকে কোনো দিন বলতে না পেরে একজন লেখক একান্ত নিভৃত মুহূর্তে লিখে রেখেছেন ডায়েরিতে, মৃত্যুর পর সেগুলো প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? তাঁর গোপনীয়তার অধিকার কি তাতে ব্যাহত হচ্ছে না? একেকবার মনে হয়, কাজটি অনৈতিক। একজন মানুষের একান্ত গোপন-ব্যক্তিগত জগৎকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কোনো অধিকার কেউ রাখেন না।

আবার মনে হয়, মৃত্যুর পর আর গোপনীয়তার প্রয়োজন কী? এই সমস্ত নৈতিকতা, গোপনীয়তা, ভালো-মন্দের বিচার তো শুধু পৃথিবীর মানুষের নিজস্ব নির্মাণ। মৃত্যুর ওপারে এসবের কার্যকারিতা কী? না, নেই; মৃতদের কিছু যায়-আসে না এতে কিংবা যায়-আসে কি না, আমরা তা জানতে পারি না, পারব না কোনো দিন। কিন্তু এ তো গেল একটি দিক। একজন লেখকের মৃত্যুর পর তাঁর স্বজনেরা তাঁর ডায়েরির প্রকাশ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন কিংবা কতটুকু প্রকাশ করবেন আর কতটুকু গোপন রাখবেন, প্রকাশের ফলে ওই লেখকের গোপনীয়তার লঙ্ঘন হবে কি না—এসব প্রশ্ন আমরা দূরে সরিয়েও রাখতে পারি এই যুক্তিতে যে মৃতের কোনো গোপনীয় জগৎ নেই। কিন্তু ওই লেখকের সঙ্গে যাঁরা সম্পর্কিত, যাঁরা এখনো মৃত্যুবরণ করেননি, তাঁদের গোপনীয়তার বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত কী হবে? বলার অপেক্ষা রাখে না, ডায়েরিতে একজন মানুষ কেবল নিজের কথাই লেখেন না, লেখেন তাঁর চারপাশের মানুষ সম্পর্কেও। তাঁরা তো সবাই মৃত নন! তাঁদের সামাজিক জীবনও তো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এসব অতি গোপন কথাবার্তা প্রকাশের ফলে! কথাটি আমার প্রথম মনে হয়েছিল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি পড়তে গিয়ে। অসামান্য সব লেখা রয়েছে সেই ডায়েরিতে, পড়তে গিয়ে মনে হয়—আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি সেই আয়নায়। আবার আছে কিছু মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অতি গোপন কিছু কথা, যা ওই মানুষগুলোকে নিঃসন্দেহে বিব্রত করবে, তাঁদের সামাজিক জীবন অবধারিতভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। অস্বস্তি লাগে না এসব পড়তে? আমার তো লাগে।

একজন লেখক কী লিখবেন না লিখবেন তা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। তিনি অবশ্যই স্বাধীন, শতভাগ স্বাধীন। তিনি যা ইচ্ছা তা–ই লিখতে পারেন। কিন্তু যা ইচ্ছা তা–ই কি প্রকাশ করতে পারেন? পাঠক হিসেবে আমরা কি তা অনুমোদন করতে পারি? অবশ্য পাঠক অনুমোদন করলেই কী আর না করলেই কী, কী যায় আসে তাতে? আচ্ছা, অনুমোদন করা না–করার প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি, ওই গোপনীয়তার বিষয় নিয়েই নাহয় আরেকটু কথা বলা যাক।

দুজন মানুষ যখন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হন, তখন তাঁদের সম্পর্কের ভেতরে অনেক গোপন অধ্যায় রচিত হয়। সঞ্চিত হয় প্রচুর একান্ত স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা। সেসব গোপনীয়তার মালিকানা আসলে কার? যেকোনো একজনের নাকি যৌথভাবে দুজনেরই? অবশ্যই দুজনের। গভীর বিশ্বাস ও আস্থার ভেতর দিয়ে রচিত হয় এই যৌথ গোপনীয়তা। কোনো একজনের, অধিকার নেই অন্যজনের অনুমোদন ছাড়া সেই যৌথ গোপনীয়তাকে প্রকাশ করার বা নগ্নভাবে বলতে গেলে বিক্রি করার। এমনকি সেই সঙ্গী প্রাক্তন হয়ে গেলেও। অথচ এ রকম আমরা ঘটতে দেখি। ডায়েরিতে যেমন, আত্মজীবনী বা স্মৃতিগদ্যেও তেমন। সেটিকে আবার আখ্যায়িত করা হয় ‘সাহস’ কিংবা ‘স্মার্টনেস’ হিসেবে। কিন্তু এখানে সাহস বা স্মার্টনেসের কোনো ব্যাপারই নেই, যা আছে তা হলো বিশ্বাস ও আস্থার অমর্যাদা। সমস্যা হলো, এ ধরনের লেখাগুলোতে কেবল সঙ্গীর গোপনীয়তাই ভঙ্গ করা হয় না, একই সঙ্গে সেই সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কিত আরও বহু মানুষের (তাঁর পরিবারের লোকজন বা বন্ধুবান্ধব) ব্যক্তিগত জীবনকে প্রকাশ্যে আনা হয়, যদিও তাঁরা কোনোভাবেই এই পুরো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। এটা অনৈতিক নয়? দোষের নয়? একে সাহস বলে? এটাই স্মার্টনেস?

গোপনীয়তার কথা যখন ওঠে, তখন প্রথমেই নারী-পুরুষের একান্ত সম্পর্কের কথা মনে আসে আমাদের। কিন্তু এ কেবল নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিষয়ই নয়, যেকোনো সম্পর্কের ভেতরে কিছু গোপনীয়তা থাকে। ধরুন, আপনি আমার বন্ধু—অন্তরঙ্গ, বিশ্বস্ত বন্ধু। আমার কোনো গোপন দুঃখ বা আনন্দের কথা আপনাকে বলতেই পারি, বলতে পারি গোপন গ্লানি বা অপমান বা অপরাধবোধের কথাও। এসব গোপন কথা বলে আমি আসলে আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকে মর্যাদার আসনে বসাই। একই সঙ্গে এ আস্থা আপনার ওপর থাকে যে এগুলো গোপনই থাকবে, কেবল আমার আর আপনার ভেতরেই থাকবে, কোনো অসতর্ক মুহূর্তেও আপনি তা কারও কাছে প্রকাশ করবেন না, জনসমক্ষে তো নয়ই। একইভাবে আপনার অনেক গোপনীয়তাও কিন্তু আমার কাছে জমা থাকে এবং আমার ওপর আপনার একই রকম আস্থা বা বিশ্বাস থাকে। এমন হতেও পারে, আমাদের দুজনের সম্পর্ক সব সময় একই রকম উষ্ণ থাকবে না, একই রকম গভীরও থাকবে না। তখন কি আমরা পরস্পরের সেই গোপন কথাগুলো জনসমক্ষে বলে বেড়াব? এমনকি সম্পর্ক যদি ভেঙেও যায়, তবু যে মুহূর্তে আমরা পরস্পরকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে, নিজেদের গোপনীয়তাকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম, সেই মুহূর্তের লাবণ্য, সৌন্দর্য ও মর্যাদা কি মিথ্যা হয়ে যায়?

ওই যে মুহূর্তের কথা বললাম, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কিন্তু সব সময় আমাদের হৃদয় খুলে দিই না, গভীর-গহন গোপন কথাগুলো বন্ধু বা সঙ্গীকে বলি না। বলি বিশেষ মুহূর্তে, আবেগভরা মুহূর্তে, অন্তরঙ্গ-একান্ত মুহূর্তে। সেই মুহূর্ত থাকে আনন্দে ভরা, কথকতায় ভরা, উচ্ছ্বাসে ভরা, প্রিয়জনের মধুর সান্নিধ্যে ভরা। কিন্তু এ মুহূর্ত তো মুহূর্তই, অচিরেই তা হারিয়ে যায়। হ্যাঁ, হারিয়েই যায়, কিন্তু মিথ্যা হয়ে যায় না। আজ যে আপনজন কাল সে পর হয়ে যেতে পারে, নিকটজন হয়ে যেতে পারে দূরের, সুখের স্মৃতিগুলো কালিমালিপ্ত হতে পারে, প্রেমগুলো ক্ষয়ে যেতে পারে। তবু তারা মিথ্যা হয়ে যায় না। কোনো এক মুহূর্তে কেউ একজন আপন হয়ে উঠেছিল, হৃদয়ানুবর্তী হয়ে উঠেছিল, অনেক সুখ-আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গী ছিল, সেসব মিথ্যা হয় কী করে? অনেক দিন পর সেই প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে যদি বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়, তবু আগের মুহূর্ত মিথ্যা হয়ে যায় না। বেদনা হয়, দুঃখ হয়, কিন্তু মিথ্যা হয় না। প্রেমও চূড়া থেকে নেমে আসে একসময়, সমতলে আছড়ে পড়ে, কাতরায়, রক্তাক্ত হয়, কাঁদে। তবু তার এই কাতর দশা দেখে ভাবার কোনো কারণ নেই, ওই চূড়ার প্রেম, ওই তুঙ্গ মুহূর্তগুলো মিথ্যা ছিল। অথচ আমরা যখন সেই সব গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজন বোধ করি না, বরং প্রকাশের নামে বিষোদ্​গার করি, তখন সবকিছুকেই মিথ্যা করে দিই।

শুরুতেই বলেছিলাম, লেখক তো সবকিছুই লিখতে পারেন, কিন্তু সবকিছু কি প্রকাশ করতে পারেন? সবকিছু কি পাঠকের তরফ থেকে অনুমোদনযোগ্য? প্রশ্নটি লেখকের স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত ও স্পর্শকাতর। তাত্ত্বিকভাবে একজন লেখক সবই লিখতে পারেন এবং প্রকাশ করতে পারেন। সীমা বেঁধে দিলে সেটি আর স্বাধীনতা থাকে না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। এ দেশেই দেখেছি, প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, উসকানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরি করা হচ্ছে, অবাধ ঘৃণার চাষাবাদ করা হচ্ছে, অপরের ব্যক্তিজীবনকে প্রকাশ্যে এনে জনমানুষের মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এসবই কি প্রকাশযোগ্য? না, আমি স্বাধীনতা নির্ধারণের জন্য রাষ্ট্রীয় কালাকানুন বা আইনের পক্ষে বলছি না, বলছি লেখকের দায়িত্ববোধের কথা। অপর মানুষের ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত করা কিংবা তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার কাজটি যে বা যাঁরা করেন, তাঁরা কিসের লেখক, কেমন মানুষ? না, একে স্বাধীনতা বলে না, সাহসও বলে না, একে বলা যায় আত্মপ্রচারের জন্য অন্ধ হয়ে যাওয়া। এ ধরনের মানুষের কাছে গোপনীয়তার মালিকানা জমা রাখবেন কি না, তা নিয়ে আপনার ভাবার প্রয়োজন আছে বৈকি, প্রিয় পাঠক।