কেমন আছে বাঙালির হাসির গল্পগুলো

বাঙালির হাসির গল্প বাঙালির জনজীবনের রসিকতার ব্যাকরণ। বাঙালি–রুচির ইতিহাসের বিশ্বস্ত দলিল। এই হাস্যরসাত্মক গল্পগুলোতে কী ঘটে? কেমন আছে সেই গল্পগুলো?

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামেই একজন চালাক-চতুর মানুষ থাকে। একই সঙ্গে বোকাসোকা মানুষও একজন থাকে। আর এই দুই কিসিমের মানুষ যদি গ্রামের একই পরিবারে মিলে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। গ্রামের লোকদের আর পায় কে! তারা গল্পের পর গল্প পয়দা করতে থাকবে। অধিকাংশ গল্পের চরিত্র থাকবে ওই দুজন বা এর বাইরেও হতে পারে। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, এই গল্পগুলোর অধিকাংশই হবে হাস্যরসাত্মক; রগড়ে ঠাঁসা। ভাষা অনেক সময় শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে। তাতে রসটা জমে ক্ষীর হয়ে ওঠে।

গল্পগুলো জমে ওঠে গ্রামের টং দোকানে। অথবা তেমাথার বটগাছের তলায় গুলতানি মারার সময়। বয়সের ভেদ সেখানে থাকে না। ছেলে–বুড়ো সবার সমানাধিকার। তবে যেখানে হাসির হল্লা ওঠে, গ্রামের সবাই সেখানে বসে না। রসিকজনেরাই শুধু থাকে সেই হাসির হল্লায়। গ্রামে সবাই জানে এরা রসের কারবারি। এদের জাত আলাদা। কখনো কখনো মুরব্বিগোছের কেউ থাকেন প্রধান গল্পবলিয়ে। আর সব যেন তার তালেব এলেম।

আবু চাচার বয়স এখন আশি ছুঁইছুঁই। চোখে দেখে না বললেই চলে। লাঠি হাতে রাস্তা চলে। কারও আওয়াজ পেলেই জোরে ডাক ছাড়ে, ‘যায় কিডা?’ 

সবাই যে খুব একটা পাত্তা দেয় তা না। কারণ, সে বোকা, একেবারে রামবোকা। এবং লোকটি গ্রামের বহু হাসির গল্পের নায়ক। আর আবু চাচার ভাই শামও ওই সব গল্পের চরিত্র। কিন্তু শাম চালাকিতে শিয়াল পণ্ডিত। আমাদের গ্রামের হাসির গল্পের অন্যতম চরিত্র এই শাম চাচা গত হয়েছেন বেশ আগেই।

বহুদিন আগের কথা। তখন বাংলাদেশের প্রায় সব নদীই সচল ছিল। আবু-শামদের ছিল বড় বাণিজ্য–নৌকা। দেশের শিরা-উপশিরাতুল্য নদীগুলো দিয়ে দূরদূরান্তর চলে যেত দুই ভাই মালামাল নিয়ে। একবার এক রাতে নৌকা ভিড়িয়েছে এক অজানা গাঁয়ের ঘাটে। গভীর রাতে ডাকাত পড়ল নৌকায়। নৌকায় হানা দেওয়ার আগেই ডাকাত সর্দার হুংকার দিল, ‘খবরদার তেড়িবেড়ি করবি না একদম। ছ্যাঁদা কইরা ফালামু। হাতে বন্দুক আছে।’ আবু তো ডরে থরকম্প। বোকাসোকা মানুষ। কিন্তু ভাই শাম দমবার পাত্র নয়। পাল্টা গর্জন তুলল, ‘কই রে ভাই আবু! আমাগো আগোদ্দোম্ অস্ত্রটা বাইর কর তো দেহি!’ বোকা আবু তো ভেবে পায় না কী থেকে কী করবে! আবু নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে শালকাঠের বৈঠা বের করে পাটাতনে এক ঘা বসিয়ে দিল। তাতে বিকট আওয়াজ হলো। বলল, ‘ভাই বাইর করছি। ফুটামু নাকি?’ কীসের ফুটানো আর কীসের কী অস্ত্র! বৈঠার শব্দ পেয়ে ডাকাত দল দিল দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগল, ‘বাপরে বাপ! আগোদ্দোম্ অস্ত্র! এইটা আবার কী অস্ত্র! বাইর করছে তাইতে এত শব্দ। ফুটাইলে কী সর্বনাশটাই না হইব! টাকা–পয়সার কাম নাই। আগে জান বাঁচাই!’ শাম আবুকে জড়িয়ে ধরল। কে বলেছে আমার আবু বোকা!

গল্পটা গ্রামের মানুষ অসংখ্যবার শুনেছে। আমিও শুনেছি। গ্রামের রসিক ছেলে–বুড়োদের মুখেই শুনেছি। প্রতিবার সবাইকে হাসতে হাসতে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়তে দেখেছি। শুধু গল্পের তুঙ্গ মুহূর্তে শ্রোতারা হাসে তা না, গল্পের নানা জায়গায় তাদের হাসির গমক ওঠে। কারণ, বলার ভঙ্গি আর ভাষার মধ্যে এমন ওচড়-মোচড় থাকে যে হাসতে তাদের হয়ই। একচিমটি অশ্লীল শব্দক্ষেপ গল্পটিকে আরও রসালো করে তোলে। গ্রামের লোকের বলার ভঙ্গি আর ভাষা ঠিক আমার মতো নয়। আমি যে ‘আধুনিক’!

ছোট্ট যে হাসির গল্পটা বললাম, তার নাম কী হতে পারে জানি না। গ্রামের লোকের অবশ্য নামের দরকার হয় না। গল্প হলেই চলে। তবু ‘আধুনিক’ আমাদের কাজ চালানোর জন্য ধরা যাক গল্পটির নাম ‘আগোদ্দোম্ অস্ত্র’।

‘আগোদ্দোম্ অস্ত্র’—এই হাসির গল্পটির রচয়িতা কি শাম চাচা! নাকি গ্রামের অন্য কেউ! কারণ, এ গল্পের ধরনটা বাঙালির চিরায়ত যেসব হাসির গল্প আছে, সেই সব গল্পেরই কোনো একটা ধরন অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে। কী সেই ধরন? তা এই যে কোনো একটি চরিত্র বিভিন্ন ঘটনার ভেতর বুঝে বা না বুঝে অদ্ভুত একটা-দুটো শব্দ বলে। আর এতেই একের পর এক ঘটে চলে অভাবিত সব দম ফাটানো হাসির ঘটনা। আবু আর শামের গল্পটাও ওই প্রচলিত কাঠামোতেই বানিয়ে তোলা হতে পারে। তবে কি শাম চাচা তার শোনা কোনো হাসির গল্পের স্থান-কাল-পাত্র পরিবর্তন করে দিয়ে গল্পটা বানিয়ে তুলেছে! অথবা গল্পটা গ্রামের কেউই হয়তো বানিয়েছে দুই ভাইয়ের নাম দিয়ে। হতে পারে।

এই ‘হতে পারে’ বলেই এটি লোকসাহিত্যের একটি শাখা। দিব্যি করে বলা যায় না কোত্থেকে কী হয়েছে। কে কার ভেতরে ঢুকেছে, কতটুকু ‘চুরি’ আর কতটুকু ‘ভেজাল’ তা তো আধুনিক সাহিত্যের মামলা। লোকসাহিত্যের সেদিকে তাকানোর ফুরসত কোথায়! ‘শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও, উদ্দাম উধাও!’

‘ভেজাল’ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যাক। বাঙালির হাসির গল্পের বেশ কিছু সংকলন পাওয়া যায়। এসব সংকলনের একটি বড় অংশ দেখে মনে হয়, গল্পগুলো কোথায় যেন শুকিয়ে মরেছে। আধুনিকতার জোয়াল চড়েছে গল্পগুলোর কাঁধে। এগুলোর ভাষায় আর ভাবে আমরা ‘ভদ্দরলোক’ হতে চেয়েছি। এই ভদ্দরলোকির অনুপ্রবেশ ঘটেছে উনিশ শতকের ইউরোপীয় শিক্ষার ভেতর দিয়ে। আধুনিক ইউরোপীয় রুচির ছাঁচে গড়া লোকসাহিত্যপিপাসু কেউ যখন বাঙালির হাসির গল্পগুলো নিজের মতো করে লেখেন, তখনই উদ্বায়ী কর্পূরের মতো উবে যায় এর নিজস্ব সৌরভ। তখন আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয় শুধু ঘটনার কংকাল নিয়ে। বিশেষ কোনো তুঙ্গমুহূর্তে হয়তো আমরা হাসি, কিন্তু গল্পের মোড়ে মোড়ে ভাষা আর ভঙ্গির মধ্যেও যে হাসির খলবলানিটা থাকে, তা অধরাই রয়ে যায়। অদেখা রয়ে যায় হাস্যকর সব অঙ্গভঙ্গি।

 প্রসঙ্গত উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর কাছে বাংলা লোকসাহিত্যের ঋণের অন্ত নেই। সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙালির হাসির গল্পকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করেছিলেন। শিশুদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বাঙালির হাসির গল্পগুলোতে ওই ‘আধুনিক’ রুচির অনুপ্রবেশের ঘটনাটি ঘটেছে বলে মনে হয়। গল্পগুলোকে শিশুদের উপযোগী করতে গিয়েই হোক আর শিক্ষিত রুচির ঢাক বাজানোর কারণেই হোক, গল্পগুলোকে তার স্বভাব থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। গল্পগুলোর ভাষা আর ভঙ্গির মধ্যে লীলালাস্যটা প্রায়ই ধরা পড়ে না।

সেই তুলনায় জসীমউদ্​দীনের বাঙালির হাসির গল্পতো বোধ করি গল্পগুলোর মূল স্বভাব অনেকখানিই রক্ষিত হয়েছে। এর কারণ কি এই যে জসীমউদ্​দীন চেতনায় গণরুচির কাছাকাছি ছিলেন! তিনি তাঁর বাঙালির হাসির গল্প প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলেছেন, ‘এই গল্পগুলি লিখিতে দশ-বারো বৎসর আমাকে তপস্যা করিতে হইয়াছে।’ তবু তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, ‘এই গল্পগুলি লোকের মুখে শুনিয়া লেখা। গল্প বলিবার সময় যে নানারকমের অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয় থাকে তাহা আমার লেখায় ভালভাবে ফুটাইয়া তুলিতে পারি নাই, কিন্তু গ্রামদেশের লোকেরা যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে গল্পগুলি বলে, তাহা আমার লেখায় ধরিয়া আনিতে চেষ্টা করিয়াছি।’

শেষ করা যাক পল্লিগানের সংগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও জসীমউদ্​দীনের একটা কথোপকথন দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির হাসির গল্পের সংগ্রহ বা রচনার সংকটটা বোঝা যাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার জসীমউদ্​দীনকে কিছু লোকগান দিতে বলেছিলেন। জসীমউদ্​দীন দিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেগুলো তাঁর সংকলনে ছাপলেন না। কারণ, হিসেবে বললেন, ‘বইটি আমি সংকলন করছি বিদেশি সাহিত্যিকদের জন্যে। অনুবাদে এগুলোর কিছুই থাকবে না।’ তাই তিনি মৈমনসিংহ গীতিকা ও ক্ষিতিমোহন সেনের সংগ্রহ থেকে গান নিয়ে সেগুলো সংকলনে রাখবেন বলে জানান। জসীমউদ্​দীন তখন তাঁর মোক্ষম অস্ত্রটা ছাড়লেন। বললেন, মৈমনসিংহ গীতিকা আসলে ‘গ্রাম্য গাথার কাঠামোর ... উপর নানা রচনাকার্যের বুনট’। বুনটটা দিয়েছেন সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। অথচ এগুলো ‘পল্লীর অশিক্ষিত কবিদের নামে চলে যাচ্ছে।’ আর ক্ষিতিমোহন সেনের গানের সংগ্রহের নমুনা রবীন্দ্রনাথের কাছে তুলে ধরে জসীমউদ্​দীন বললেন, এগুলোর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি আপনার [রবীন্দ্রনাথের] কবিতার মতোই। শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘তাই তো ভাবি, এঁরা [লোককবিরা] যদি আগেই এরূপ লিখে গেলেন, তবে আমাদের পরে আসার কি সার্থকতা থাকল?’

বাঙালির হাসির গল্প বাঙালির জনজীবনের রসিকতার ব্যাকরণ। বাঙালি রুচির ইতিহাসের বিশ্বস্ত দলিল। তাই এই গল্পগুলো পুনর্লিখন করতে গেলে যতদূর সম্ভব এর অকৃত্রিমতা রক্ষা করাই শ্রেয়। আধুনিক রুচির আরোপণে না থাকবে জনরস, না থাকবে জনরুচি। এদিকটি খেয়ালে রেখে আরও আরও বাঙালির হাসির গল্প সংগৃহীত ও লিখিত হোক, বাংলা নববর্ষে এর চেয়ে ভালো প্রত্যাশা আর কী হতে পারে!