দিপা কি আসলেই সোফিয়া লরেন
শুটিংয়ের জন্য একটি সিনেমার দল গেছে আখাউড়ায়। কিন্তু দিনভর বৃষ্টির জন্য ক্যামেরা ওপেন করা যাচ্ছে না। এমন অবসরে ছবির পরিচালক সুমনের মনে পড়ে তার প্রেমিকা দিপাকে। একাকিত্ব আর প্রেমে মাখামাখি এক অনবদ্য কাহিনি।
তখনো ভালো করে ভোর হয় নাই। ঘুম ভেঙে গেল। গত রাতে কার্ল সাগানের কসমস পড়তে শুরু করছিলাম। বুকের ওপর বইটা রেখে ঘুমায়ে গেছিলাম একসময়। কসমস এখন ফ্লোরে শুয়ে আছে। আর আমার বুকের ওপর সেই বইয়ের সাইজের কসমিক রোদ।
গতকাল মদ খাই নাই। যে রাতে মদ খাই না, ঘুমটা খুব ছাড়া ছাড়া হয়। সেসব রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখি। বিচ্ছিন্নভাবে টুকরো টুকরো দৃশ্য মিলে স্বপ্নটা তৈরি হয়। দৃশ্যগুলো প্রতিবার একই থাকে। কিছু যোগ হয় না, বিয়োগ হয় না। আবার পুরোনোও হয় না।
স্বপ্নটা আমার খুব প্রিয়। একটা গল্পের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করেই মদ খাই না গল্পে ঢুকব বলে। মদের নেশা যেমন আমার আছে, স্বপ্নের নেশাও আছে। কোনটা বড় নেশা, জানি না। সপ্তাহে এক দিন অন্তত স্বপ্নটা না দেখলে অধৈর্য লাগে। অথচ এটা তো জোর করে দেখা যায় না। বাধ্য হয়ে আমাকে কোনো কোনো রাতে মদ খাওয়া বাদ দিতে হয়।
স্বপ্নে একটা দ্বীপ দেখতে পাই। সেটা যে খুব বড়, তা না। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যেতে বেশি সময় লাগে না। চারদিকে নারকেলগাছে ঘেরা ছোট্ট এক দ্বীপ। কেওড়া আর গোলপাতাগাছও আছে। অন্য যেসব গাছ সেখানে আছে, অধিকাংশই চিনি না। সাইজে সেগুলো বড় না, ছোটখাটো ঝোপের মতো দেখতে। এক পাশে বড় একটা অংশজুড়ে জংলি ফুল ফুটে আছে।
বার্ডস আই ভিউতে আমি দ্বীপটাকে দেখতে পাই। স্বপ্ন যে রঙিন হয় না, এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। ওপর থেকে হলুদ রঙের ফুলে আমার চোখ জুড়ায়। মনে হয়, ওটা একটা সূর্যমুখীখেত—সানফ্লাওয়ার মুভিতে যেমন ছিল। ওই ছবিতে সোফিয়া লরেন হাঁটতে থাকে সূর্যমুখীখেতের মধ্য দিয়ে। দিগন্তবিস্তৃত হলুদ এক খেত। মাঝখানে সে।
সেই দ্বীপে একজনমাত্র মানুষ থাকে। একটা মেয়ে। চেহারা দেখা যায় না। সব সময় আমার দিকে পেছন ফিরে থাকে। তবে তার হাঁটাচলা, নড়াচড়ার ভঙ্গি আমার খুব চেনা। আমি জানি, সে কে।
দ্বীপে অসংখ্য প্রজাপতি আছে, বুনো ফুলের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। সেই অর্থে কোনো বন নাই সেখানে। কিন্তু একপাল শিংওয়ালা হরিণকে আমি দৌড়াতে দেখি। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় আমার ব্যক্তিগত সোফিয়া লরেন। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল।
সে চুল বাঁধতে জানে না, খোলা চুলে বাতাসের বিপরীতে ছুটতে থাকে। হু হু করে হাওয়া বয়ে যায়, বুনো ফুলগুলো মাথা নুইয়ে মেয়েটাকে কুর্নিশ করে। রাতবেলায় সে একটা পাতার কুটিরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। রান্নাবান্নার বালাই নাই। খিদে পেলে গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে খায়।
নিজেকেই প্রশ্ন করি, মেয়েটাকে কে নির্বাসন দিল ওই দ্বীপে? আমার কানে কানে তখন কে যেন বলে দেয়, তুমি।
প্রতিবাদ করতে চাই। পারি না। এক তীব্র অপরাধবোধ আমার ওপর চেপে বসে। অসম্ভব মন খারাপ হয়। নিজের ওপর রাগ লাগতে থাকে। ছটফট করি। একসময় ঘুম ভেঙে যায়। পরের পুরোটা দিন খুব বাজে কাটে আমার। স্বপ্নটা আমাকে অসম্ভব কষ্ট দেয়, তবু আমি ওটা দেখব বলে অপেক্ষা করি। কারণ, আমি জানি, ওই মেয়েটা হলো দিপা।
দিপার সাথে প্রেম হওয়ার আগের বছর একটা টয়োটা স্টারলেট কিনছিলাম। শহরের এ–মাথা থেকে ও–মাথা পর্যন্ত কোনো কারণ ছাড়াই ছুটে বেড়াতাম সে সময়। বারে যেতাম নিয়মিত। পিককের প্রতিটা চেয়ার-টেবিল আমাকে চিনত। আমার বয়স তখন ২৮।
কী দারুণ জীবন ছিল আমার! বৃষ্টি নামলে মনে হতো, এই সব বৃষ্টি আমার, যত খুশি ভিজে নাও। ভিজতামও তখন। রোদ চিড়বিড় করা দুপুরগুলোতে একটুও ঘামতাম না। মনে হতো, আকাশটাকে টুকরো টুকরো করে পকেটে পুরি। কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় উঠছিলাম একবার বন্ধুদের সাথে। সেখান থেকে লাফ দিতে মন চাইছিল। বেশ সুখী একটা মৃত্যু হতো তাইলে।
ভালো ড্রাইভ করতে পারতাম না। গাড়ি নিয়ে বের হলেই রিকশার সাথে ঠুসঠাস লাগায়ে দিতাম। ড্রাইভিং লাইসেন্স তখনো পাই নাই। তবু গাড়ি নিয়ে এক রাতে চলে গেলাম কুমিল্লা। কখনো মনে হয় নাই, অ্যাকসিডেন্ট করে মরে যেতে পারি। চূড়ান্ত লেভেলের সুখী মানুষ তখন আমি। সেই ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় যদি মরে যেতাম, দুঃখ থাকত না মনে।
সে সময়ে একই সাথে তিনটা মেয়ের প্রেমে পড়ছিলাম। কোনো কোনো রাতে ছাদে শুয়ে থাকতাম। খোলা আকাশের দিকে তাকালে মনে হতো, বুকের মধ্যে এতখানি ভালোবাসা জমা আছে যে অনায়াসে আরও চার–পাঁচটা প্রেমে পড়তে পারি। ফুরোবে না।
এমন সময়ে দিপার সাথে দেখা হয় আমার। বিয়ের আগে বছর তিনেক প্রেম করছিলাম আমরা। তুমি-আমি, আমি-তুমি টাইপ প্রেম না। সে প্রেম ছিল ঝড়ের মতো। ভাসায়ে নিয়ে যেত আমাদের।
দিপা খুবই নম্রভদ্র গোছের মেয়ে। পড়ালেখায় ভালো, একই সাথে অ্যাম্বিশাস। পাস করে বের হবার সাথে সাথে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করবে, এ কথা আমরা সবাই জানতাম।
একজন একাডেমিশিয়ানের সাথে ফিল্মমেকারের প্রেম বা বিয়ে হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নাই। কিন্তু পৃথিবীটাই এমন যে অযৌক্তিক প্রচুর কাজকর্ম এখানে হয়। আমাদের বিয়েটাও হয়ে গেল। সমস্যাটা দেখা দিল তারপর।
আয়রোজগারের ব্যাপারে আমি বরাবরই উদাসীন। বছরে মেরেকেটে একটা সিনেমা বানাই। ধর তক্তা, মার পেরেক টাইপের কাজ আমার পছন্দ না। তা ছাড়া আমি মনে করি না, সত্যিকারের কোনো ফিল্মমেকারের পক্ষে বছরে একটার বেশি সিনেমা বানানো সম্ভব। এত আইডিয়া সে কোথা থেকে পাবে?
যারা আইডিয়া নিয়ে কাজ করে, তারা প্রচুর শুয়ে-বসে দিন কাটায়। সময় চলে যাচ্ছে, এই কাজটা করা হলো না—এ–জাতীয় কোনো আক্ষেপ তাদের হয় না। সত্যি বলতে কি, সময় ব্যাপারটাকেই আমি কখনো গুরুত্ব দিই নাই। বিশ্বাস করা শক্ত, আমি জীবনে রিস্টওয়াচ পরি নাই।
আর দিপা হলো ঘড়ি ধরে চলা মানুষ। সে মনে করে, আমি চূড়ান্ত রকমের অলস। সারা দিন হাতে একটা বই নিয়ে শুয়ে থাকি, আর রাতে মদ খাই। বছরে মেরেকেটে ৩০-৪০ দিন শুটিং করি।
এই যে ৩০-৪০ দিন শুটিং করি, এর জন্য যে আমাকে বছরের বাকি দিনগুলো শুয়ে-বসে থেকে নানা ধরনের আইডিয়া নার্সিং করতে হয়—এই ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। দিপাকে অসাধারণ হিসেবেই জানতাম। বিয়ের আগে সে ঠিকই এসব বুঝত। পরে দেখা গেল, আর বুঝতে চায় না। দুজনের দূরত্ব বাড়তে লাগল।
একজন মানুষ, যে ছিল খুব কাছের, একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে—এ অবস্থায় নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত অভিমান কাজ করে। মনে হয়, দূরে সরতেছে তো কী হইছে? সরুক না...। দেখি কত দূরে যেতে পারে! খানিকটা অভিমান মেশানো একাকিত্ববোধ। স্বীকার করতে দোষ নাই, জিনিসটা বেশ উপভোগ করছি তখন। নিজেকে আরও অভিমানী করে তুলছি, আরও একা হয়ে গেছি। এবং কখন যে দুজন দুটো আলাদা ট্রেনে উঠে পড়ছি, তা টের পাই নাই।
দিপা চলে গেছে আজ তিন বছর হলো। দাঁতের কোনায় মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। সেই ব্যথা দূর করার চেষ্টা করি না। ডেন্টিস্টের কাছে গেলে স্থায়ী একটা সমাধান হয়তো পাওয়া যেত। কিন্তু যাই না। যখন ব্যথাটা হয় না, নিজেকে একজন অসম্পূর্ণ মানুষ মনে হয়। ব্যথাটাকে আমি খুঁজি। তার প্রেমে পড়ে গেছি। দিপার ক্ষেত্রেও তা–ই। আমি জানি, তার কথা মনে পড়লেই কষ্ট হবে। তবে সেই কষ্ট ছাড়া যে জীবন, সেটা কল্পনা করাও কঠিন আমার জন্য।
এখন আমি বসে আছি নৌকায়। বইঠার ছপছপ আর বৃষ্টির চিটচিট শব্দ মিলে একটা ছন্দ তৈরি করতেছে। নীরবতার ছন্দ। পানিতে আগুন লাগলে যে অবস্থা হতে পারে, আমার চারপাশের দৃশ্য ঠিক তেমন। অজস্র লাল পদ্ম ফুটে আছে।
কোনো কারণ নাই, তবু দারুণ বড়লোক মনে হলো নিজেকে। আমার এখন আস্ত একটা পদ্মবিল আছে। রক্তকমল, শালুক আর চাঁদমালা ফুল আছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তেছে, সেই বৃষ্টির মালিকও আমি। একটা ভাতশালিক ডাকতেছে পিড়িরিং, পিড়িরিং—শুধু আমি শুনব বলে। গাজুড়ানো বাতাস বয়ে যাচ্ছে, শুধু আমার জন্য। মাথার ওপরে যে বিশাল লাল আকাশ, সেটা আমার নিজস্ব।
সব দিয়ে দিতে পারি আমি দিপাকে। ফিরবে না ও?