হেমন্তে পৃথিবীর ভাঁড়ার

সাহিত্যে ও চিত্রকলায় কেন বারবার ধরা দেয় হেমন্ত নানা রূপে ও রঙে

জীবনানন্দ হেমন্তে দেখেছেন ফসলের প্রসব ও মৃত্যু। তাই কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে।’ কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে ছবিটি তুলেছেন
সৌরভ দাশ

হেমন্ত কি কেবলই সোনালি ফসলের দিন, প্রাচুর্য আর নবান্নের কাল? নাকি ক্ষয়, জরা আর মৃত্যুর গন্ধবাহী এক বিষণ্ন সময়ও? সাহিত্যে ও চিত্রকলায় কেন বারবার ধরা দেয় হেমন্ত নানা রূপে ও রঙে? হেমন্ত ঋতুর উজ্জ্বল সোনালি রং, বাতাসে রূপান্তরের ঘ্রাণ, শীতের দেশে পাতাঝরার আগের সময়টাতে গাছে গাছে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া নানা বর্ণের শিখা, একই গাছে বিচিত্র বর্ণের পাতার সমাহারে পুরো বনরাজির প্রকৃতির অবারিত ক্যানভাসে আলোর উদ্ভাস—সবকিছু দেখে মনে হয় যেন এক মহাশক্তিধর শিল্পী সবার অলক্ষ্যে বসে তরুপল্লবে বুলিয়ে দিয়েছেন অদৃশ্য তুলি, কোথাও কোনো অদৃশ্য ব্রাশ থেকে এলোপাতাড়ি সব ধরনের রং ছিটিয়ে গিয়েছেন যেন কোনো পাগল শিল্পী। শীতের চাবুকে পত্রহীন মৃতপ্রায় বৃক্ষকে আগাম উপহারে সাজিয়ে দিয়ে যেন পুষিয়ে দেওয়া হয় ভবিষ্যতের ক্ষতি।

আমাদের দেশে হেমন্ত নবান্নের কাল, গেরস্তের গোলা ভরে যায় পাকা ফসলে, প্রকৃতি হয়ে ওঠে মোহনীয়, গ্রীষ্ম আর শীতের মাঝামাঝি চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় নামে শান্তির পরশ। আর শীতের দেশে হেমন্তে প্রকৃতির মোহন রূপের পেছনে থাকে আসন্ন শীতের মরণকামড়ের পূর্বাভাস। ইতিহাস শিক্ষা দেয়, ইউরোপীয় রণাঙ্গনে অসহনীয় শীতের কারণে দুটো যুদ্ধে হার মেনেছিল আক্রমণকারী বাহিনী। নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী জনহীন মস্কো দখল করেও ধরে রাখতে পারেনি শীতের আক্রমণে। বিপর্যস্ত ফরাসি বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল বিরূপ প্রকৃতির প্রতিরোধে। ঠিক একই রকম ঘটেছিল ১২৯ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার তীব্র শীতে অপ্রস্তুত জার্মান বাহিনীর ভাগ্যে। এই বিপর্যয়ের ৪০ বছর আগে জার্মানভাষী কবি রাইনার মারিয়া রিলকে আসন্ন শীতের আগেই হেমন্ত ঋতুকে কিছুটা দীর্ঘায়িত করার জন্য প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘প্রভু, গ্রীষ্মের ফলনের পর সময় হলো, বিছিয়ে দাও/ সূর্য ঘড়িটার ওপর দীর্ঘ ছায়া তোমার, তৃণভূমি ঘিরে/ বইয়ে দাও হাওয়ার লুটোপুটি।/ পূর্ণতায় তুষ্ট করে শেষ সোনালি সুস্থতায় ফসলেরে/ দাও মাত্র আর দুটো দিনের উষ্ণ আলো/ শেষ বিন্দু লুণ্ঠন করে আরও মধুময় হোক দ্রাক্ষারস।’ (হেমন্ত-দিন) হেমন্তের প্রাচুর্য আর ফসলের গানের আড়ালে রিলকের পঙ্​ক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকে একধরনের বিষণ্নতা, সে বিষণ্নতা শীতার্ত প্রকৃতি আর মানুষের, মৃত্যু আর রিক্ততার পূর্বাভাসে বৃক্ষরাজির।

হেমন্তের বর্ণিল সাজ আর মোহন রূপ ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য দেশের কবি, লেখক, শিল্পীদের কখনো আক্রান্ত করে বিষণ্নতা। আগুনের শিখার মতো জ্বলন্ত সাজের আড়ালে ওত পেতে বসে থাকা রিক্ততার কথা ভেবে তাঁদের বিষাদাক্রান্ত কলম আর তুলিতে রচিত হয়েছে বহু সৃষ্টি। ‘হেমন্তে বিষণ্ন হওয়াটা ছিল প্রত্যাশিত। প্রতিবছর গাছ থেকে সব পাতা যখন খসে পড়ত, হাওয়া, ঠান্ডা আর শীতার্ত আলোয় উলঙ্গ হয়ে পড়ত ডালগুলো—তখন তুমি আংশিক মৃত। তবে তুমি জানো বসন্ত আসবেই, যেমন করে জানো যে জমে যাওয়ার পর নদী আবারও বইবে। ঠান্ডা বৃষ্টি যখন ঝরতে থাকত আর বিনাশ করত বসন্তকে, এটাকে কোনো কারণ ছাড়া এক তরুণের মৃত্যুর মতো মনে হতো।’ (আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সেইনের মানুষেরা, চলমান ভোজের শহর)

হেমন্তের প্রকৃতির রূপময়তা উজাড় করে প্রায় সব শিল্পীই ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন, তবু ওস্তাদ শিল্পীদের আঁকা কিছু ছবিতে পড়ে থাকে হেমন্তের বিষণ্নতার ছায়া। ভ্যান গঘের ছবিতে বিষাদের সুর সর্বকালীন, তাই তাঁর প্রিয় সূর্যমুখী যেমন বিবর্ণ মলিন, ‘অটাম ল্যান্ডস্কেপ উইথ ফোর ট্রিজ’ ছবিতে তিনটি বর্ণিল বৃক্ষের পাশে একটি পত্রহীন গাছ এঁকে পুরো আবহটাকে যেন হাহাকারে ভরে দিয়েছেন তিনি।

সুনীল আকাশের পরিবর্তে বিষণ্ন মেঘেদের ছায়া এঁকেছেন ক্লদ মোনে তাঁর ‘অটাম অন দ্য সেইন অ্যাট আখজেনতই’ ছবিতে। সেইনের তীরের বর্ণিল বৃক্ষরাজি আঁকলেও আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ছায়া বিছানো পুরো ছবিতে যেন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ, তার ভেতর দিয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্যারিসের শাতো মিশেল আর গির্জার চূড়ার ছায়া। মোনের তুলির স্ট্রোক পরিচিত হলেও শীতের দেশে হেমন্তের এই রূপ আমাদের কাছে অচেনা।

হেমন্তের বিষণ্নতার পাশাপাশি সৌন্দর্যের কথাই বরং বেশি লিখেছেন পাশ্চাত্যের কবি–লেখকেরা। হারুকি মুরাকামি মোহিত হয়েছিলেন নিউইয়র্কে হেমন্তের সৌন্দর্য দেখে, ‘যতবারই ম্যারাথনের জন্য নিউইয়র্ক গেছি, ভারনন ডিউকের চমৎকার লোকগান “অটাম ইন নিউইয়র্ক” মনে পড়ে আমার, ইটস অটাম ইন নিউইয়র্ক। ইটস গুড টু লিভ ইন অ্যাগেইন। নভেম্বরের নিউইয়র্কের সত্যিকার একটা সৌন্দর্য রয়েছে। বাতাস পরিষ্কার ও শুষ্ক, সেন্ট্রাল পার্কের গাছগুলোর পাতা মাত্র সোনালি হতে শুরু করেছে। আকাশ এত পরিষ্কার যে চিরদিন তাকিয়ে থাকা যায়, আর আকাশছোঁয়া ভবনগুলো দরাজভাবে প্রতিফলিত করে সূর্যকিরণ।’ (হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক আ্যাবাউট রানিং)

আমাদের সব উপলক্ষে অনিবার্য যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি বাংলার ঋতু নিয়ে যত গান বা কবিতা রচনা করেছেন, বর্ষা, বসন্ত আর শরৎ নিয়ে সবচেয়ে বেশি, এমনকি গ্রীষ্ম আর শীত নিয়ে লিখলেও হেমন্তের ব্যাপারে তাঁর ছিল একধরনের কার্পণ্য। হেমন্তকে ‘হেমন্তলক্ষ্মী’ বললেও হেমন্তে তিনি পেয়েছেন বসন্তের বাণী, গল্পে নায়িকার নাম রাখলেন হৈমন্তী, লিখলেন পাকা ফসলে গোলা ভরে যাওয়ার কথা—কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দেননি হেমন্তকে, আলাদাভাবে দেখেননি শরৎ, হেমন্ত আর শীতকে। তাই লেখেন, ‘শরতে তাহা চোখ জুড়াইয়া নবীন বেশে দেখা দেয়, হেমন্তে তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাকে, আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণত রূপে সঞ্চিত হয়। শরৎ-হেমন্ত-শীতে মানুষের ফসলের ভাণ্ডার, সেইজন্য সেখানে তাহার তিন মহল; ঐখানে তাহার গৃহলক্ষ্মী।’ তিনি ‘হিমের রাতে’ দেখেন ‘গগনের দীপগুলি,’ ‘ঘরে ঘরে ডাক পাঠানো দীপালিকায়’ বলেন আলো জ্বালাতে।

আমাদের ক্রান্তীয় অঞ্চলে হেমন্ত বা বসন্ত বড়ই ক্ষণস্থায়ী, হেমন্তের তুলনায় বসন্ত যেন আরও চঞ্চলা, এসেই বলে ‘যাই যাই’। এ কারণেই বোধ করি রবীন্দ্রনাথ বসন্তকে দিলেও হেমন্তকে বিশেষ প্রাধান্য দেননি, অথচ আমাদের আবহাওয়ায় বসন্তই বরং হেমন্তের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী, হেমন্তের সাক্ষাৎ ঘটে শীতের আগাম দূতের সঙ্গে, আর বসন্তের মাধুরী কেড়ে নেয় গ্রীষ্মের আগ্রাসী খরতাপ। এ কারণেই বোধ করি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মের যতখানি প্রভাব, তার কণামাত্রও নেই হেমন্তে। ঠিক এ রকম অবস্থার কথাই অকপটে লেখেন মিসরের বিদ্রোহী লেখক আলা আল আসওয়ানি, ‘আমাদের এই “মনোরম মৃদু আবহাওয়া” বাস্তবিকই এক নরক। মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঝলসানো গরম আমাদের চামড়ায় ছ্যাঁকা দিতে থাকে আর সূর্যের উজ্জ্বল তাপে মরতে শুরু করে প্রাণিকুল, গলতে থাকে রাস্তার পিচ...।’ অথচ প্রাইমারি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়, বিধাতা মিসরকে ‘শীত ও গ্রীষ্মে মনোরম মৃদু আবহাওয়া দান করেছেন।’ (ইমারাৎ ইয়াকুবিয়াঁ)

বাংলাদেশের আবহাওয়াও ঠিক এ রকমই, তাই হেমন্ত নিয়ে আমাদের দেশের কবি-লেখকদের উচ্ছ্বাস সীমিত। তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর কাছে বাংলাদেশের ঋতু ছিল মাত্র দুটো, হেমন্ত ও শীত। হেমন্ত ছাড়াও তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ কুয়াশা, পাখি, শীতের রাত—এসব ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। মাল্যবান উপন্যাসে শীতকে বহাল রাখতে গিয়ে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন পুরো ঘটনাপ্রবাহের কালপরিধি। উপন্যাসটির কালিক বিস্তৃতি এক বছরের বেশি, অথচ পুরো সময়জুড়েই ছিল শীত ঋতু, অন্য কোনো ঋতুর দেখা মেলেনি কোথাও। হেমন্তের বিষয়ে জীবনানন্দের পক্ষপাতিত্ব বাংলা কবিতায় তৈরি করেছে একটা নতুন ধারা। সেটি পাশ্চাত্যের কবিদের অনুকরণে হেমন্তের বর্ণিল উদ্ভাস কিংবা আসন্ন শীত ঋতুর উৎকণ্ঠায় নয়। জীবনানন্দ হেমন্তে দেখেছেন ফসলের প্রসব ও মৃত্যু। হেমন্তে তাঁর বেদনার মূল কারণ ন্যাড়া মাঠে ফসল ফলানোর পর মৃত ধানগাছের অমোঘ পরিণতি। তাই তিনি দেখতে পান ‘ডাইনে আর বাঁয়ে/ খড়-নাড়া-পোড়া জমি-মাঠের ফাটল/ শিশিরের জল,’ তিনি উপলব্ধি করেন হেমন্তের রিক্তবেলায় ‘ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে- জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি/ তাই তার ঘুম পায়...।’ এ সময় তাঁর মনে হয় ‘শস্য গিয়েছে ঝ’রে কত, / বুড়ো হয়ে গেছ তুমি এই বুড়ি পৃথিবীর মতো...।’ পাশ্চাত্যের কবিদের বিপরীতে আমাদের কবিরা ভাবেন, ‘কীভাবে সারাবো ক্ষত? কী করে ঝরাবো/ অব্যর্থ শিশির আর্ত হেমন্তের পীড়িত শরীরে?’ যখন ‘হেমন্তের হরিদ্রাভ পিঠেক্ষতটি/ বলে, “কবি, আমাকে করাও স্নান, করো নিরাময়”।’ (শামসুর রাহমান) হেমন্তে আমাদের উপলব্ধি হয়, ‘শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!/ হেমন্ত আসেনি মাঠে,—হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!’ তখন ‘সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস/ দোলা দিয়ে গেল কবে—! বাসি পাতা ভূতের মতন/ উড়ে আসে!   কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস, / যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন! / জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ!’ (জীবনানন্দ দাশ)

আমাদের নবান্নের উৎসবের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্য এক বিপন্ন বিষাদ, সাপের আর ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান তুলে আনা ভূমিহীন মানুষের মরিয়া সংগ্রাম আসন্ন শীতের কালবেলাকে করে তোলে আরও বিপৎসংকুল। এই সব মানুষের কাছে হেমন্তের রূপ নয়, কুড়িয়ে পাওয়া শস্যের সীমিত ভান্ডারই প্রধান আকর্ষণ। প্রকৃতপক্ষে হেমন্তে যখন সূর্যের দক্ষিণায়নের চূড়ান্ত সময় ঘনিয়ে আসে, দুপুরের রোদে বিষণ্ন ছায়ারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, জেঁকে বসতে শুরু করে শীতবিকেলের নিঃসঙ্গতা, দ্রুত মরে আসতে থাকে নরম বিকেলের রোদ, গ্রামের খাল–বিলে জলে টান ধরে, কার্তিকের কর্মহীন কৃষিজীবীরা বসে থাকে নবান্নের প্রতীক্ষায়—তখন থেকে একধরনের সংজ্ঞাহীন হাহাকার সংগোপনে বয়ে যায় আমাদের প্রকৃতি ও মনের প্রান্ত ঘেঁষে। জীবনাননন্দ দাশ কী নির্ভুল পূর্বাভাসে হেমন্তের ঝড়ে পথের পাতার মতো তাঁর নিজের ঝরে পড়ার কথা বলে গিয়েছিলেন, প্রত্যক্ষ করে গিয়েছিলেন কার্তিকে তিনি যখন ঝরে যাবেন, তখন হেমন্তের ফসলের মাঠেও ঝরতে থাকবে ম্লান চোখ বুজে। তিনি ঠিকই ঝরে গিয়েছিলেন হেমন্তের মরা কার্তিকে, কে বলে কবিরা সত্যদ্রষ্টা নন?