বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার খাতা ছিঁড়ে পুতুলের বিছানা পেতেছিলেন তাঁর স্ত্রী

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছবি: সংগৃহীত

দুরন্ত এক শৈশব ছিল কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, স্বাধীনভাবে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছেন বন বাদাড়ে। বাবা ডেপুটি কালেক্টরের চাকরি করতেন বলে বাড়িতে আসতেন খুবই কম। এই সুযোগে কৈশোর সময়টা ভালোই উপভোগ করেছিলেন বঙ্কিম। তাঁর জীবনীকার শশীচন্দ্র উল্লেখ করেন, স্কুলে থাকতেই তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছেলেদের নিয়ে বাড়ির আঙিনায় তাস খেলতেন।

সিগারেটেও তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল কিশোর বয়সেই। তবে পড়ালেখায় ছিলেন অসম্ভব রকমের মেধাবী। এক বসায় কয়েক দিনের পড়া মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন। স্কুল পেরোনোর আগেই ইংরেজিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের এই দুরন্তপনা দেখে তাঁর বড় ভাই শ্যামাচরণ তাঁকে মাত্র এগারো বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিলেন পার্শ্ববর্তী গ্রাম নারায়ণপুরের পাঁচ বছর বয়সী মোহিনীর সঙ্গে।

অল্প দিনেই মোহিনীর প্রেমে পড়ে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্র। দিন যেতে না যেতেই বালিকাবধূ মোহিনী হয়ে উঠলেন শ্বশুরবাড়ির সবার স্নেহের পাত্রী। পরীক্ষায় ভালো ফল করা বাবদ প্রাপ্ত বৃত্তির টাকা ছিল বঙ্কিমের একমাত্র উপার্জন। সেই বৃত্তির টাকায় মোহিনীকে তিনি নানান উপহার দিতেন। নিজে টাকা জমিয়ে কিশোরী বউয়ের জন্য দুটি কানের দুল আর সোনার একটি চুলের কাঁটা কিনে দিয়েছিলেন।

আবার নতুন কিছু লেখা হলে এই মোহিনীই হতেন বঙ্কিমের প্রথম শ্রোতা। একবার মোহিনী বঙ্কিমের লেখার খাতার দুটি পাতা ছিঁড়ে পুতুলের বিছানা বানিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে বঙ্কিম খুব খেপে গিয়েছিলেন। রাগত স্বরে বলছিলেন, ‘তুমি আমার জামা ছিঁড়ে পুতুলকে দিয়ো। তবু আমার খাতা ছিঁড়ো না।’

মোহিনী বয়সে খুব ছোট হওয়ায় প্রায়ই নারায়ণপুরে বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের তখন কিছুতেই বাড়িতে মন বসত না। লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চার কিলোমিটার হেঁটে সোজা চলে যেতেন শ্বশুরালয়ে। মোহিনীর সঙ্গে একটু কথা বলা, তাঁকে একটু চোখের দেখা দেখবেন বলে ঝড়-তুফান কিছুতেই ভয় পেতেন না এ লেখক। আবার ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে আসতেন নিজের বাড়িতে।

বঙ্কিম-জীবনীতে উল্লেখ আছে, ‘(বঙ্কিম) বাড়িতে উপস্থিত হইয়া পড়িতে বসিতেন। সঞ্জীবচন্দ্র বঙ্কিমকে পড়িতে দেখিয়া (রাত্রে) শুইতে যাইতেন। আর ভোরে আসিয়াও পাঠনিমগ্ন দেখিতেন। আশ্চর্য হইয়া তিনি প্রায়ই জিজ্ঞাসা করিতেন, “বঙ্কিম কি সারা রাত জেগে পড়েছে?”’

মোহিনী-বঙ্কিমের এমন ঘন মধুর সম্পর্কের পরিণতি ছিল খুবই করুণ। বঙ্কিম চাকরি নিয়ে তখন যশোরে। সিদ্ধান্ত নিলেন মোহিনীকে কাছে নিয়ে আসবেন, সেটা জানিয়ে চিঠিও লিখলেন স্ত্রীকে। চিঠি পেয়ে মোহিনী উৎফুল্ল। বাড়ির সবাইকে স্বামীর পত্রখানা দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন।

স্ত্রীকে আনতে রওনা দিলেন বঙ্কিক। পথিমধ্যেই খবর পেলেন, অসুস্থ হয়ে মোহিনী অনন্তকালের জন্য তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। শোকস্তব্ধ বঙ্কিম আর বাড়িতে গেলেন না, মাঝপথ থেকেই ফিরে গেলেন। শুধু দাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন, মোহিনীকে উপহার দেওয়া সেই দুটি কানের দুল আর চুলের সোনার কাঁটাটি যেন তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

● গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন

সূত্র: শশীচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্কিম–জীবনী আনন্দবাজার পত্রিকা