সিপাহি বিদ্রোহের বিশ্বাসঘাতকেরা

১৮৫৭ সাল। কোম্পানি শাসনের ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলা-ভারতের সব ফ্রন্ট নিশ্চুপ হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ ভারতীয় ভূখণ্ডে, এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডে আশ্রিত দেশীয় রাজাদের উপরি-প্রভু হিসেবে ইংরেজদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হয়ে গেছে। বেঙ্গল, বোম্বে, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তাঁবেদার অনুগত ধনিক-বণিক-সামন্ত-মধ্যবিত্ত-সুশীল সমাজ ইংরেজ শাসনের স্তম্ভ হিসেবে কোম্পানি শাসনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এদেশীয় সৈন্যদের নিয়ে সুশৃঙ্খল চৌকস সেনাদল গ্যারিসনগুলোতে কোম্পানির অমিত শক্তির প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। ইস্পাতকঠিন আমলাতন্ত্রের কাঠামোতে বন্দী হয়ে গেছে নিঃস্ব, বিপর্যস্ত, সর্বস্বান্ত ও হতবিহ্বল সাধারণ মানুষ। মুক্তি ও স্বাধীনতার সব পথ প্রায় রুদ্ধ। গণমানুষের আবহমান নেতৃত্বকাঠামো হিসেবে বিবেচিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় পুরোটাই ইংরেজ–বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। সারা ভারতবর্ষ অধস্তনতায় আচ্ছন্ন। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। গণমানুষের সংগঠিত হওয়ার সুযোগও প্রায় শূন্য।

ঠিক এমনই সময়ে কোম্পানির বিক্ষুব্ধ ও অত্যাচারিত সিপাহিরা সেনানিবাসে বিদ্রোহ করলেন এবং গণবিদ্রোহের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। আর এ বিদ্রোহ শুরু করল সচেতন, স্বাধীনচেতা ও সংক্ষুব্ধ ‘নেটিভ’ সিপাহিদের একটি অংশ। এরা ছিল সিপাহিদের মধ্যে দেশপ্রেমিক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সাহসী ও অগ্রসর শ্রেণি। এর আগে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহসহ যেসব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তা ছিল অনেকটা স্থানিক ও ইস্যুনির্ভর। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহ ছিল সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান। এ বিদ্রোহ মূলত ভারতের উত্তর অংশে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এর ব্যাপকতা ও গভীরতা ছিল বিপুল। শুরুতে কোম্পানির ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ সিপাহিরা বিদ্রোহের প্রারম্ভিক কাজটা শুরু করলেও তা দাবানলের মতো ভারতের সমগ্র উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সংযুক্ত হন কোম্পানি শাসনে ক্ষতিগ্রস্ত রাজন্যবর্গ ও ছোট-বড় সামন্ত, সংক্ষুব্ধ জনগণ এবং কতিপয় স্বাধীনচেতা ধর্মীয় নেতা। কঠোর মধ্যযুগীয় নির্মমতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে এ বিদ্রোহ দমন করেছিল কোম্পানি।

ইতিহাস-বিশ্লেষণ

উপনিবেশবাদ আমাদের মনস্তত্ত্বে কীভাবে কাজ করে, তা-ই বিশ্লেষণ করা হয়েছে উপনিবেশবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতি বইয়ে। এ গ্রন্থের ‘সিপাহি বিদ্রোহ ও উত্তরকাল: বিশ্বাসঘাতকতার সংস্কৃতি’ অধ্যায়ে রয়েছে এ বিদ্রোহের সময় বাঙালি রাজাদের বিশ্বাসঘাতকতার বৃত্তান্ত। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশ।

উপনিবেশবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতি

হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন

প্রকাশক: জার্নিম্যান বুকস, ঢাকা

প্রচ্ছদ: তারিক সুজাত

দাম: ১২০০ টাকা।

বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ কোম্পানি অমানবিক নিপীড়নের আশ্রয় নেয়। ব্রিটিশ ও অব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরাও বিদ্রোহী হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় এবং বিদ্রোহী সন্দেহভাজন, এমনকি ভবঘুরে বালকদের হত্যা করতে নামে জল্লাদের ভূমিকায়। প্রায় এক লাখ ভারতীয় ও বিদ্রোহী সেনাকে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহী সেনাদের কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়। ‘সমুচিত দৃষ্টান্ত’ স্থাপনের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়ে লাশ প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

সিপাহিদের এই বিদ্রোহ কোম্পানি বা ব্রিটিশের ভাষায় ছিল ‘সিপাহি বিদ্রোহ’; আমরা ভালোবেসে বলি ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ’। আমরা এই যে অভিধায় বিদ্রোহকে চিহ্নিত করি, তাতে আমাদের দেশপ্রেমিকদের ভালোবাসার কোনো গলদ নেই। কিন্তু পুরো পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এটি শেষ পর্যন্ত সিপাহিদেরই বিদ্রোহ ছিল, যাতে ভারতের উত্তরাংশ ও দক্ষিণের কিয়দংশ, সেখানকার কতিপয় জনগোষ্ঠী ও রাজন্যবর্গ অংশ নিয়েছিল। এ বিদ্রোহে ভারতবর্ষের অধিকাংশ দেশীয় রাজা যেমন অংশ নেননি, তেমনি উত্তর ভারত ছাড়া কোম্পানি–নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য অঞ্চল কিংবা ভারতের জনগণ সংঘবদ্ধভাবে কোথাও এর পক্ষে অবস্থান নেয়নি। হয়তো কোথাও কোথাও মৌন সমর্থন দিয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিকটবর্তী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিশ্চুপ থেকেছে, যা ছিল সুবিধা হারানোর শঙ্কা কিংবা ভীতির কারণে। বলা বাহুল্য, দুটোর ফলাফলই গিয়েছে কোম্পানির পক্ষে, যার চূড়ান্ত ফল ছিল ইংরেজ শাসনের আরও ৯০ বছরের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা।

আগেই বলেছি, সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল দেশীয় রাজ্যগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা। এখানে দেশীয় রাজাদের স্বার্থবুদ্ধি ছিল পরিষ্কার। তাঁরা যেকোনো মূল্যে অপমানজনক শর্তে হলেও কোম্পানির আধিপত্য আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। পরাক্রান্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ তাঁদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাঁরা বিদ্যমান প্রাপ্য পেনশন, রাজকীয় মর্যাদা, সম্পদ, গান স্যালুট—কিছুই হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। British Paramountcy তাঁদের সুরক্ষা দিয়েছিল, দাসত্ব হলেও একধরনের বিকৃত স্বাধীনতা দিয়েছিল, রাজকীয় শানশওকত ও সম্মান দিয়েছিল। মেরুদণ্ডহীন ও লোভী এসব রাজার চরিত্র বাহাদুর শাহ জানতেন। তাই তিনি বিদ্রোহে শামিল হওয়ার জন্য দেশীয় রাজাদের উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ইংরেজদের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে দেশীয় রাজারা কর্ণপাত করেননি। উল্টো তাঁদের অধিকাংশই প্রত্যক্ষভাবে কোম্পানিকে সমর্থন দিয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ নিশ্চুপভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, তবে বিদ্রোহীদের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে অবস্থান নেননি।

দেশীয় রাজাদের বাইরে কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসনাধীন এলাকায় জনগোষ্ঠীর যে অংশটি বিদ্রোহে প্রবল হয়ে উঠতে পারত, সেই উঠতি ধনিক-বণিক, সামন্ত-আমলা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল নির্বিকার। অবশ্য নব-উত্থিত এই শ্রেণির বিদ্রোহের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তাদের পুরো সমৃদ্ধি ও জৌলুশ কোম্পানির তাঁবেদারি ও আনুগত্যের ফলেই অর্জিত হয়েছিল। ভৃত্য থেকে মহারাজা, নায়েব থেকে নবাব, কোম্পানির মুনশি-কারণিক থেকে প্রতাপান্বিত জমিদার-মহারাজা হওয়ার যে অবারিত সুযোগ কোম্পানি এনে দিয়েছিল, তা বিদ্রোহের অপরিণামদর্শী শৌখিনতায় হারানোর মতো নির্বুদ্ধিতা তাঁদের ছিল না।

উপমহাদেশের কেন্দ্রে ছিল বাংলা। কোম্পানি শাসনের শুরুটাও এখানে। তাই সিপাহি বিদ্রোহকালে তদানীন্তন বাংলার সার্বিক পরিস্থিতি ও অবস্থান আলাদা করে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। শতবর্ষী কোম্পানির দুঃশাসনে বাংলাই ছিল কোম্পানি শাসনের নির্মম ও সংহারক দিকটির প্রথম প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী সুবা বাংলা কোম্পানি শাসনের শুরুতেই মহামন্বন্তরে এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীকে হারায় এবং এ সময়ে আরও এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পঙ্গু হয়ে যায়। কোম্পানির পরিকল্পিত শিল্পায়ন নীতির কারণে সুবা-বাংলার শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলায় সব ধরনের কর্মসংস্থান ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে, শিল্পনগরগুলো বিরান হয়ে যায়। জমিদারির নিষ্পেষণ ও নিপীড়ন, নীলকরদের নিষ্ঠুরতা ও মহাজনদের দুর্বৃত্তায়নের কারণে সচ্ছল ও স্বচ্ছন্দ বাঙালি ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ে। বাংলার মানুষ দারিদ্র্যের সর্বনিম্ন সীমায় মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। ক্ষোভ-বিক্ষোভের তীব্রতা ও বিদ্রোহের দাবানল এখানেই তীব্রতর হওয়ার কথা। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহকালে বাংলা ছিল অনেকটাই নিস্তরঙ্গ ও নিশ্চুপ।

এর কারণ ছিল একটাই। বাংলায় ছিল দীর্ঘকালীন উপনিবেশের অনিবার্য বিনাশী প্রভাব। কোম্পানি ১০০ বছরে অনুগত জমিদার, আমলা, ধনিক, বণিক, মুৎসুদ্দি, এজেন্ট ও দালালদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠা করে বাংলায় তাদের কর্তৃত্ব সংহত করেছিল। বাংলায় যে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছিল, তারা ছিল পুরোমাত্রায় উপনিবেশিত মনের ইংরেজ অনুগত। ফলে সামন্ত-অভিজাত, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি—যাদের জনগণকে সংগঠিত করার কথা, তারাই ছিল ইংরেজ শাসকদের শর্তহীন অনুগত গোষ্ঠী। তারাই বিদ্রোহকালে এক শতাব্দীকালের অপশাসনে বিপর্যস্ত অসহায় বাঙালিদের ছলেবলে কৌশলে নিবৃত্ত রেখেছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও যশোরে বিদ্রোহ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা ছিল স্থানিক, পুরোমাত্রায় সিপাহিদের বিদ্রোহ। এখানে কোম্পানির আনুকূল্যে উদ্ভূত জমিদারেরা বিদ্রোহীদের দমন ও নিধনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তখন সারা বাংলায় ইংরেজ আনুকূল্যে সৃষ্ট ও পুষ্ট অনুগত এই জমিদার শ্রেণি প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফলে বিদ্রোহকালে বাংলা ছিল পরিপূর্ণ নিশ্চুপতায় আচ্ছন্ন।

বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রধান নগরী ঢাকার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ঢাকার তদানীন্তন জমিদারদের ভূমিকা সম্পর্কে ঢাকা প্রকাশ, ১৮৯৬ সালে লিখেছিল, ‘খাজে আব্দুল গণি, ইংরাজ গভর্নমেন্টেরও বিশেষ সাহায্যকারী ছিলেন।...সিপাহী বিদ্রোহের সময় উন্মত্ত সিপাহীগণ আব্দুল গণিকে বাঙ্গালায় রাজত্ব প্রদানের প্রলোভন দিয়াছিল এবং তাহাদের সাহায্য না করিলে ভয়েরও সম্ভাবনা জানাইয়াছিল। কিন্তু আব্দুল গণি বাহাদুর তাহাদের প্রলোভনে না ভুলিয়া ও ভয়েও দৃকপাত না করিয়া তাহাদের দুরভিসন্ধি গভর্নমেন্টকে জানাইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, যদি স্থানীয় রাজপুরুষেরা সেই সন্ধানানুসারে অপ্রস্তুত সিপাহীদিগকে আক্রমণপূর্ব্বক পরাস্ত না করিতেন, তাহা হইলে একটু পরেই তাহাদের দ্বারা ইংরাজ রাজত্ব (অন্তত কতক দিনের জন্য) অবসান হইত।’ সিপাহি বিদ্রোহকালে ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যের জন্য খাজা আব্দুল গণি পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তাঁকে প্রথমে আইন পরিষদের সদস্য এবং ১৮৭০ সালে বংশানুক্রমিক নবাব উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

খাজা আব্দুল গণি একা নন। পুরো বাংলার নব্য জমিদার শ্রেণি এ ধরনের গণবিরোধী ও দেশবিরোধী ভূমিকায় যুক্ত ছিল। তারা জগদ্দল পাথরের মতো নিরন্ন, অভুক্ত ও অপুষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের পরাপ্রভু কোম্পানির শাসন চাপিয়ে রেখেছিল। ফলে নিষ্পেষিত সংক্ষুব্ধ জনগণ সংগঠন ও নেতৃত্বহীনতার কারণে বিদ্রোহে যোগ দিতে সমর্থ হয়নি। উত্তর ভারতে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তাদের ওপর আর্থসামাজিক ও ভূরাজনৈতিক আঘাতটা ছিল সমসাময়িক, তাদের ক্ষত ছিল তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষ এবং তাদের নেতৃত্বে ছিল আবহমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, সামন্ত, মধ্যবিত্ত, যা বাংলার ক্ষেত্রে ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অথচ বাংলা বিদ্রোহ করলে ইতিহাসের ধারাই পাল্টে যেত।