মালি আলমেদার সপ্ত চন্দ্র

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

স্মৃতিগুলো যন্ত্রণা হয়ে ফিরে আসে। কখনো ছায়ার মতো, কখনো ঘামের মতো, কখনো চুলকানি কিংবা ফুসকুড়ির মতো যন্ত্রণা হয়ে ফিরে আসে। কখনো কখনো বমি বমি ভাব ও মাথাব্যথার মতো যন্ত্রণা হয়। কখনো কখনো মনে হবে, আপনার অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই। মনে হবে, আপনি একটি ক্ষয়ে যাওয়া মৃতদেহের মায়া ধরে পড়ে আছেন।

প্রায় পাঁচ বছর আগে হোটেল লিওতে ক্যাসিনো খেলতে গিয়ে জাকির সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল। ২০ বছর বয়সী জাকি, মাত্রই স্কুলের চৌকাঠ পেরোনো জাকি সেদিন বেদনাদায়কভাবে বেকারত খেলায় (একধরনের তাস খেলা) হেরেছিল।

আপনার মনে পড়ল, আপনি ভান্নিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে চমৎকার এক ভ্রমণের অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। আপনার কেবলই মনে হয়, কে যেন এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি আপনাকে খুন করেছে। আপনি যেদিকেই তাকান, কুৎসিত ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না আপনার। আপনি সেদিন মাথায় লাল রঙের কুখ্যাত রুমালটি বেঁধে রেখেছিলেন? কী জানি! মনে পড়ে না।

তবে হঠাৎ আপনার মনে পড়ল, আপনি যেসব ছবি তুলেছিলেন, সেগুলো অ্যাসোসিয়েট প্রেসের জনির কাছে বিক্রি করেছিলেন। বেশ মোটা দামেই বলা যায়, ছয় অঙ্কের চেক লিখেছিলেন।

তারপর আপনি বুফেতে কাঁকড়া আর জিন খেতে গিয়েছিলেন। এলোমেলো চুল আর কালো মেকআপের অদ্ভুত মেয়েটিকে (যার নাম জাকি) আপনি বললেন, ‘কোনো বাঁধনেই বাঁধা পোড়ো না বোন। জগৎ বড় মায়ার খেলা।’ মেয়েটি আপনার দিকে ঘুরে তাকাল। আপনি তার চোখে অদ্ভুত কিছু খুঁজে পেলেন।

মেয়েরা সাধারণত আপনাকে পছন্দ করে। ছোট করে রাখা দাড়ি, ইস্ত্রি করা শার্ট ও ডিওডোরেন্ট আপনাকে আর দশটা ঘামে ভেজা লঙ্কান পুরুষের থেকে এগিয়ে রাখে নিশ্চয়ই। কোনো সন্দেহ নেই।

মেয়েটি বলল, ‘আমি মাত্রই জুয়া খেলে ২০ হাজার রুপি জিতেছি।’

আপনি খেয়াল করলেন, মেয়েটি একা। কিন্তু কেউ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। এটা কলম্বোর ক্যাসিনোতে অস্বাভাবিক একটা ঘটনা।

যা হোক। মেয়েটি বলল, ‘আপনি যদি আবারও খেলেন, আপনার জয়ের সম্ভাবনা ৯ শতাংশ। এই জুয়ার বাড়ি এমন এক কৌশল করে রেখেছে, আপনি যদি ১০০ বার খেলেন, ১০০ বারই হারবেন।’

আমি বললাম, ‘সুইট হার্ট, তুমি যদি সংখ্যা নিয়ে চিন্তা করতে না পারো, তাহলে এই জুয়াবাড়ি তোমাকে খেয়ে ফেলবে। এই মহাবিশ্বের সবকিছুই হচ্ছে গণিত আর সম্ভাব্যতার খেলা।’

‘আমি এখানে শান্তির খোঁজে এসেছি। অঙ্ক করতে আসিনি।’ মেয়েটি বলল।

আপনি বললেন, ‘সেটা সব সময়, সব ক্ষেত্রে সত্য, তা কিন্তু নয়।’

তারপর আপনি মেয়েটিকে নিয়ে বুফের দিকে গেলেন। তার সঙ্গে চকলেট, বিস্কুট, পুডিং খেলেন। তারপর একটা গোল্ডলিফ সিগারেট ধরালেন। দূরে কোথাও তখন কেউ একজন কি-বোর্ডে ‘টারজান বয়’ গাইছিল।

তারপর হঠাৎ কী হলো জাকির কে জানে! সে হঠাৎ

খাঁটি বিলেতিদের মতো চোস্ত ইংরেজিতে বলল, সে শ্রীলঙ্কাকে ঘৃণা করে। এই শহরে সে থাকে তার এক খালার সঙ্গে আর কাজ করে শ্রীলঙ্কা ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে। সেটা

অবশ্য সকালে। আর রাতে? দেখতেই পাচ্ছেন। এই ক্যাসিনোতে।

জাকি স্বগতোক্তির মতো বলে গেল, একদিন তার খালার স্বামী কীভাবে দরজায় টোকা না দিয়েই তার ঘরে ঢুকেছিল এবং হামাগুড়ি দিয়ে তার ওপর উঠে এসেছিল।

জাকির গল্প শুনতে শুনতে আপনার মনে পড়ল, আপনার বয়স যখন পনেরো, তখন থেকেই আপনার বাবা নেই। আপনার ব্যর্থ ক্যারিয়ারের পেছনে আপনার বাবা বেশ খানিকটা অর্থকড়ি ঢেলেছিলেন বটে; তবে তাতে ভাগ্যের ইতরবিশেষ হয়নি।

আপনার বয়স যখন ২০, তখন আপনি ফিন্যান্স বিষয়ে পড়ছিলেন। গ্রীষ্মকালটা পড়াশোনার পেছনেই ব্যয় করতেন। আর শীতের সময়ে ইনস্যুরেন্সের কাজ করতেন।

থাক সেসব স্মৃতি। জুয়া খেলার মূল বিষয়গুলো আপনি অবশ্য এখন ভালোই রপ্ত করেছেন। আপনি এখন জানেন, বিনিয়োগ বনাম ফল। ইনকাম বনাম সঞ্চয়। এভাবেই চলছে জগৎসংসার।

আপনি মানুষটা খুব লড়াকু আর জেদি। জীবনে এমন কোনো বাজি ধরেননি, যে বাজিতে আপনি জিতবেন না। আপনি চোখ খোলা রাখেন। তাই সব দিক থেকে প্রতিকূলতা জেনে যান। তারপরও এটা তো স্বীকার করতেই হবে, যেকোনো লটারিতে জেতার সম্ভাবনা আশি লাখের মধ্যে একটি, গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা চার হাজারে একজন, আর মিস্টার কিনসি বলেছিলেন, সমকামী হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি দশজনে একজনের।

তো এই যুদ্ধবিধ্বস্ত নরকে জন্ম নেওয়ার শ্রেষ্ঠত্ব কী, বলেন? এই পৃথিবী নামক গ্রহের ইতিহাসে কখনো শান্তির যুগ ছিল না। তারপরও আপনি জাকিকে বললেন, সে যেন লাল বনাম কালো—এমন বর্ণবাদী ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে। সে যেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ভাবে।

আপনার কথা শুনতে শুনতে মেয়েটি মাতাল হয়ে তার জুয়ার টেবিলে ফিরে গেল। আপনি বুঝতে পারলেন, তার একার পক্ষে বাড়ি ফেরা প্রায় অসম্ভব। তাই স্বেচ্ছায় একটি ট্যাক্সি ডেকে তাকে ট্যাক্সিতে বসালেন। সে আপনাকে তার বাড়ির ঠিকানা বলতে পারল না। তাই আপনি তাকে নিজের বাড়িতেই নিয়ে এলেন। তারপর একসময় মেয়েটি আপনার বাসার সোফায় জেগে উঠল। আপনি তার বিস্মিত চোখের সামনে তার একা একা মাতাল হওয়ার নাতিদীর্ঘ গল্পটি বললেন। মেয়েটি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনল।

তারপর মেয়েটি সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখল এবং আপনার তোলা ছবিগুলো দেখে বলল, ‘এসব ছবি আপনাকে হত্যা করতে পারে।’

আপনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘ক্যাসিনোর মাতলামিটা এখনো যায়নি দেখি!’

শেহান করুণাতিলকা

অনুবাদ: মারুফ ইসলাম

শেহান করুণাতিলকা ও তাঁর উপন্যাস প্রসঙ্গে

১৯৯০ সালের কলম্বো। এক মহাজাগতিক ভিসা অফিসে মৃত অবস্থায় জেগে উঠেছেন মালি আলমেদা। বেঁচে থাকতে তিনি ছিলেন যুদ্ধদিনের আলোকচিত্রী ও জুয়াড়ি। তাকে কে খুন করেছে, তিনি জানেন না। তার কাছে আছে সাতটি চাঁদ। সেগুলো ব্যবহার করে তিনি তার প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন এবং নিজের ফেলে আসা ছবিগুলোর কাছে যেতে চান। কারণ, মালি মনে করেন, ছবিগুলো একদিন শ্রীলঙ্কাকে কাঁপিয়ে দেবে। দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা উপন্যাসে মালির জীবনের এই অস্বাভাবিক গল্প লিখেই এ বছরের বুকার পুরস্কার পেয়েছেন শ্রীলঙ্কার কথাসাহিত্যিক শেহান করুণাতিলকা। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার এক ঝঞ্ঝাময় পরিভ্রমণ এবং কল্পনার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে নিরীক্ষাপ্রবণ বর্ণনাভঙ্গির সমন্বয়ের জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে বিচারকেরা জানিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর এ উপন্যাসে এক মৃত আলোকচিত্রীর গল্প বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর যে নিজের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। শেহান করুণাতিলকার এটি দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস চায়নাম্যান প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালে। এ বইয়ের জন্য সে বছর তিনি ‘কমনওয়েলথ বুক প্রাইজ’ পেয়েছিলেন।

শেহান করুণাতিলকার জন্ম ১৯৭৫ সালে শ্রীলঙ্কার গালেতে। পড়াশোনা করেছেন নিউজিল্যান্ডের মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বুকারজয়ী উপন্যাস দ্য মুনস অব মালি আলমেদার প্রথম অধ্যায়ের সংক্ষেপিত অংশ পাঠকদের জন্য পত্রস্থ হলো। অনূদিত অংশটুকু নেওয়া হয়েছে দ্য বুকারপ্রাইজ ডটকম থেকে।