শিল্পী: অভিজিৎ চৌধুরী

অভিজিৎ চৌধুরী একজন আধুনিক চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশের শিল্পচর্চার যে যাত্রা, তার একজন পরম্পরাগত যাত্রী। নব্বইয়ের দশকে তাঁর উন্মেষ। যাত্রার শুরু থেকে চিত্রকলার নানা পথ ও পন্থায় তিনি নিজেকে সৃষ্টিশীলতায় জারি রেখেছেন। ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ নাগাদ দেশে-বিদেশে তিনি চৌদ্দটি একক প্রদর্শনী করেছেন। শতাধিক যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। একজন সৃষ্টিশীল চিত্রশিল্পীর কালযাত্রার বিবেচনায় এটি সামান্য কিছু নয়। কেননা শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পীকে সমকালীন থাকা কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়। এটা সময়কে আপন করে নেওয়ার যাত্রা। বলা যায়, শিল্পের পথে আপন আত্মজগৎকে তিনি নানাভাবে প্রসারিত করেছেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেস ঢাকার লা গ্যালারিতে ‘নন হায়ারার্কিক্যাল অর্ডার অব ফর্ম’ বা ‘রূপের সাধারণ ক্ষমতা বিন্যাস’ শিরোনামে চলছে তাঁর পঞ্চদশ প্রদর্শনী। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অভিজিৎ চৌধুরীর শিল্পকর্ম আধুনিক?

আধুনিক চিত্রকলার সূত্রপাত ব্যক্তির অন্তর্গত মনোজগৎকে কেন্দ্র করেই। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পদে ইউরোপে আধুনিক চিত্রকলায় ব্যক্তির মানবিক বিকাশ রাষ্ট্রকে বিযুক্ত করে নয়, বরং হাজির হয়েছিল সামন্তচিন্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহরূপেই। বিংশ শতাব্দীতে সেটা আরও প্রসারিত হয়েছিল কারখানা বিপ্লবের মাধ্যমে। নগরের দ্রুত বিকাশের ফলে নাগরিক আশা-হতাশা, দুঃখ-বেদনা, ক্ষমতা-অক্ষমতা, ক্ষয়-অবক্ষয়, একাকিত্ব-বিচ্ছিন্নতা, যুক্তির ঘাত-অভিঘাত, ক্লেদ-যন্ত্রণা, মনোবিকলনসহ নানা উপাদান চিন্তার ভরকেন্দ্রে আবির্ভূত হয়। গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রকলার উন্মেষ সেই আধুনিক ভর বিন্দুর ওপর। পরম্পরার দিক থেকে বিবেচনা করলে অভিজিৎও তার অভিযাত্রী।

অভিজিতের শিল্পকর্ম কোন রূপে আবির্ভূত? যদি বলতে পারতাম, ব্যক্তির ক্লেদাক্ত মনোজগতের বাসনার অভিপ্রায়, তাহলে স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু আধুনিক চিত্রকলা তো নানা ধারায় বিভক্ত। তবে আধুনিকতার মূল ভিত বাস্তববাদী চিত্রকলা হলেও, তার অন্য এক অনন্যধারা বিমূর্তবাদী চিত্রকলা। প্রচলিত তত্ত্বের ধারণা, শিল্পের প্রাচীন প্রবণতার সর্বশেষ প্রকাশ বিমূর্তবাদী চিত্রকলা। মূলত এমত ধারণা অবস্তু বা বস্তুর রহস্য বা অধরাকে ধরার অভিপ্রায় থেকে জন্ম নেয়। কিন্তু আধুনিক চিত্রকলার আরেক নব উন্মেষ ছিল বাস্তবতার সঙ্গে অধরা বা বিমূর্ত জগতের সম্বন্ধ স্থাপন করা। এটি এমন নয় যে বাস্তবতাবিবর্জিত শিল্পের বাসনা; বরং শিল্পকে বাস্তব অনুষঙ্গের সঙ্গে রহস্যময় নতুন মিলনকোঠায় পৌঁছানোর এক পন্থা। আমাদের বিবেচনায়, তাঁর শিল্পীও বাস্তব অনুষঙ্গের সঙ্গে রহস্যময় পথের দিকে ধাবিত হয়।

শিল্পী: অভিজিৎ চৌধুরী

অভিজিতের শিল্পের গঠন কী? সহজ ভাষায়, বস্তুর রহস্যঘেরা মানসিক অভিব্যক্তির এক নিরবচ্ছিন্ন রূপ। এই রূপ সহজ বাস্তব নয়। তাঁর ক্যানভাসে বস্তু হাজির হয় প্রকৃতি রূপে। দর্শনের দিক থেকে বলা যায়, প্রকৃতিমাত্রই বিমূর্ত। আর বিমূর্ত ভাবের অর্থ দিলেই আমরা বলি ভাষা। সেটা মুখের, লেখার, চিত্রকলার, ছবির কিংবা যেকোনো ভাষার রূপান্তর মাত্র। আদতে বিমূর্ত চিত্রকলায় দুটো কাঠামোর ওপর বস্তুর প্রকৃতি নির্ভর করে। প্রথমত বস্তুর সহজ বাস্তব রূপ ধরা, দ্বিতীয়ত বস্তুর বাস্তব রূপকে অপরিচিত বা রহস্যাবৃত করা। অভিজিৎ তাঁর ক্যানভাসে বিমূর্ত রূপের দুটো কাজই করেছেন। কেননা তাঁর শিল্পের বাসনা নিছক বাস্তব বস্তুর উপস্থাপন নয়, বরং বাস্তবতাকে আড়াল করে রহস্যময় দৃশ্যকল্প সামনে এনেছে। জিজ্ঞাসা জাগে, কেন তাঁর শিল্পকর্মে এমন রহস্যময়তা?

অভিজিতের শিল্পকর্মে তিনটি প্রক্রিয়া জায়মান। কেননা ক্যানভাসে উপস্থাপিত দৃশ্যকল্পে আছে বস্তুজগৎ থেকে আহরিত কল্পনা, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা। কারণ, তিনি বস্তুর বাস্তব জ্ঞানকে অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করেন। আর লব্ধ অভিজ্ঞতাকে কল্পনার রহস্যে নিয়ে যান। যেন বস্তু ঠিক বস্তু নয়, বস্তু যেন শূন্য সংবেদনশীল প্রকৃতিতে শয্যা পেতে আছে। তাঁর শিল্পকর্ম সংবেদনশীল, তবে আবেগের আতিশয্য নেই। আছে সংবেদনশীলতার পরিমিত রূপ। কারণ, ক্যানভাসে রঙের ব্যবহার দর্শককে সংবেদনার প্রশান্তি দেয়। কালো রঙের সঙ্গে কখনো নীল, কখনো লাল, কখনো আবছা সবুজ বা হালকা কমলা রং সাদা ক্যানভাসে যন্ত্রণাক্লিষ্ট অস্থিরতাও রহস্যময় সৌন্দর্য রূপে জায়মান। সেটা বিষণ্ন সুন্দর!

নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে শিল্পে বস্তুর সরল উপস্থাপন আনন্দদায়ক। এটা স্থির জীবনের মতো বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। ফলে বস্তু বা অবয়বের সরল আকার নিছক বাস্তব দশার প্রতিফলন। কিংবদন্তি শিল্পী পাবলো পিকাসোর এমন শিল্প নিয়ে বড় অভিযোগ তোলেন। এবং বলেন, এমন ‘শিল্প কথা বলে’ না। কিন্তু বিমূর্ত শিল্পে অবয়বের সরল কাঠামো ভেঙে যায়। বস্তুর স্থির জীবন রহস্যময় হয়ে ওঠে। নিরীক্ষার কারণে অবয়ব প্রতীকীভাবে অপরিচিত হয়ে ওঠে। নিরীক্ষামূলক এমন চিত্রকলা দর্শকের সঙ্গে কথা বলে। নিরীক্ষার শর্তই হলো শিল্পীর স্বাধীন সত্তার প্রকাশ। এটা সৃজন আর মানসিক সত্তাকে নিরবচ্ছিন্ন রূপের কাছে নিয়ে যায়। ‘কথা বলার অভিপ্রায়ে’ অভিজিৎ ক্যানভাসে বস্তুর অবয়বকে প্রতিনিধিত্ব করে তোলেন। বলা চলে এটাই তাঁর শিল্পের উদার সৌন্দর্য।

বিমূর্ত চিত্রকলার অভিব্যক্তি এমন—যেখানে শিল্পী নয়, শিল্পই আপনার সঙ্গে কথা বলে। শিল্পে বস্তু ভাবের প্রকৃতি তার সহায়। দর্শক যেন আবছা অবয়ব বা অবয়বহীনতার ভেতর এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়। এমনও মনে হতে পারে, এটি অনুভূতি অর্জনের এক নতুন দিগন্ত। তাহলে অভিজিৎ কি শিল্পকর্মে সেটা হাজির করেন? উত্তর—একার্থে ‘হ্যাঁ’। একটু খেয়াল করলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। যেমন শিল্পকর্মে অপরাপর উপাদান থাকলেও তাঁর বর্তমান যাত্রায় প্রধান উপাদান চেয়ার। চেয়ার বস্তুগত ভাবে বাস্তব। কিন্তু শিল্পকর্মে তাঁর উপস্থাপিত চেয়ার আবছা অবয়বের। কখনো এটা ভঙ্গুর, কখনো অকার্যকর, কখনো নিঃসঙ্গ, আবার যৌথ উপাচারের টেবিলসমেত দৃশ্যমান।

প্রকৃতিগতভাবে চেয়ারগুলো শূন্য। যেন আসনহীন সময়ের প্রতিচ্ছবি। অভিজিৎ শিল্পকর্মের উপাদান হিসেবে সেসব বস্তু হাজির করেছেন, মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। কিন্তু সৌন্দর্য সৃষ্টির বেলায় সেসব উপাদানকে তিনি শূন্যতায় পর্যবসিত করেছেন। বিমূর্ত চিত্রকলার ক্ষেত্রে এমন শূন্যতা সৃষ্টি করা শিল্পীর শক্তিসত্তার পরিচায়ক।

অভিজিৎ বস্তু প্রকৃতির নিঃসঙ্গতা দিয়ে প্রথমত তাঁর সময়কে ধরতে চেয়েছেন। যে অস্থিরতার সমাজবাস্তবতায় আমরা বসবাস করি, সেখানে কোনো কিছুই যেন কিছুই নয়। এমনকি ‘জড় পদার্থ চেয়ার’ কিংবা ‘ক্ষমতা আরোপিত চেয়ার’—সবই তুচ্ছ।

দ্বিতীয়ত বস্তুকে অসীমতার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার বাসনা মানে সময়হীনতার দিকে যাত্রা করা। যে বর্তমান বা সময় অভিজিৎ হাজির করেন, সেটা সুখবিবর্জিত এক সময়। ফলে তিনি বস্তু বা অবয়বের রহস্যময়তার ভেতর ভবিষ্যৎকে দেখাতে চান। যার জন্য তাঁর ক্যানভাসে অবয়বের রেখা এক নৈতিক মাত্রা বহন করে। অবয়বে যা দেখতে সরল, কিন্তু মোলায়েম বিশৃঙ্খল। চিত্রকল্পে অবয়বের যে ভঙ্গুর সংহতি, বিমূর্ত কলার গুণাবলি সেখানেই প্রোথিত। অভিজিৎ চৌধুরী সে পথের একজন নিয়ত অভিযাত্রী।