যে কারণে কেঁদেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় খুব অদ্ভুতভাবে। তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি, থাকি সেন্ট্রাল রোডে। আমার বড় ভাই অঞ্জন আইচ এবং আমরা মিলে একটি লাইব্রেরি এবং একটি দেয়ালপত্রিকা করার পরিকল্পনা করি। সবাই মিলে নাম খুঁজতে লেগে গেলাম। আমার ভাই একটি নাম প্রস্তাব করেন এবং সেই নাম আমাদের সবারই মনে ধরে যায়। লাইব্রেরির নাম হবে ‘ময়ূরাক্ষী’। পোলাপান আমরা, এ ধরনের নাম আগে কখনো শুনিনি। পত্রিকা ও লাইব্রেরি নাম রাখা হলো ময়ূরাক্ষী। কিছুকাল পরেই আমরা জানতে পারলাম, হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাসের নাম ময়ূরাক্ষী। এরপর সেই শিশু বয়সেই একে একে আমরা হুমায়ূনের বিভিন্ন রচনা পড়তে আরম্ভ করলাম। আর তখন টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটক প্রচার হতো খুব সাড়ম্বরে। নিজেদের অজান্তেই হুমায়ূনের জগতে প্রবেশ করলাম আমরা। আবিষ্কার করতে লাগলাম, আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের জীবন হুমায়ূন আহমেদ তুলে আনছেন অত্যন্ত সরল ভঙ্গিতে। ৮০-৯০ দশকের সব শিশু-কিশোর, তরুণ, যুবক—প্রত্যেককেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখালেখি এবং নাটক-সিনেমা দিয়ে। 

আমার ব্যক্তিজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় হলো হুমায়ূন আহমেদ। সেই যে শিশু বয়স থেকে তাঁকে পড়তে শুরু করেছিলাম, এরপর আমি তাঁর সান্নিধ্যও পেয়েছিলাম। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলার, দেখা করার এবং আবেগে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। যাঁরা তাঁকে বাস্তবে দেখেননি, তাঁরা ভাবতেই পারবেন না কতটা রসিক মানুষ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। জীবনের চিরসত্য ও তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো তিনি বলতেন রসিকতার ভেতর দিয়ে। তাঁর সঙ্গে একটা বৈঠক হলে সেখানে তাঁর লেখা একটা বই পড়ার মতোই আনন্দ পেতাম আমরা। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়তাম মানুষটির হিউমার দেখে বা শুনে।

নিজেকে ‘গর্তজীবী’ দাবি করতেন হুমায়ূন আহমেদ। বিষয়টা অমূলক নয়, আসলেই তিনি সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকতেন। তাঁর লেখার ভঙ্গিও ছিল অদ্ভুত, লুঙ্গি পরে খালি গায়ে মাটিতে বসে লিখেছেন অসামান্য সব কথাসাহিত্য। তারপর সন্ধ্যার দিকে একটা আড্ডা হতো তাঁর বাসায়, জম্পেশ আড্ডা। সেই আড্ডায় কখনোসখনো আমি ডাক পেতাম, ছুটে যেতাম দুর্বার আকর্ষণে।

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা—সালটা... কত? ২০০৩-০৪ হবে, স্পষ্ট মনে নেই। হ্যাঁ, তাঁর উপন্যাস আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখত। তখন কেবল নাটক-টেলিফিল্ম বানানো আরম্ভ করেছি। আমার দারুণ পছন্দের চরিত্র মিসির আলি এবং মিসির আলি সিরিজের অন্যতম সাড়াজাগানো উপন্যাস বৃহন্নলা। হুমায়ূন আহমেদ তখন বিটিভির বাইরে কাউকে তাঁর কোনো উপন্যাস থেকে সিনেমা-নাটক বানানোর অনুমতি খুব একটা দিতেন না। আমি সাহস করে বৃহন্নলার একটা চিত্রনাট্য লিখে ফেললাম। এরপর একদিন দুপুরে হাজির হলাম হুমায়ূন আহমেদের ‘দখিন হওয়া’ নামক ধানমন্ডির বাসায়। 

সকালবেলায় তাঁর বাসায় গিয়ে দেখলাম, সেখানে রাজ্যের লোকজন। তাঁদের মাঝখানে বসে আছেন পাগলাটে ধরনের একজন মানুষ, তিনিই হুমায়ূন আহমেদ। পাগলাটে বললাম কেন, তার একটু ব্যাখ্যা দিই, তিনি সম্ভবত খুব সকালবেলা কোথাও হাঁটতে কিংবা দৌড়াতে গিয়েছিলেন। সেটা কোনো সাধারণ জায়গা নয়, বেশ বোঝাই যাচ্ছে। সম্ভবত তিনি কোনো বনজঙ্গলের ভেতরে হেঁটেছেন বা দৌড়েছেন। কারণ, তাঁর কালো প্যান্টের শরীরে অসংখ্য চোরকাঁটা লেগে আছে; এবং তাঁর কথাবার্তার মধ্যেও কোনো সুশীল টাইপের ব্যাপার ছিল না, তিনি আবোলতাবোল এলোমেলোভাবে হাসছেন, রসিকতা করছেন আর কথা বলছেন। একে একে অনেকগুলো মানুষের সঙ্গে তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেক কথা বললেন। সবশেষে বাকি পড়ে রইলাম আমি। আমার দিকে তির্যক দৃষ্টি নিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, আমার আসার উদ্দেশ্য কী? তাঁকে বৃহন্নলা উপন্যাসের চিত্রনাট্যটি হাতে তুলে দিলাম। তিনি সেটা নেড়েচেড়ে দেখলেন কিন্তু তাঁর এই চিত্রনাট্য নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখলাম না। তখন সবেই মুক্তি পেয়েছে তাঁর চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া। তিনি জানতে চাইলেন, সিনেমাটি আমি দেখেছি কি না? বললাম, আমি বলাকা হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখেছি এবং দেখে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। (একই সঙ্গে এটাও বললাম যে আগুনের পরশমণি আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা) আমার মতো একটা পরিচয়হীন তরুণের মুখে এ ধরনের উদ্ধত কথা শুনে তাঁর বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তা হলেন না। কারণ, আমি তাঁকে কয়েকটি পয়েন্টে ব্যাখ্যা করলাম সিনেমার কিছু টেকনিক্যাল ত্রুটির কথা। সবাই যখন হুমায়ূন আহমেদের তোষামোদী করছে, তখন একটি ছেলে বিরুদ্ধাচরণ করল—এটা হয়তো তাঁর ভালোই লেগেছিল। আসলে তাঁর মনের মধ্যে তখন কী চলছিল, তা তো জানি না।

চিত্রনাট্যের জোরের কারণেই হোক বা আমাকে ভালো লেগে যাওয়ার কারণে হোক, তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন এই টেলিছবিটি নির্মাণ করার। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে বৃহন্নলা নামক টেলিছবিটি বানাই এবং একদিন তাঁর বাসায় গিয়ে একটি ডিভিডির কপি রেখে আসি। আমি ভাবলাম, ব্যস্ত মানুষ, তিনি কি সময় পাবেন আমার বানানো এসব হাবিজাবি দেখার? কিন্তু না, কয়েক দিন বাদে আমি তখন হাতিরপুলের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি, আমার পকেটের ভেতরে থাকা মুঠোফোনটি সশব্দে বেজে উঠল, ফোনটি রিসিভ করে আবেগে আক্রান্ত হয়ে গেলাম আমি, ফোন করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এটি সম্ভবত আমার জীবনে রিসিভ করা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি টেলিফোন কল। হুমায়ূন আহমেদ ফোন করে একটানা ১৭ মিনিট কথা বললেন। ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং স্বীকার করলেন, তাঁর দেখা মিসির আলির সঙ্গে আমার বানানো মিসির আলির অনেক মিল আছে।

সেই থেকে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার একধরনের পথচলার শুরু। এখন হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে নেই, তাই স্মৃতিচারণাই একমাত্র অবলম্বন। এই সূত্রে আরেকটা বেদনামধুর স্মৃতি বলে ফেলি। 

তখন চলছিল রোজার মাস। দীর্ঘদিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। আমার বন্ধু, বড় ভাই স্বাধীন খসরু আমাকে নিয়ে গেল নুহাশপল্লীতে। প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে তখন, হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লীর পুকুরপাড়ে তাঁর একটি ঈদের নাটকের শুটিং করছেন। আমি গিয়ে সেখানে পৌঁছালাম, মেকআপম্যান খলিল ভাই হুমায়ূন আহমেদকে জানালেন যে আমি এসেছি। আমাকে দেখে অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে স্বাগত জানালেন হুমায়ূন আহমেদ। তারপর ইফতার শুরু হলো। সেখানে ইউনিটের সবাই ছাড়াও প্রায় ৭০ জনের মতো গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম, সবার জন্য একই রকম খাবারের ব্যবস্থা রেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি যেহেতু খিচুড়ি এবং খাসির মাংস খেতে খুব ভালোবাসতেন, সুতরাং ইফতারে সবাইকে তিনি সেই খাবার খাওয়ালেন। লোকদেখানোর ব্যাপারটা তাঁর মধ্যে ছিল না। খাবার খাওয়ার পর সন্ধ্যা নামল। স্বভাবতই পুনরায় শুটিং শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু না। আমার যাওয়া উপলক্ষে হুমায়ূন আহমেদ শুটিংয়ে বিরতি দিলেন। স্বাধীন খসরু ও হুমায়ূন আহমেদসহ একটি ঘরে আড্ডা মারতে বসলাম আমরা। আবোল-তাবোল নানা বিষয়ে আড্ডা চলছে। বেশির ভাগ কথা হুমায়ূন আহমেদই বলছেন, আমরা হাসছি, আবার কখনো আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, হুমায়ূন আহমেদের চোখের কোনায় জল এসে জড়ো হয়েছে। তিনি কাঁদছেন। কারণ, জানতে চাওয়ার মতো সাহস পাচ্ছিলাম না। অতঃপর তিনি নিজেই অকপটে বললেন, তাঁর অত্যন্ত প্রিয় সন্তান, শিলা আহমেদের আজ সন্তান হয়েছে। অথচ তাঁকে জানানো হয়নি। বিষয়টি তাঁকে খুবই আহত করেছে, কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তাঁর মনের আবেগ প্রকাশ করতে পারছিলেন না। হয়তো আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনের অজান্তের দুঃখ চোখের জল হয়ে নেমে এসেছে। 

খুব অসময়ে মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। ক্ষণজন্মা এই মানুষের মৃত্যুসংবাদ যখন এসে আমার কাছে পৌঁছায়, তখন মধ্যদুপুরে আমি, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ ও অভিনেত্রী ফারাহ রুমা একটি শুটিং শেষ করে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তখন তুমুল বৃষ্টি। হঠাৎ একটা কল এল মাহফুজ ভাইয়ের ফোনে। জানতে পারলাম, আমাদের প্রিয় হুমায়ূন ভাই আর নেই। সেদিন গাড়ির ভেতরে আমি আর মাহফুজ ভাই নিঃশব্দে কেঁদেছিলাম, বাইরের বৃষ্টির কান্নাকে সাক্ষী রেখে।