ওয়ালীউল্লাহ্কে কি টপকানো গেল
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলাদেশের সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রজন্মের কথাসাহিত্যিক। তাঁর আগের প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে থাকবেন মোজাম্মেল হক, নজিবর রহমান, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী ইমদাদুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন প্রমুখ। নামগুলো উচ্চারণমাত্রই বাংলাদেশের, বিশেষত উপন্যাসের ক্রম অগ্রগতি বোঝা যায়। তাঁদের হাত ধরে এখানকার উপন্যাস সমাজ সংস্কার থেকে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে শিল্পিতার পাটাতনের দিকে। কিন্তু শিল্প তখনো আয়ত্তে আসেনি। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে গল্প-কাহিনি আর চরিত্র নির্মাণের পেরেশানির মধ্যেই থেকেছে। অনেকটা কোনোমতে কাছা সামলানোর অবস্থা।
অথচ এরই মধ্যে বাংলা উপন্যাস এগিয়ে গেছে বেশ দূর। রোমান্স আর ইতিহাসের সদর রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে জীবনের বায়ান্ন গলিতে; বড়লোকের এলাকা ছেড়ে আসর জমিয়ে বসেছে জেলেপল্লি, বেদেপল্লি থেকে শুরু করে হুল্লোড় তোলা বেশ্যাপল্লিতে; গরিব মানুষদের তল্লাটে তল্লাটে। প্রথাগত কাহিনি থেকে উপন্যাস এরই মধ্যে ডুব দিয়েছে চরিত্রদের মনের গহনে। এই হিসেবে বাংলাদেশের উপন্যাস একটি পিছিয়ে পড়া বর্গ হিসেবেই গোবৎসের মতো আছাড়পাছাড় খেয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের উপন্যাসের এই প্রচেষ্টাযুগের অতি অগ্রসর কথাসাহিত্যিকের নাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। বয়ঃক্রমের বিবেচনায় তিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের কথাসাহিত্যিক হলেও শিল্পিতার প্রশ্নে আরও পরের মানুষ। এ কারণে তাঁর আগে–পরের কত কত কথাসাহিত্যিকের নাম শুধু ঐতিহাসিক উল্লেখের ব্রাকেটে বন্দী হয়ে গেল। অথচ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরও এত উজ্জ্বল।
শিল্পসচেতনতার প্রশ্নে ওয়ালীউল্লাহ্ বোধ করি বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রথম প্রস্তুত লেখক। তিনি বিশ্ব কথাসাহিত্য ও বাংলা কথাসাহিত্যের ভেতর-বাহির পর্যবেক্ষণ করে, চোখ-কান খোলা রেখে সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শুরুই করেছেন আটঘাট বেঁধে। ১৯৪৫ সালের প্রথম দিককার কথা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসের ছাত্র তিনি। তখন তাঁর বন্ধু সৈয়দ নুরুদ্দীনকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘ঢাকা থেকে এসে প্রথম একচোট ভুগলাম ফ্লুতে। অবশ্য সে ভোগার প্রতিদানস্বরূপ লাভ করেছি কটা ভালো বই, যেমন—ফল অব প্যারিস (ইলিয়া ইরেনবুর্গের), লেনিউড লেন্ডনিভের ইনভেনশন, অচিন্ত্যবাবুর সে-বইখানা, ডে লুইর ওয়ার্ল্ড ওভারঅল, সুবোধ বাবুর শুক্লাভিসার ইত্যাদি। তারপর ভালো হয়ে উঠে কারমাইকেল ছেড়ে বাসায় উপন্যাসটা (লালসালু) লিখছি।’ বোঝাই যাচ্ছে, তিনি উপন্যাস-গল্প লেখা শুরু করেছিলেন একেবারে মালকোচা দিয়ে। ওয়ালীউল্লাহ্গবেষক সৈয়দ আকরম হোসেন ওই চিঠির গ্রন্থতালিকা থেকে মন্তব্য করেছেন, ‘অসুস্থ অবস্থায় বই পড়ার দৃষ্টান্ত যদি এই হয়, তবে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গ্রন্থ অধ্যয়নে কী পরিমাণ শ্রম-অকাতর ও স্বচ্ছন্দ ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পাঠাভ্যাস তাঁকে শুরু থেকেই উপন্যাস ও ছোটগল্পের আঙ্গিক, বিষয়বস্তু, ভাষার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে আর ভাবনাশীল করে তুলেছিল। যেমন সাহিত্যজীবনের একেবারে শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মুসলমান সমাজ নিয়ে লিখবেন। কাজি আফসারউদ্দিন আহমদকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, ‘I want to write মুসলমান সমাজ নিয়ে—আমার সমগ্র মনের ইচ্ছে সেদিকপানে। এ–ও একরকম passion থেকে সৃষ্ট।’ সৈয়দ আলী আহসান প্যারিসে একবার আলাপ করছিলেন ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে। আলাপের এক ফাঁকে আলী আহসান ওয়ালীউল্লাহ্কে তাঁর চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ বলেন, চাঁদের অমাবস্যার ভাষায় জড়তা আছে, ভাষা যেন সহজে অগ্রসর হতে চায় না।’ উত্তরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বলেছিলেন, ‘এ বইয়ের ভাষা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই ফলটারিং (faltering) করেছি। দ্বিধাগ্রস্ত যুবক-শিক্ষকের বিলম্বিত চেতনাকে ফুটিয়ে তুলবার জন্য কিছুটা হোঁচট খাওয়ার মতো ভঙ্গি তৈরি করতে হয়েছে। আমি অবশ্য আরও জটিল করতে পারতাম ফকনারের দ্য সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরির মতো, কিন্তু ইংরেজি বিশেষ করে গদ্যভাষা যে সমস্ত শিল্পগত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, বাংলা তো তা নয়, বাংলা লিখিত গদ্যের চলাচলও দীর্ঘ নয়। তাই একটি সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাকে কাজ করতে হয়েছে।
একবার ভেবেছিলাম, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্যভঙ্গির সঙ্গে আধুনিক গদ্যভঙ্গির মিশ্রণ ঘটিয়ে চরিত্রের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে স্পষ্ট করব, কিন্তু গল্পের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবার ভয়ে সেদিকে অগ্রসর হইনি।’ দীর্ঘ এই বক্তব্য উপন্যাস নিয়ে তাঁর পঠন-পাঠন আর ভাবনাচিন্তার দারুণ এক প্রমাণ।
ভাবনা মোতাবেক মুসলমান সমাজ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখলেন ওয়ালীউল্লাহ্। কিন্তু শিল্পের প্রশ্নে তিনি পূর্বসূরিদের পথে পা বাড়াননি। মুসলমান সমাজের অধঃপতন বা জাগরণের চিত্র দেখাতে যাননি। নিটল চরিত্র নির্মাণের সাধনায়ও রত হননি। মুসলমান সমাজের চিত্রের মধ্যেই তিনি আধুনিক জীবনবীক্ষাকে রূপায়ণ করেছেন।
সব বড় সাহিত্যিকেরই জীবনকে দেখার নিজস্ব একটা ভঙ্গি থাকে। ওয়ালীউল্লাহরও ছিল। অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেলে মানুষ কী করে, কেমন হয়, তার ভাবনাপ্রক্রিয়া, দেহমনের অভিব্যক্তিই বা কেমন হয়—এসবের রূপায়ণ করতে তিনি পছন্দ করতেন।
এ কথা তাঁর ছোটগল্প ‘নয়নচারা’ থেকে শুরু করে কাঁদো নদী কাঁদো পর্যন্ত সব সাহিত্যের ক্ষেত্রেই সত্য। লালসালু উপন্যাসের মজিদের কথাই ধরা যাক। সে আসলে জীবনধারণের সংকটের আবর্তে হাবুডুবু খাওয়া বিপন্ন মানুষ। রুটিরুজির ব্যবস্থা করে ঠিকমতো টিকে থাকাই তার জন্য মুশকিল। ফলে মজিদ তার যে যোগ্যতা—একটু আরবি জানা আর ধর্মীয় জ্ঞান—তা–ই নিয়েই অস্তিত্বের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উন্নতিও করে। সমাজে তার দাপট তৈরি হয়, মাঝেমধ্যে সরদারি হারানোর ভয়েও ভীত থাকে। আবার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ধর্মবোধেও তার লাগে। ফলে প্রায়ই সে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে ফাঁকা মাঠের ধারে। দাড়িতে হাত বোলায়। মনে মনে বলে, খোদা সবই জানেন। নিশ্চয়ই তিনি গোনাখাতা মাফ করে দেবেন। অস্তিত্বের সংগ্রামে লিপ্ত দাপুটে কিন্তু ভীত এক চরিত্র। চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসও অস্তিত্বের সংকটে পড়া আরেফ আলীর আখ্যান। কাঁদো নদী কাঁদোর মুহাম্মদ মুস্তফাও তা–ই। একই কথা খাটে ওয়ালীউল্লাহর নাটকগুলোর ক্ষেত্রেও।
তবে ক্রমে দেখা গেল, সাধারণ অস্তিত্বসংকট তাঁর সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী দর্শনে রূপান্তরিত হতে থাকল। এই দর্শনের জন্ম ইউরোপে। চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাস থেকে ওয়ালীউল্লাহ্ এই পথের পথিক হয়েছেন। চাঁদের অমাবস্যা থেকে তিনি পুরোনো পথে আর ফেরেননি; পশ্চিমের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন—বিষয়বস্তু ও ফর্ম—দুই দিক থেকেই। লক্ষণীয় হচ্ছে, শেষোক্ত সাহিত্যগুলো যখন তিনি লিখছেন, তখন তিনি অবস্থান করছেন ইউরোপে; দর্শনের তীর্থস্থান ফ্রান্সে।
তবু ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের মধ্যে বাংলাদেশের জনজীবন আর ভূগোলের একটা নিবিড় পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি যখন গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখছেন, তখনো বাংলাদেশ মূলত ‘নিম্নপেশা’র মানুষের দেশ। তাঁর সাহিত্যের চরিত্রদের শুধু পেশাগুলো দিয়েই শনাক্ত করা যায় যে এটা বাংলাদেশের মানুষের সাহিত্য। মাঝি, সারেং, খালাসি, কৃষক, মাজারের খাদেম, মোল্লা-মৌলভি, পীরসাহেব, মাস্টার—এই সব পেশাজীবীর কোলাহলে তাঁর সাহিত্য মুখর। লাটবেলাট বা উন্নত নাগরিক রুচির তেমন কেউ নয়।
আর নদী, বিল–ঝিল, বিস্তীর্ণ সমতলভূমি, বাঁশঝাড়সহ যে প্রাকৃতিক আবহ তিনি তৈরি করেন, তা বাংলাদেশের ভূগোলেরই দ্যোতক। ভাষার প্রশ্নে ওয়ালীউল্লাহ্ কলকাতাই সাহিত্যিক মানভাষার কাঠামোটিকে মান্য করলেও বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের চিত্রকে অবলম্বন করার কারণে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটকের ভাষাকে কলকাতার মানভাষা থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। তাঁর ভাষা বাংলাদেশের জনজীবনের স্বতন্ত্র বাগ্ভঙ্গির মৌতাত যেন।
মোদ্দাকথা, ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে একাধারে স্বদেশ আর বিদেশকে আলিঙ্গন করতে পেরেছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মগুলোর প্রাণ বাইরের আর ধড় দেশের। বাংলাদেশের সাহিত্যে অনেকেই আন্তর্জাতিকতাকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশের সাহিত্যে বাংলাদেশ নেই। ওয়ালীউল্লাহ্র মধ্যে দুটোই আছে। তাঁর অধিকাংশ বন্ধুবান্ধবের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, তিনি ইউরোপীয় ডাটের জীবনযাপন করতেন। কিন্তু দেশ সম্পর্কে একটা গভীর স্বচ্ছ ধারণা ছিল তাঁর মধ্যে। সৈয়দ আলী আহসানকে এক আলাপে বলেছেন, ‘আমি কিন্তু বিদেশে থেকেও আমার মানসলোকে দেশের অন্তরেই বাস করি। বরঞ্চ বলব, যতই দিন যাচ্ছে, ততই আমি বেশি করে দেশের অন্তর্লোকে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই চেষ্টা সর্বক্ষণ আমার মধ্যে রয়েছে।’
ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসে সবাই বিদেশি দর্শনের ছায়া খুঁজেছেন, খোঁজেন। কেবল বলেন না যে ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাস-গল্পের মধ্যে আকাঁড়াভাবে যে পরিমাণ বাংলাদেশ আছে, তা অন্যদের সাহিত্যে বিরল। বাংলাদেশের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের উপন্যাস-গল্প মূলত গ্রামজীবননির্ভর। কিন্তু সেই গ্রামের বয়ান-বর্ণনা এমনভাবে করা যেন শহরের কেউ গ্রাম দেখছেন। ভাষায়, চরিত্র চিত্রণ, অভিব্যক্তি কৃত্রিমতার চাদরে ঢাকা যেন। ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্য পড়লে মনে হয়, তিনি যেন বাংলাদেশের জনচৈতন্যের আঁতে বসে কথা বলছেন।
ওয়ালীউল্লাহর গল্প-উপন্যাসকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করা যাবে না বলে তাঁর উজ্জ্বলতা দিন দিন বাড়বে। শুধু বাংলাদেশের ভূগোলের উপস্থিতির কারণে নয়, অগ্রসর শিল্পচিন্তার কারণেও তাঁর উজ্জ্বলতা বাড়বে। কারও কারও কাছে একটু অত্যুক্তি মনে হলেও এ কথা বলা দরকার, বাংলাদেশের সমাজ ও সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ালীউল্লাহ্ এখনো অগ্রবর্তী আধুনিক বলেই মনে হয়। তিনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের প্রশ্নে জীবনানন্দ দাশের মতো। জীবনানন্দ দাশ দীর্ঘকাল বাংলা কবিতাকে প্রেরণা-প্রভাব জুগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য বোধ করি এখনো ওয়ালীউল্লাহ্কে টপকাতে পারেনি।