মনসুর আহমেদ চৌধুরীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আপন আলোয় দেখা ভুবন’। পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেওয়া মনসুর জীবনের সাতটি দশক পূর্ণ করেছেন। শৈশব থেকে এই বয়স পর্যন্ত কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে তাঁকে যেতে হয়েছে, তার বিশদ বর্ণনা রয়েছে এই বইয়ে। এই যে কথাগুলো বললাম, হয়তো যেকোনো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু মনসুরের আপন দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখা এবং আর দশজনের দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক। মনসুর একেবারে কম বয়সে বল খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারান। তাই তাঁর আর অন্যদের ‘দেখা’র বিশেষত্ব একেবারেই ভিন্ন।
বইটিতে মনসুর তাঁর কথা শুরু করেছেন নিজের পারিবারিক পরিচয় দিয়ে এবং সেই সূত্রে যাঁদের সঙ্গে তাঁর আসা–যাওয়া, সামাজিক আদান–প্রদানের সম্পর্ক, তাঁদের প্রসঙ্গও এসেছে। সেই সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে খুব কমসংখ্যক বাঙালি প্রশাসন বা সমাজের উল্লেখযোগ্য স্তরে পৌঁছাতে পারতেন। মনসুরের বইয়ে যাঁদের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তাঁদের অনেকেই নাগরিক সমাজে সুপরিচিত ছিলেন। তাই তাঁদের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজটাকে কিছুটা হলেও চেনার অবকাশ ঘটে। সেই আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহেই কেটেছে মনসুরের জীবনযাত্রা।
সেই পাকিস্তান আমলে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বালক কীভাবে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় একা একা লড়াই করে সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠে পৌঁছে যান, তা যেকোনো পাঠকের মনে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। মনসুরের কথায়ই জানতে পারি, সে সময় প্রতিবন্ধী মানুষদের অসুবিধা, অস্বস্তি অথবা নিরাপত্তাবোধের অভাব নিয়ে সমাজে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা শুরু হয়নি। বরং তাঁদের অস্তিত্ব যত কম প্রকাশ করা যায়, সেই চেষ্টাই চলত, এমনকি পারিবারিকভাবেও। সেখানে মনসুরের পরিবার, বিশেষত তাঁর মা-বাবার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। প্রতিটি মুহূর্তে তাঁরা মনসুরকে সাহস ও সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। নানা পর্যায়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে বাধা এসেছে, এসেছে প্রত্যাখ্যান। আবার সেসব প্রতিষ্ঠানেরই ভেতর থেকে পেয়েছেন সহৃদয় সহমর্মিতা, হাত ধরার হাত।
প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা মনসুরের বইটিতে শিক্ষণীয় এবং অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে। আছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিকূলতার কথা। কিন্তু মনসুর তাঁর অভিজ্ঞতার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে দেখিয়েছেন, ব্যক্তির সদিচ্ছা, সাহস আর চিত্তের দৃঢ়তা দিয়ে কীভাবে সব বাধা অতিক্রম করা যায়। একই সঙ্গে তিনি সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা বলতেও ভুলে যাননি। তবে এসব বাধা কাটিয়ে ওঠার বিষয়টা যে মোটেও সহজ নয়, তা-ও তিনি বলেছেন প্রতিবন্ধী মানুষদের অন্তহীন লড়াইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে।
এবার আসি তাঁর ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের কথায়। রোটারি ক্লাবের বিশেষ বিদ্যালয়ে পাঠ শুরু করে ঢাকা কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন মনসুর। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে তখন ব্রেইল পদ্ধতি তেমন সহজলভ্য ছিল না। অধিকাংশ সময় অন্যের কণ্ঠ শুনে শুনে পড়া তৈরি করতেন তিনি। একেকটি ধাপ পেরিয়ে মূলত আপন যোগ্যতা এবং ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার সুযোগ পান মনসুর। শুধু নিজের জন্য নয়, নানাভাবে তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের সুযোগ-সুবিধা তৈরি ও সম্প্রসারণ এবং তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস কাজ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচিত নেতা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত—সর্বত্র নিজের অঙ্গীকারের প্রতি নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন মনসুর। যেসব দেশে তিনি গেছেন, সেসব দেশের মানুষজন, তাদের চালচলন, পোশাক-আশাক আর দ্রষ্টব্য স্থান ও স্থাপনার এমন নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন যে বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়, চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে সব।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পরিচালনায় মনসুরের দূরদর্শিতা ও পরিচালনার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষত, স্যার জন উইলসন বিদ্যালয় ও জীবনতরী ভাসমান হাসপাতালের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে মনসুরের ভূমিকা তাঁর কর্মজীবনের উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। ভুল চিকিৎসার কারণে তাঁর ছোট ভাইও বাক্ ও শ্রবণশক্তি হারান। তাই একই পরিবারে দুই প্রতিবন্ধী মানুষের ‘স্বাভাবিক’ জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের বিরল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এই আত্মজীবনীতে।
মনসুর তাঁর লেখায় সমসাময়িক আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও আঞ্চলিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ছবি এত স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেছেন, যা আমাদেরও বিষয়গুলোকে নতুনভাবে দেখতে অনুপ্রাণিত করে। বিশেষত, এখানে দেশবিভাগ, পাকিস্তানি শাসনামল, আন্দোলনের পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী সময় নিয়ে যে বিশ্লেষণ রয়েছে, তা-ও বিশেষভাবে অনুধাবনের দাবি রাখে। বইটিতে যেমন আছে মনসুরের সুখস্মৃতির বর্ণনা, তেমনই এক–এক করে প্রিয়জন হারানোর বেদনার্ত উচ্চারণও এতে গ্রন্থিত হয়েছে। মা-বাবা, বড় ও ছোট ভাই, ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ও কষ্টদায়ক ব্যাধিতে স্ত্রীবিয়োগ—সবকিছু মিলিয়ে এসব বিয়োগব্যথা বড় বেদনার মতো বাজে।
বর্তমানে একমাত্র ছেলে এবং তাঁর সংসার নিয়ে মনসুরের ব্যক্তিগত জীবন রচিত। ছেলে তাঁর বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গীর ভূমিকায় নিবেদিত। এই বই থেকেই জানতে পারি, মনসুর এখনো নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও সুরক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিজেকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
বইটির নাম মনসুর রেখেছেন ‘আপন আলোয় দেখা ভুবন’। তবে তিনি নিজের আলো দিয়ে ভুবনটাকে শুধু নিজেই দেখেননি, তার আলো দিয়ে অন্যকেও পৃথিবীটাকে দেখতে সাহায্য করেছেন।
সময় প্রকাশন বইটি প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। পাঠক এই বইয়ের মাধ্যমে লেখকের অন্তর্দৃষ্টির ছোঁয়া পাবেন নিশ্চিত।
......
আপন আলোয় দেখা ভুবন
মনসুর আহমেদ চৌধুরী
প্রকাশক: সময় প্রকাশন, প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২২, প্রচ্ছদ: মেধা রোশনান সারওয়ার, ৩৬৭ পৃষ্ঠা, দাম: ৭৬০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।