ছিলেন ‘বাবুর্চি’, ছড়া লিখে পেলেন একুশে পদক

জীবনের বহু ঘাট ঘুরে ৭৮ বছর পর নিজের পিতৃভিটায় ফিরেছেন শিশুসাহিত্যিক সুকুমার বড়ুয়া। সংগ্রামমুখর জীবনে একসময় ছিলেন মেসের বাবুর্চি। ফাঁকে ফাঁকে ছড়া লিখতেন। জীবনের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে এলেন ঢাকায়। তারপর? নাটকের চেয়েও নাটকীয় এক জীবন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার জীবনটি নাটকের চেয়েও নাটকীয়
ছবি: সৌরভ দাশ

ভেতরের ঘর থেকে একটি চার চাকাওয়ালা ‘ওয়াকার’ ধরে আমাদের সামনে এলেন মানুষটি। সুকুমার বড়ুয়ার খোঁজে আমরা যখন গহিন গ্রামে তাঁর ডেরায় এলাম, দেখলাম, কথা বলতে গেলে এই শিশুসাহিত্যিকের গলা এখন জড়িয়ে যায়। দুমুঠো ভাতের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে শিশুকালে যে ভিটাটি তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল, জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে তিনি এখন ফিরেছেন সেই ভিটায়। ১৯৪৪ সালের কথা। সুকুমারের বয়স তখন মাত্র ছয়। সেই বয়সেই শিশু সুকুমারকে ছাড়তে হয়েছিল নিজের বাড়ি।

তারপর পেরিয়ে গেল ৭৮ বছর। এর মধ্যে পৃথিবীর রং কত পাল্টাল, কত বাঁকবদল এবং পটপরিবর্তন হলো ইতিহাসের। আর ছড়ার ছন্দের তালে তালে জীবনযুদ্ধ ও রাজধানীর কোলাহলময় জীবন শেষে এ বছর সুকুমার বড়ুয়াও ফিরে এলেন পিতৃপুরুষের ভিটায়, চট্টগ্রামের রাউজানের মধ্যম বিনাজুরিতে দুই শতাব্দীর পুরোনো মিলনারাম বৌদ্ধবিহারের কাছের বাড়িটিতে।

৪ সেপ্টেম্বর রোববার চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে বিনাজুরির পিতৃপুরুষের ভিটায় পাওয়া গেল অন্য এক সুকুমার বড়ুয়াকে। রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের পথেরহাট থেকে উত্তরে কোলাহলমুক্ত নোয়াপাড়া। রাউজান সদরের রাস্তা ধরে গাঢ় সবুজের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো পুরো এলাকা যেন নির্জনতার ভেতর ডুব দিয়েছে। খাগতিয়া, ডোমখালী, মগদাই খালের পাড়ে পাড়ে ইবিলপুরের বিস্তীর্ণ মাঠ, চারপাশের ঘন গাছপালার ছায়াঢাকা পথঘাট পেরিয়ে যে বাড়িতে ঢুকলাম, সেটির সামনে একটা উঠান। এক পাশে একটি ঘর। সেখানে লেখা আছে ‘সুকুমার শিশু পাঠাগার’। উঠানের পূর্ব প্রান্তে দোতলা একটি সাদা পাকা বাড়ি। সেই বাড়ির ভেতরে বসে আছেন ছড়ার সম্রাট।

আলাপের পয়লাই জীবনের শুরুর দিনগুলোতে ফিরে গেলেন তিনি।

চট্টগ্রামের রাউজানের বিনাজুরিতে সুকুমার বড়ুয়ার দিন এখন কাটে নিজের স্নিগ্ধ–সবুজ দোতলা বাড়িতে
ছবি: সৌরভ দাশ

১৯৪৩ সালে। একদিকে তখন যুদ্ধের দামামা, অন্যদিকে মন্বন্তর। চারদিকে অভাব। সুকুমারের বয়স সে সময় ৫। বাবা সর্বানন্দ বড়ুয়া সরল মানুষ। অনটন এসে তাঁকে কাবু করে ফেলেছে। অবুঝ সুকুমারকে কী খেতে দেবেন? একদিন ঘরের একমাত্র বালতিটা বিক্রি করে কিছু খুদ আনলেন। সেদ্ধ খুদ খেয়ে পেট ভরল। এরপর কখনো ঢেঁকিশাক, কখনো-বা কলাগাছের থোড় আনা হলো। এমন করেই দিন কাটছিল। এর মধ্যে একদিন সর্বানন্দ হাতে দা নিয়ে বেরোলেন। শিশু সুকুমার ভাবছেন, আজ কী আনবে বাবা? অপেক্ষায় অপেক্ষায় দুপুরের রোদ ম্লান হলো। বিকেল গড়াল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর গেল। বাবা ফিরে এলেন না। সুকুমারের মা কিরণ বালা বলতেন, ‘দা হাতে লোকটা কোথায় চলে গেল?’

সেই কাহিনি বলতে গিয়ে সুকুমার বললেন, ‘এই ঘটনা ৮০ বছর আগের। এর মধ্যে জাতীয় জীবনে, আমার জীবনে অনেক কিছুই তো ঘটে গেল। উপমহাদেশে দুটি দেশের আবির্ভাব হলো ’৪৭ সালে। দুনিয়াকাঁপানো এক মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল। আর আমার জীবনও তো থেমে থাকেনি।’

নিজের বাড়িতে ওয়াকারে হাঁটছেন সুকুমার বড়ুয়া
ছবি: প্রথম আলো

অভাবের তাড়নায়, দুমুঠো ভাতের আশায় ছুটতে ছুটতে সুকুমার বড়ুয়া পেয়ে গিয়েছিলেন ছন্দের এক আশ্চর্য জাদুর কাঠি। ছন্দের সেই জাদুর কাঠি দিয়েই তো একের পর এক লিখেছিলেন কালজয়ী সব চরণগুচ্ছ:

‘অসময়ে মেহমান

ঘরে ঢুকে বসে যান

বোঝালাম ঝামেলার

যতগুলো দিক আছে

তিনি হেসে বললেন

ঠিক আছে ঠিক আছে।’

তাঁর ছড়া ও ছন্দের ভেতর এত আলো, এত বিস্ময়, এত গল্প—এগুলোই হয়তো তাঁকে ছড়া সম্রাটে পরিণত করেছে। কিন্তু সম্রাটের ভাব তাঁর মধ্যে নেই। দেহভাষায় সহজ-সরল অভিব্যক্তি। আদতে এই কীর্তিমানের সঙ্গে কথা বলার সময় যেন একজন শিশুর সঙ্গলাভের অভিজ্ঞতা হয়। বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য সম্মাননা, আলাওল শিশু সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পদকের পালকে খচিত তাঁর মুকুট। অথচ আলাপসালাপে এসবের কিছুই বোঝার জো নেই। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘এত দিন পর বাড়িতে ফিরে এলেন কেন?’

‘সুযোগ থাকলে অনেক আগেই ফিরতাম।’ সুকুমার জবাব দিলেন, ‘বাড়ি তো আমার ছিল না। অভাব আগুনের মতো কেড়ে নিয়েছে সব। নতুন এ বাড়ি আমার ছেলে দুই বছর আগে তৈরি করেছে। আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করল ছেলে। এখানে শিশুদের জন্য একটি লাইব্রেরি করেছি। তারা পড়বে। একটা বই একটা শিশুর জীবন বদলে দিতে পারে, আমার যেমন দিয়েছে।’

আমাদের প্রশ্নে প্রশ্নে ততক্ষণে স্মৃতির ঝাঁপি না মেলে সুকুমার বড়ুয়ার আর উপায় কী। ছড়ার লেখা কীভাবে শুরু করলেন? বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কীভাবে চলল জীবন?—প্রশ্ন আর প্রশ্ন। উত্তর দিতে দিতে সুকুমার বলে চললেন নিজের জীবনকাহিনি, যা আসলে নাটকের চেয়েও নাটকীয়।

বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর মা কিরণ বালা তাঁকে নিয়ে উত্তর গুজরায় মামাবাড়িতে চলে যান। তাঁরাও খুব গরিব ছিলেন। মামা ছিলেন পুলিশের কনস্টেবল। তাঁর পাঠানো দেড় টাকায় চলত পুরো পরিবার। ওখানে থেকেই তিনি প্রথম শ্রেণি পেরোন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেননি। তাঁর মা তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বৌদ্ধবিহারে। সেখানে পড়ালেখা, খাওয়াদাওয়া ও থাকার নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকা হলো না। সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হলেন সুকুমার, ‘বিহারের প্রধান বড় রাগী ছিলেন। কথায় কথায় পেটাতেন। একদিন সামান্য কথার ভুলে এমন মার দিলেন যে আমার মাথা ফেটে গেল।’ নিজের হাতটি মাথার ওপর তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘এখনো সেই দাগ আছে।’ অধ্যক্ষের পিটুনি সহ্য করতে না পেরে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সুকুমার মায়ের কাছে ফিরে যান। মা তাঁকে শিখিয়ে দিলেন, ‘বিহার থেকে নিতে এলে তুই বলবি, উপবাসে মরে যাব, তবু যাব না।’

সুকুমার মায়ের শিখিয়ে দেওয়া কথায়ই বলেছিলেন।

বাড়ির আঙিনায় শিশুদের জন্য সুকুমার বড়ুয়া গড়ে তুলেছেন ‘সুকুমার শিশু পাঠাগার’
ছবি: প্রথম আলো

এরপর ভাগ্য তাঁকে কত মানুষের ঘরে, কত ঘাটে যে নিয়ে গেছে, তার বর্ণনা বড় করুণ। গ্রাম থেকে শহরে এলেন। সুকুমারের পুঁজি সে সময় আড়াই ক্লাস—পড়তে পারেন, লিখতে পারেন। শুরু করলেন জীবনযুদ্ধ—কখনো গৃহকর্মী, কখনো-বা বাবুর্চি হিসেবে কাজ করলেন। সেই সব কাজের ফাঁকে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতেন। ছোটদের পাতায় নিজের অজান্তেই ডুবে যেতেন। সুকুমার বললেন, ‘বিহার থেকে চলে আসার পর একটা বাড়িতে থেকেছিলাম। ওরা খুব ভালো ছিল। আমার বয়সী তাদের একটা ছেলে ছিল। ওদের বাড়িতে ছিল অনেক বই। আমি সেগুলো পড়তে শুরু করলাম। গ্রামে মনসার পুঁথিপাঠ হতো। সেগুলোর সুর আর ছন্দ খুব টানত। কিন্তু ওরা আমাকে তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষাটা দিতে দিল না।’

স্কুলে গিয়ে পড়া আর হলো না সুকুমার বড়ুয়ার। তবে বই পড়া থামল না। একদিন তাঁর হাতে এসে পড়ল সুনির্মল বসুর হুলুস্থুল নামের একটা বই। সেই বইয়ের ছন্দের আনন্দে, ভাষার সৌন্দর্যে তিনি এতই মগ্ন হয়ে গেলেন যে পুরো বই মুখস্থ করে ফেললেন। এরপর হাতে এল যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুশি। সেটিও ঠোঁটস্থ হলো। ছড়ার ছন্দে রক্ত টগবগ করে উঠল তাঁর ভেতরে। একদিন হঠাৎই কথায় কথায় তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে এল একটা নতুন ছড়া। এ ছড়া কোনো বইয়ে নেই। তখন থেকে হামেশাই মুখে মুখে ছড়া বাঁধতে লাগলেন তিনি। তখন তিনি নিয়মিত পড়তেন দৈনিক আজাদ-এর ‘মুকুলের মাহফিল’, সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’, কলকাতার সাহিত্য কুটিরের ‘শিশু সাহিত্য’। একদিন হঠাৎ ইত্তেফাক-এর ‘কচিকাঁচার আসর’ ও সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’-এ লেখা পাঠালেন।

খেলাঘরে একটি লেখা ছাপাও হয়ে গেল। ছড়ার নাম ‘বৃষ্টি নেমে আয়’। সেটা ১৯৬৮ সালের ৩ জুলাই। পরিচিত মানুষেরা জানল, বাসাবাড়ি বা মেসবাড়ির বাবুর্চি সুকুমারের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়। এ সময় কেউ কেউ তাঁকে বাবুর্চির কাজ ছেড়ে পড়ালেখা করতে বলল। কিন্তু খাওয়াদাওয়াসহ তখন তাঁর আয় মাসে ১৫-১৬ টাকা। এমন সুযোগ কে দেবে?

রাজধানীর কোলাহল পেরিয়ে নিজের বাড়িতে হরহামেশায় আজকাল সুকুমার বড়ুয়ার মুখে ফুটে ওঠে এমন হাসির ঝলকানি
ছবি: সৌরভ দাশ

সুকুমার একদিন জমানা পত্রিকার সম্পাদক, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের কাছে গেলেন একটি দীর্ঘ ছড়া নিয়ে। তিনি সুকুমারকে বললেন, ‘যখন বাবুর্চির কাজ করবে, তখন ঠিকঠাকমতো করবে। আর যখন লিখতে বসবে, তখন তুমি পৃথিবীর আর সব বড় কবির মতোই।’ সে কথা মনে রেখেই বাবুর্চি হিসেবে রান্না আর ছড়াকার হিসেবে লেখালেখি চালাতে লাগলেন। একদিন শুনতে পেলেন, ঢাকায় নাকি বাবুর্চির কাজে বেতন বেশি। আবার পত্রিকায় লেখার সুযোগও বেশি। তাই ১৯৬০ সালের একদিন ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম ছাড়লেন সুকুমার বড়ুয়া। সেই থেকে ২০২১ পর্যন্ত ঢাকাতেই থাকলেন।

এই ছড়াকারের ঢাকার জীবন অনেকের জানা। প্রথম দুই বছর বিভিন্ন মেসে বাবুর্চির কাজ করেছেন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন।

স্ত্রী ননীবালার সঙ্গে নিজের ঘরে সুকুমার বড়ুয়া
ছবি: প্রথম আলো

তাঁর লেখা ১৮টি বইয়ের মধ্যে প্রথম বই পাগলা ঘোড়া প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে । এ বই প্রকাশের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমার কয়েকটি ছড়া পড়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি একটা চিঠি লিখে দিয়ে আমাকে বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের কাছে পাঠালেন। তিনিই বাংলা একাডেমি থেকে বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ বইয়ের সম্মানী হিসেবে ৩৬০ টাকাটা পেয়েছি। অ-নে-ক টাকা। একসঙ্গে এত টাকা পেয়ে বউয়ের জন্য অলংকার কিনে ফেলেছিলাম।’

রাজধানীর কোলাহল, চাকরির ব্যস্ততা, লেখালেখির মগ্নতা—সব ছেড়ে শূন্য থেকে উঠে আসা পূর্ণ সুকুমার বড়ুয়ার এখন দিন কাটে বিনাজুরির শান্ত সবুজের ভেতরে।

লিখছেন না কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১০০ পৃষ্ঠা বই পড়লে এক পাতা লেখা যায়। পড়তে তো পারছি না। লিখব কী করে? শরীর তো আর সমর্থন করে না।’—এটুকু বলে বাইরের উঠানের দিকে উদাস চোখে তাকান।

তাঁর চোখ যেন বহু বছর আগে একটা লোকের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছে।