বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, ভ্রমণ ও রসসাহিত্যের রাজা সৈয়দ মুজতবা আলী তরুণ বয়স থেকেই খুব পণ্ডিত লোক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই পড়ার প্রতি তাঁর একটা অমোঘ টান ছিল। পারিবারিকভাবে তাঁদের সবার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসও ছিল। তবে অন্য লেখকদের চেয়ে মুজতবা আলী ছিলেন কিছুটা ভিন্ন। বেশ খানিকটা বয়স হওয়ার পরই লেখালেখিতে নিয়মিত হন তিনি। ছাত্রাবস্থায় মুজতবা আলীর লেখা বিশ্বভারতীর দেয়ালিকায় ছাপা হলেও তাঁর প্রথম বই ছাপা হয় অনেক দেরিতে।
জীবনের প্রথম ভাগে তিনি খুব বাকপটু আর আড্ডাবাজ হিসেবে পরিচিতি পেলেও লেখালেখিতে ছিলেন বেজায় অলস। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখক হওয়ার পেছনে আছে অন্য রকম একটা গল্প।
জীবনের প্রথম বই রচনার পটভূমি জানাতে গিয়ে তাঁর একান্ত সহচর গোলাম মোস্তাকিমকে এ লেখক বলেন, বড় ভাই সৈয়দ মোস্তফা আলীর বড় মেয়ে জাহানারার অনুপ্রেরণাতেই বই লিখতে উৎসাহী হন তিনি।
জার্মানি থেকে পিএইচডি করার পর মুজতবা আলী তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কলকাতায় ও মৌলভীবাজারে কিছুদিন কাটান। এ সময় তিনি বিভিন্ন দেশ ও ভাষা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলে বেড়াতেন। তাঁর এসব গল্পের গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাঁর বড় ভাইয়ের মেয়ে জাহানারা। মুজতবা আলী মাঝেমধ্যে বিভিন্ন লেখকের সমালোচনা করতেন। ভাতিজি জাহানারার সামনে কোনো বাংলা বই বা লেখক সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের মন্তব্য করলে তিনি বলতেন, ‘ছোট চাচা যদি এতটা জানেন, তাহলে নিজে একটা বই লিখলেই পারেন।’ মুজতবা তখন পর্যন্ত কোনো বই লেখেননি বলে জাহানারা তাঁকে পণ্ডিত মানতে নারাজ ছিলেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্য, ‘সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে জাহানারার সঙ্গে আমার আলাপ হতো। তার সঙ্গে তর্ক করে আমি কখনোই জিততে পারিনি।’ বেঙ্গালুরুতে বসবাসের সময় ভাতিজির কথার খোঁচা আর অনুপ্রেরণায় দেশে–বিদেশে বইটি লিখতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বইটি শেষ করে সেটি আর ভাতিজিকে দেখাতে পারেননি মুজতবা। দেশে–বিদেশে ছাপা হওয়ার আগেই জাহানার মারা যান।
তাই মুজতবা আলী আক্ষেপ করে বলতেন, ‘মনের ভেতর একটা জিদ কাজ করছিল। কাজেই জাহানারা বেঁচে থাকলে বইটা লিখেই আমি দেশে ছুটে গিয়ে তাকে বলতাম, এই দেখ্, আমি একটা বই লিখেছি। এবার তুই কী বলিস! কিন্তু জাহানারার অকালমৃত্যু আমাকে সে সুযোগ দিল না।’
● গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন
সূত্র: গোলাম মোস্তাকিমের বই সৈয়দ মুজতবা আলী: প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ