বইমেলায় যাওয়ার আগে যে ১২টি তথ্য জানতেই হবে

জমে উঠেছে বইমেলা। প্রিয় লেখকদের বইয়ের খোঁজে অনেকেই ঢুঁ দিতে শুরু করেছেন লেখক–পাঠককের এই মিলনকেন্দ্রে। 

তবে বইমেলায় যাওয়ার আগে, বই কেনার আগে পাঠকেরা কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে পারেন, তা জানাতেই এই লেখা।

বইমেলা এখন পাঠকের পদভারে সরগরম। তালিকা করে বই কিনতে শুরু করেছেন অনেকেই
ছবি: আশরাফুল আলম

পনেরো দিন বয়সের শিশুকে কাঁধে নিয়ে মা–বাবা আসেন বইমেলায়। মায়ের স্পর্শের মতো বইয়ের ছোঁয়াও যেন শিশুটি পায়। ধুলায়–রোদে বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে না তো! আমার মায়া লাগে! আমার মন কেমন করে! এক বছরের বাচ্চা, দুই–বছরের বাচ্চাকে নিয়ে মা–বাবারা বইমেলায় স্টলে স্টলে ঘুরছেন, এ আমরা রোজই দেখি। সবচেয়ে বেশি দেখি, স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে এসেছে পুরো পরিবার। বই না পড়লে আমাদের সন্তানেরা মানুষ হবে না, এটা আমরা জেনে গেছি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘পৃথিবীর পুস্তকসাধারণকে পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক, প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। টেক্সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত হয়, তাহাকে শেষোক্ত শ্রেণিতে গণ্য করিলে অন্যায় বিচার করা হয় না।’ স্কুল–কলেজের বইগুলো অপাঠ্য, বাকি সব বই–ই পাঠ্য, রবীন্দ্রনাথের কথা। কাজেই অভিভাবকেরা মেলায় আসেন, শিশু–কিশোরেরা আসে। তাঁরা বই কিনতে চান।

আমি বইমেলায় প্রথম যাই ১৯৮৪ সালে। মানে ৩৯ বছরের পুরোনো পাপী হলাম আমি। এর মধ্যে চুল পেকে গেছে, ডেন্টিস্টের পেছনে ফি–মাসে খরচা করতে হচ্ছে, আমি এখন পরামর্শ দেওয়ার বয়সে পৌঁছে গেছি বলে দাবি করতে পারি। কাজেই বইমেলায় যাওয়ার আগে আপনার যে ১২ বিষয় জানা জরুরি, তা আমি লিখতেই পারি।

১২ 

বইমেলা কর্মদিবসে শুরু হয় বেলা তিনটায়। ছুটির দিনে মেলার দ্বার খোলে বেলা ১১টায়। চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। সাড়ে আটটার পর ঢোকার গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আপনি যদি সপরিবার যেতে চান, ভিড়ভাট্টা এড়াতে চান, নারী–শিশু নিয়ে চলতে গিয়ে কোনো হইহল্লার মধ্যে পড়তে না চান, আমার পরামর্শ হলো, ছুটির দিন বিকেলটা এড়িয়ে চলুন। শুক্রবার, শনিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় গেলে ভিড়ের জন্য সময় নিয়ে বই নেড়েচেড়ে কিনতে পারবেন না। শুক্র ও শনিবার সকালে অবশ্য যাওয়া যায়, শিশুপ্রহরে শিশু চত্বরে নানা আয়োজন থাকে। মন্দ না।

১১ 

বইমেলা বাংলা একাডেমি চত্বর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলিয়েই হচ্ছে। মূলমঞ্চ বাংলা একাডেমিতে। আর সেখানে আছে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল। জনপ্রিয় ও পেশাদার প্রকাশকেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মোড়ক উন্মোচন কিংবা লেখক বলছি মঞ্চও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। আপনি যদি প্রথমা প্রকাশন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সময় প্রকাশনী বা সেবা প্রকাশনীর স্টলে যেতে চান, আপনাকে উদ্যান অংশে যেতে হবে।

১০ 

টিএসসি দিয়ে কিংবা দোয়েল চত্বর দিয়ে আপনি বইমেলার দিকে যেতে পারবেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার গেট আছে টিএসসির কাছে, রমনা মন্দিরের গেটে আর বাংলা একাডেমির গেটের উল্টো দিকে।

 

প্রকাশকেরা নিজেদের বই ছাড়া অন্য প্রকাশনীর বই বিক্রি করতে পারেন না। কাজেই আপনাকে আগে থেকে জানতে হবে, আপনি কোন বই কিনতে চান, তার প্রকাশক কে, সেই প্রকাশকের স্টলটা কোন জায়গায়। এ জন্য বইমেলায় যাওয়ার আগেই আপনি একটা কাগজে নোট নিন। বইয়ের তালিকায় অবশ্যই প্রকাশকের নাম থাকতে হবে। যেমন আপনি শাহীন আখতারের এক শ এক রাতের গল্প বইটি পাবেন প্রথমায়। আবার একই লেখকের তালাশ বইটি পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে মাওলা ব্রাদার্সে।

 

মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে চিন্তামূলক বইয়ের জন্য বিখ্যাত হলো প্রথমা। কথাসাহিত্য, কিশোরদের বই, বিচিত্র বিষয়ের বইও পাওয়া যায় এই প্রকাশনা সংস্থায়। অনুবাদের বই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে ঐতিহ্যে। সন্দেশও অনুবাদ বের করে থাকে। গল্পগুচ্ছ, সঞ্চয়িতা, জীবনানন্দ–নজরুলের মতো ধ্রুপদি বইয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো প্রতীক/অবসর। নিশ্চিন্তে কিনতে পারেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত বই। সেবা প্রকাশনীর স্টলও আছে মেলায়। হুমায়ূন আহমেদের বই বের করে অনেকেই। অন্যপ্রকাশ, কাকলী, পার্ল, অন্বেষা, সময়, জ্ঞানকোষ, অনন্যা, কথাপ্রকাশ, বিদ্যাপ্রকাশে যেতে পারেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যের খোঁজে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই পাবেন সময়, তাম্রলিপি, পার্লসহ কয়েকটা প্রকাশনীতে। সাহিত্য প্রকাশ, কথাপ্রকাশ, ইউপিএল, বাতিঘর, আগামী, পাঞ্জেরী, পাঠক সমাবেশের স্টলে আপনার একবার ঢুঁ মারাই উচিত। সুন্দর ও মানসম্পন্ন বই পাবেন। আল মাহমুদ সমগ্র, শামসুর রাহমান সমগ্রর মতো ঢাউশ বই বের করে অনন্যা। বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়ন আছে একাধিক, অভিধানসহ অনেক ভালো বই আছে, দাম কম। যেমন বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা আমার দেখা নয়াচীন বাংলা একাডেমির বই। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইউপিএলের। সুন্দর বই হাতে নিতে যেতে পারেন জার্নিম্যানে। চৈতন্যর মতো ছোট প্রকাশনীগুলোও কিন্তু খুব সুন্দর সুন্দর বই বের করে থাকে। বিশ্লেষণাত্মক বই পাবেন সংহতিতেও। তরুণ কবিদের কবিতা পড়তে চাইলে আপনি যেতে পারেন ঐতিহ্য, বাতিঘর ও চৈতন্যর স্টলে।জহির রায়হানের বা বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের জন্য অনুপম প্রকাশনীর স্টলে যেতে পারেন।

আর শিশু চত্বরে গেলে পাবেন শিশুদের রঙিন বই। তবে বড় প্রকাশনীগুলোও শিশুদের বই বের করে থাকেন, কাজেই ছোটদের ভালো বই কোনটা কোন প্রকাশনীর জেনে রাখা ভালো। 

 

মেলায় লেখকদের মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। শুক্রবার সকালে মেলায় আসেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তিনি কোনো স্টলে বসেন না। ইমদাদুল হক মিলন বিকেলে আসেন অনন্যায়। মোহিত কামালকে পাওয়া যেতে পারে বিদ্যাপ্রকাশে। অনেক কবি–লেখকই মেলায় আসেন, ঘোরেন, ফেরেন। তরুণেরা তো আসেনই। আড্ডা দেন। বাংলা একাডেমির মঞ্চে আলোচনা করতে আসেন বিশিষ্টজনেরা, ‘লেখক বলছি’ মঞ্চেও হয় লেখক–পাঠক আড্ডা।

 

মেলায় শৌচাগার আছে। নামাজের জায়গা আছে। খাবারের স্টল আছে। খাবারের স্টলে দাম জেনে নিয়ে তারপর অর্ডার দেবেন। না হলে তিনটে বই কেনার টাকায় সামান্য খাবার খেয়ে পস্তাতে হতে পারে।

 

বিকাশের মাধ্যমে বইয়ের দাম পরিশোধ করা যায় এবং বিকাশে বই কিনলে ক্যাশব্যাকও পাওয়া যায়।

 

মেলায় তথ্যকেন্দ্র আছে। তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে কোন প্রকাশনী কোথায়, তা জেনে নেওয়া যেতে পারে।

 

পত্রিকা পড়ে, প্রকাশকদের ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুক পেজে গিয়ে, লেখকদের ফেসবুক পেজ থেকে বইয়ের খবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকেও ভালো বইয়ের খবর জানা যায়।

 

তরুণদের মধ্যে কারা ভালো লিখছেন, জেনে নিয়ে তাঁদের বই কিনতে পারেন।

 

বইমেলায় প্রচুর ভালো বই আছে। যে বই আমি পড়িনি, তা–ই নতুন বই। আমাদের প্রত্যেকের বাসায় সঞ্চয়িতা,সঞ্চিতা,বিষাদ–সিন্ধু, মানিক, জীবনানন্দ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, জসীমউদ্​দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের বই থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। কাজেই বইমেলায় আসুন, তবে আসার আগে হোমওয়ার্ক করে আসুন।