কেমন ছিল শেখ মুজিবের হৃদয়

আজ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ঘাতকের হাতে সপরিবার নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সাংবাদিক এ বি এম মূসার ‘মুজিব ভাই’ বই থেকে জানা যাক বঙ্গবন্ধুর এই বিশেষ গুণ সম্পর্কে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

শেখ মুজিবকে যাঁরা জানতেন, চিনতেন ও বুঝতেন, তাঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। আমিও কি পুরোপুরি জেনেছিলাম? যতটুকু জেনেছি ব্যক্তি মুজিবকে, জাতির পিতাকে, ততখানি অনুভব বা অনুধাবন করতে পারিনি। তবু আমার জানা, চেনা ও বোঝার বিষয়টিকে যতটুকু সম্ভব গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ, শেখ মুজিবকে নিয়ে আলোচনায় কখনো ব্যক্তি মুজিবকে পরিচিত করানো হয় না।

জাতির পিতা শেখ মুজিব, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিব, রাজনীতিবিদ ও একটি জাতিসত্তার প্রবক্তা, একটি স্বাধীন দেশের রূপকার, ব্যর্থ বা সফল প্রশাসক শেখ মুজিব আলোচিত হন, সমালোচিত হন, কিন্তু ব্যক্তি মুজিব খুব কমই প্রকাশ্য আলোচনায় এসেছেন। অথচ ব্যক্তি মুজিব, আমাদের ‘মুজিব ভাই’ এবং জনগণের ‘শ্যাখ সাব’!

আমার মতে, বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা অথবা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি নয়, ‘মুজিব ভাই,’ যাঁকে আমরা অনেকে শুধু ‘নেতা’ বলে সম্বোধন করতাম, তিনি ভিন্ন পরিমাপে আলোচিত হতে পারেন। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় আমি ব্যক্তিটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে বলেই তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন লিখেছি।

অনেক সময় দেখেছি, প্রয়াত মহান ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনায় ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে তাঁর কর্মপরিধি নিয়ে বেশি করে বক্তব্য দেওয়া হয়। অথচ ব্যক্তিগত গুণের কারণেই আমাদের দেশে নেতারা মহত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, সাধারণ মানুষের বুকে স্থান পেয়েছেন।

এ কথা আমাকে বলতে হবে না, তাঁকে যাঁরা জানতেন, চিনতেন, তাঁদের সবাই বলেন, শেখ মুজিবের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর বিরাট হৃদয়। কেউ কেউ বলেন, বিশেষ করে তাঁর সমসাময়িক কোনো কোনো রাজনীতিবিদ বলতেন, ‘শেখের মাথায় কিছু নেই, মুখের জোরে রাজনীতি করে গেল। জনগণের আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন’—এসব ঢালাও মন্তব্যের জবাবে বলতে হয়, এ দেশে নেতা হওয়ার জন্য একটিমাত্র বস্তুই অতীব প্রয়োজনীয়। তা হচ্ছে হৃদয়। বিরাট একটি হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। সর্বোপরি প্রয়োজন ক্যারিশমা, জনগণকে কাছে টানার, উদ্বেলিত করার, বিশেষ আদর্শে নেশাগ্রস্ত করার চুম্বকশক্তি অথবা জাদু। এ জন্য একটি বড়সড় ওজনদার কলিজা থাকতে হবে। শেখ মুজিবের তা ছিল।

শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, সি আর দাশ, মওলানা ভাসানীর অন্য গুণ থাকুক বা না থাকুক, সেটা ভিন্ন নিরিখে বিচার করতে হবে। তাঁদের ছিল বিরাট কলিজা, যাকে বলে দরাজ দিল। তাই ব্যক্তি মুজিবের আলোচনায় তাঁর বিরাট কলিজা তথা বিশাল হৃদয়ের কথাই বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলতে হবে বৈকি।

শেখ মুজিবের চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল দিকই ছিল এই নরম কলিজা। অনেকে বলেন, শেখ মুজিব জনগণকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, একটি জাতির জন্ম দিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই স্বাধীনতার পর নানা সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল।

নিজের জনগণের জন্য দিলটি খুলে দিয়েছিলেন ঠিকই; কিন্তু সমাজটিকে রাজনৈতিক ও প্রশাসিনক দক্ষতা, ক্ষমতা, ক্রূরতা ও কূটনৈতিক আচ্ছাদনের আড়ালে চাপা দিয়েছিলেন। এই বক্তব্য আমি বলব সঠিক ও বেঠিক, উভয় অর্থেই সত্য। আবার একই যুক্তিতে বলতে হয়, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে শেখ মুজিব ছাড়া অন্য আর কেউ পুনর্গঠিত করতে পারতেন না।

একটি রাজনৈতিক আঙিনায় বিভক্ত জাতিকে একই ছত্রচ্ছায়ায় শেখ মুজিব ছাড়া আর কেউ আনতে পারতেন না। এই একত্রীকরণে হয়তো কিছু কৃত্রিমতা ছিল। কিন্তু সেটুকুই-বা তিনি ছাড়া আর কে করতে পারতেন? উপরিউক্ত কর্তব্য সাধনে তিনি তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচয় ও ক্যারিশমা কাজে লাগিয়েছেন। আবার এ কথাও মানতে হবে যে রাষ্ট্র, সরকার ও দেশের পুনর্গঠনে শূন্য কোষাগার নিয়ে দুনিয়ার কেউ কোনো রাষ্ট্রের হাল ধরেননি, যেমনটি শেখ মুজিবকে করতে হয়েছে। ইরাক থেকে ভিক্ষা করে তেল এনেছেন, রাশিয়ানদের পটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পরিষ্কার করিয়েছেন ও মাঠঘাট থেকে মাইন সরিয়েছেন। একে-ওকে ধরে টাকাপয়সা এনে বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট, পুল, কল-কারখানা মেরামত করেছেন—এসবই হলো বাহ্যিক রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম।

এর বাইরে যে মহৎ আরও একটি উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছিল, সে কথা আগেও বলেছি। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকারের হাল না ধরলে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিত, সে কথা খুব কমই আলোচিত হয়। তিনি একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে দেশকে বাঁচিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাদের ফেরত পাঠিয়েছিলেন, এই তথ্য কেউ ইচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায় উদ্ধৃত করে থাকেন, কিন্তু দেশ ও জাতি যে ভয়ংকর বিশৃঙ্খল অবস্থা এড়িয়ে যেতে পেরেছিল, তা সাধারণত আলোচনায় আসে না। অথচ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে না ফিরলে যে রক্তের স্রোত বয়ে যেত, অনেকেই তা বুঝে থাকলেও বলেন না।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপরই দেশের সর্বত্র প্রতিশোধের পালা শুরু হয়েছিল। দেশের অন্যত্রও একটু-আধটু করে হত্যা, পাল্টা হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল। শেখ মুজিব দেশে ফিরে না এলে অন্য কারও পক্ষে তা বন্ধ করা সম্ভব হতো না। এখানেই শাসক মুজিবকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব শেখ সাহেবের, মুজিব ভাইয়ের আর অগণিত জনতার অবিসংবাদী নেতার।

শেখ মুজিবের চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল দিকই ছিল এই নরম কলিজা। অনেকে বলেন, শেখ মুজিব জনগণকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, একটি জাতির জন্ম দিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই স্বাধীনতার পর নানা সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল।

শুধু শেখ মুজিব ফিরে আসাতেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হলো কেন? কারণ, সবাই জানতেন, তিনি প্রতিশোধের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করবেন না। পরবর্তীকালে এই একটিমাত্র কারণে তাঁকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে। তাঁর আগমনের কারণে যাঁদের জীবন রক্ষা পেয়েছে, তাঁরাই তির্যক মন্তব্যের সঙ্গে প্রশ্ন করে থাকেন, কেন তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন? অথচ মুজিব ভাই পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসেই যাঁদের খোঁজখবর নিয়েছিলেন, তাঁরাই রাজনৈতিক জীবনে তাঁর পরম শত্রু ছিলেন কিংবা ছিলেন পরম সমালোচক। এমনই একজনের কাহিনি সেদিন আমি স্মৃতিসভায় বিস্তারিত বলেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ রকম বিরাট আত্মার পরিচয় পেয়েছেন তাঁর সমসাময়িক সব রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ। রাজাকারি কার্যকলাপের জন্য তাঁর প্রত্যাবর্তনের আগেই যাঁদের জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা বিষয়টি যতই অস্বীকার করুন, তাঁরা যে শেখ মুজিবের কারণেই জানে বেঁচে গিয়েছিলেন, জেল থেকে বের করে এনে তাঁদের খুন করা হয়নি, রাস্তায় বা গ্রাম–গঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হননি—সে কথা স্বীকার করতেই হবে।

পরবর্তীকালে তাঁরা গণহত্যার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য বেঁচে থাকতেন না, তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হতো না। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় হত্যাকারীরা যেভাবে পার পেয়ে গেছেন বিশ্ব সম্প্রদায়ের ছলনার সুযোগে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা একাত্তর-পরবর্তী অবস্থানে ফেরার সুযোগ পেতেন না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শাহ আজিজ বেঁচে গিয়েছিলেন জেলে ছিলেন বলে। বেচারা ফরিদ আহমদ সময়ে ধরা পড়েননি বলে মারা গেলেন। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন মরতে মরতে পার পেয়ে গেলেন। শেখ মুজিব ফিরে না এলে জেলেও তাঁরা নিরাপদ থাকতে পারতেন কি না, সন্দেহ!

তত্কালীন পরিস্থিতির কারণে শেখ সাহেব তাঁদের জেলের বাইরে আনতে পারেননি, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যে প্রত্যেকের খোঁজখবর নিতেন এবং তাঁদের কারও কারও পরিবারকে যে নিজেই ভরণপোষণ করেছেন, সে কথা কেউ কেউ জানেন বৈকি!

প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজাকারদের জন্য এত দরদের কী দরকার ছিল? উত্তর হচ্ছে, প্রয়োজন বা যুক্তি দিয়ে হৃদয় চালিত হয় না। অন্যদিকে হৃদয় যদি প্রাধান্য পায়, তাহলে মস্তিষ্ক দ্বারা চালিত হতে পারে না। প্রশাসনিক কাজে যদি বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ হয়ে থাকেন, সরকার পরিচালনায় যদি ছোটখাটো শৈথিল্য দেখিয়ে থাকেন, তার পেছনের কারণটি কোনো বাঙালির না বোঝার কারণ নেই। বাঙালির স্বভাবসুলভ আবেগই প্রাধান্য পেত বঙ্গবন্ধুর অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়, যদি কোনো অপরাধে তিনি অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর চিত্তবৈকল্যকে দায়ী করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু যখন ৩২ নম্বর থেকে গণভবনে যেতেন, ঢাকার রাস্তা বন্ধ থাকত না। সামনে খোলা জিপে থাকতেন হয় এসপি মাহবুব অথবা সার্জেন্ট নবী চৌধুরী। ঢাকার রাস্তার দেয়ালে তখন একটি স্লোগান চোখে পড়ল, ‘বঙ্গবন্ধু কঠোর হও।’ তিনি বলতেন, ‘কার প্রতি কঠোর হব, কীভাবে হব, কেনই-বা হব?’

কেউ কেউ বলেন, শেখ মুজিব সমগ্র বাংলাদেশকে তাঁর জমিদারি মনে করে একক হুকুমে চালাতেন। আসলে তিনি সমগ্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি পরিবার মনে করতেন, নিজে ছিলেন সেই পরিবারের প্রধান। পরিবারে সবাই ছিল তাঁর স্বজন, আপনজন, আত্মার আত্মীয়। সাড়ে সাত কোটি আত্মীয় বাঙালির কেউ অপরাধ করলে দুর্বিনীত বা বেয়াদব বলে দুটি ধমক দিয়েই ক্ষান্ত হতেন, শাস্তি দিতে পারতেন না, কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেননি। একটি কথা তখনকার দিনে চালু ছিল, খুন করেও যদি একবার আগেভাগে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানো যেত, তাহলে সব অপরাধ মাফ হয়ে যেত। শুধু পায়ের ওপর পড়ে বললেই হতো, ‘অপরাধ করে ফেলেছি, এখন কী করব?’ তিনি পিঠের ওপর দুটি থাপ্পড় দিয়ে বলতেন, ‘যা হতভাগা, এবার বেঁচে গেলি। আর কখনো এ রকমটি করিস না।’ কথাটি হয়তো পুরোপুরি সত্যি নয়। দেশ ও সরকার এ রকম খেয়ালখুশিমতো চালিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে এমন ধারণা করা সংগত হবে না। আবার এ-ও ঠিক, স্নেহ, ভালোবাসা ও মমতায় ভরা হৃদয়খানি তাঁকে অনেক সময় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আবেগভরা এই প্রতিবেদনে ব্যক্তি মুজিবের একটি দিক সম্পর্কেই শুধু আলোচনা করেছি। এ দেশে অনেক মহান নেতার জন্ম হয়েছে, রাজনীতির অঙ্গনে অনেকে কৌশলী পদচারণ করেছেন, বিদ্যা-বুদ্ধি-মেধায় রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় তাঁর চেয়ে অনেক বেশি উপযুক্ত কেউ কেউ ছিলেন বৈকি; কিন্তু তাঁর মতো কি কেউ জনগণকে ভালোবাসার কথা বলতে পারতেন?

এ দেশের মহাপুরুষদের সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। অনেক কাহিনি শোনা যায় হক সাহেব, ভাসানী, সোহ্‌রাওয়ার্দী সম্পর্কে, শেখ মুজিবুর রহমানের সমসাময়িককালে যাঁরা রাজনীতি, সমাজসেবা, সাংবাদিকতা ও বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে তাঁরা সবাই, এমনকি সাধারণ মানুষও তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি পারিবারিক জীবন সম্পর্কে অনেক কাহিনি বর্ণনা করে থাকেন, কিন্তু তাঁরা কি দেশের সব সাধারণ মানুষের প্রত্যেকের না হোক, ব্যক্তিগত সবার জীবন, পারিবারিক পরিচয় জানতেন, খুঁটিনাটি খবর রাখতেন? বঙ্গবন্ধুই একমাত্র মানুষ, যাঁর সম্পর্কে সবাই বলতেন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রত্যেক মানুষকে তিনি নাম ধরে সম্বোধন করতে পারতেন। এটি সম্ভব ছিল তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কারণে।

বঙ্গবন্ধু তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘ওরে আমার ভুসি আসছে’ বলে হইচই করে উঠলেন। ভুসি মাখনের মতো একেবারে গলে গেল। বঙ্গবন্ধু যতই বলেন, ‘কেমন আছিস, কোনো অসুবিধা নেই তো?’ ভুসি ততই খালি তোতলায় আর বলে, ‘ভা-ভা ভালোই আছি। ক-ক কোনো অসুবিধা নেই।’

বাংলার যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে কেউ দেখা করতে এলেই বলতেন, ‘আরে তুই অমুক গ্রামের অমুকের পোলা না? তোর দাদা কেমন আছে? সেই ছোট্ট বোনটির বিয়ে হয়েছে?’

এই কারণে ‘ক্যারিশমা’ শব্দটি শুধু শেখ মুজিবের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য ছিল। এ নিয়ে একটি কাহিনি আমি আগেও কয়েকবার বলেছি। ফেনীর মরহুম রুহুল আমিনকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ভুসির ব্যবসা করত বলে তিনি তার নামই দিয়েছিলেন ‘ভুসি’। আমি তখন সংসদ সদস্য। এলাকায় গেলেই আমার কাছে ভ্যানভ্যান করত, ‘আমার কিছু হলো না, দেশ ও দলের জন্য এত কিছু করেছি, সর্বস্বান্ত হয়েছি। মুজিব ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন, অথচ আমি কিছুই পেলাম না।’ এত সব ঘ্যানরঘ্যানর শুনে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘চলো, তোমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাই। যা বলার তাঁকেই বলো।’

ঢাকায় এল ভুসি, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘ওরে আমার ভুসি আসছে’ বলে হইচই করে উঠলেন। ভুসি মাখনের মতো একেবারে গলে গেল। বঙ্গবন্ধু যতই বলেন, ‘কেমন আছিস, কোনো অসুবিধা নেই তো?’ ভুসি ততই খালি তোতলায় আর বলে, ‘ভা-ভা ভালোই আছি। ক-ক কোনো অসুবিধা নেই।’ বঙ্গবন্ধু তার পরিবার, এলাকার, দেশের অবস্থার খোঁজখবর নিলেন। আধা ঘণ্টা পর ভুসিকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। রেগে বললাম, ‘কী হলো, এত প্যানপ্যানানি গেল কই, কিছুই তো বললে না, চাইতে পারলে না!’ ভুসি আমতা আমতা করে বলল, ‘কী করব, নেতাকে দেখে যে সবই ভুলে গেলাম।’

বুঝলাম, এরই নাম ক্যারিশমা। ইনিই হচ্ছেন একমেবাদ্বিতীয়ম শেখ মুজিব, জনগণের শেখ সাহেব, কর্মীদের মুজিব ভাই। সহকর্মীরা তাঁকে সম্বোধন করেন ‘নেতা’ বলে। সাধারণ মানুষ বলেন ‘শ্যাখ সাহেব’, কর্মীরা বলেন ‘নেতা’ অথবা ‘মুজিব ভাই’। ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেন তাঁরা, যাঁরা তাঁকে সসম্মান দূরে সরিয়ে রাখেন; ভালোবাসেন কতটুকু, জানি না। এসবই হতে পেরেছিলেন, তিনি যেহেতু বিরাট একখানি হৃদয় নিয়ে জনগণের কাছে যেতে পেরেছিলেন, জনগণ তাঁর কাছে আসতে পেরেছিল।

দেশে ফেরার মাসখানেক পরে বিবিসির ডেভিড ফ্রস্ট তাঁর সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য ঢাকায় এলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী? হোয়াট ইজ ইয়োর স্ট্রেংথ?’ বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘মাই পিপল। আমার জনগণ।’ তারপরের প্রশ্ন, ‘হোয়াট ইজ ইয়োর উইকনেস? আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?’ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার জনগণের জন্য ভালোবাসা। মাই লাভ ফর মাই পিপল।’

শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র জাতির জনগণের নেতা, যিনি গর্বের সঙ্গে এমনটি বলতে পারতেন। তাঁর সারা জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা, যা-ই বলা হোক, সবকিছুর মূলেই ছিল তাঁর এই জনগণ, তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তাদের অধিকার আদায়ে হৃদয়ের দৃঢ়চিত্ততা আর তাদেরই বিশ্বাসঘাতকতা। মোনাফেকির আগাম খবর জানা সত্ত্বেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা হয়েছিল ছিল তাঁর হৃদয়ের দুর্বলতা। তাঁর কথাগুলো তাই একটু অন্যভাবে বলতে চাই। শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট তথা সম্পদ ছিল তাঁর বিশাল হৃদয়, তাঁর লায়াবিলিটি, দুর্বলতা এবং সবচেয়ে বড় শত্রুও ছিল তাঁর মহত্বে ভরা মহান হৃদয়খানি। সবার জন্য এই অন্ধ ভালোবাসার জন্যই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শেখ মুজিবের দেহ নয়, একটি মহান আত্মার মৃত্যু হয়েছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট।