বড় গলা খালি চোরের মায়ের থাকে না। অনেকেরই থাকে। বড়ে গোলাম আলীরও বড় গলা ছিল। বড় গাইয়ে বলে তাঁর মধ্যে বড়ত্বের বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু তিনি যে যেখানে–সেখানে হেঁড়ে গলা ছেড়ে গান ধরার মতো ছিঁচকে গাইয়ে নন, সেই বড়ত্বের বোধ তাঁর টনটনাই ছিল।
ইউটিউবের কল্যাণে বলিউডের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সংগীত পরিচালক নৌশাদের জবানিতে গল্পটা শোনা:
মুঘল-এ-আজম ছবি বানানো হবে। একটি দৃশ্যে পণ্ডিত তানসেন ভোরে ফতেহপুর সিক্রিতে বাণীবিহীন সারগাম সাধবেন। পরিচালক ও প্রযোজক কে আসিফ সংগীত পরিচালক নৌশাদকে বললেন, তানসেনের কণ্ঠ কে দেবে?
নৌশাদ বললেন, কণ্ঠটা এই জমানার তানসেন দিলে ভালো হয়।
আসিফ বললেন, মালটা কে?
নৌশাদ বললেন, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেব। কিন্তু তিনি তো জলসার গাইয়ে, সিনেমায় গান না।
আসিফ বললেন, গাইবেন, তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
নৌশাদ ওস্তাদের কাছে কথাটা পাড়লেন। শুনে ওস্তাদ তাঁকে যথারীতি ঝাড়লেন। আসিফ বললেন, গাইতেই হবে। ওস্তাদ বললেন, গাইতেই যখন হবে, তখন বড় ওস্তাদের সেলামিও বড়... ২৫ হাজার রুপি দিতে হবে।
দেশভাগের আগে যে জমানায় বলিউডের সবচেয়ে হামবড়া ভাবের প্লেব্যাক শিল্পী গানপ্রতি সর্বোচ্চ চার হাজার রুপি নিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন, সে সময় দাঁড়িয়ে আড়াই মিনিটের ‘মা-পা-নি-রে’ গাওয়ার জন্য ২৫ হাজার রুপি দাবি করা শুনলে যে কারও মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা। কিন্তু নৌশাদকে হতভম্ব করে দিয়ে আসিফ তুড়ি বাজিয়ে ওস্তাদজিকে বললেন, ‘মাত্র! আমি রাজি। এই নেন ১০ হাজার অ্যাডভান্স।’
মোরাল অব দ্য স্টোরি: আসিফ বড় প্রযোজক-পরিচালক ছিলেন বলেই বড়ে গোলাম আলীর বড়ত্বের দাম দিতে পেরেছিলেন, আর সে জন্যই মুঘল-এ-আজম-এর মতো বড় ছবি বড় পর্দায় এসেছিল।
কথা হলো, কে বড় লেখক বা শিল্পী, কে ছোট লেখক বা শিল্পী, তা মাপার গজ-ফিতা কোনো কোম্পানি এখনো বানাতে পারেনি। তা মাপার জন্য যা আছে তার নাম সামগ্রিক ‘জন-অভিমত’। কে বড় লেখক বা কে ছোট লেখক, তা বিচার করার বাটখারারূপী এই ‘জন-অভিমত’-এর ‘জন’ আবার রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মতো (আ)পামর ‘জন’ও নন। তাঁরা সাধারণ নন, তাঁরা বিশেষ। এই বিশেষত্ব না থাকার কারণে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা কতটা ওজনদার উপন্যাস, তা নিরক্ষর পুরোনো খবরের কাগজের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি পাল্লা-পোড়েনে মেপে বইটি এক কেজি নাকি সোয়া কেজি, তা অবলীলায় বলে দেবেন।
আকারে অতিকায় হলেই উৎকর্ষে তা বৃহৎ হবে এমন দিব্যি কোথাও দেওয়া নেই। মুরব্বিরা ‘বড় হও’ বললে সেটার অর্থ লম্বা হওয়া বোঝায় না। কিন্তু মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলি যখন বলে, ‘বড় হও দাদাঠাকুর, তোমাকে আমি তিন–প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব’, তখন সেটা গায়ে–গতরে বড় হওয়ার কথাই বোঝায়। এই বড়ত্বের সূক্ষ্মতা ও বৃহদাকৃতির স্থূলতার তুল্যমূল্য বিচারের জন্য যে চিন্তনের চর্চা দরকার, তার স্থান এখানকার বড়ত্বের দাবিদারদের মধ্যে নেই।
জার্মান কবি ফ্রেডরিক হোল্ডারলিন জীবনের শেষ ৩৪ বছর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে ছিলেন। বউ–ছেলে–মেয়ে তো দূরের কথা, তিন কুলে তাঁর কেউই ছিল না। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর একটি গরিব মুচি পরিবার তাঁর দেখাশোনা করত। মুচি পরিবার চামড়া, জুতা চিনত, কিন্তু কবিতা কী, তা জানত না। ফ্রেডরিক নামের যে লোককে তারা দয়া করে ঘুমানোর জায়গা দিয়ে এবং দুই বেলা রুটি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখছিলেন, সেই লোক যে উনিশ শতকের এক বিরাট কবি, তা তাঁরা জানতেনও না। বাংলা ভাষার কবি বিনয় মজুমদারও হোল্ডারলিনের মতো আজীবন অবিবাহিত এবং ঠিক ৩৪ বছর মানসিক রোগী হয়ে ছিলেন। বিনয়কে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন খাওয়া-পরার জোগান দিয়েছিল এক গরিব ফুল বিক্রেতার পরিবার। তাঁরাও কবিতা কী, কেন, কিচ্ছু জানতেন না। তাঁদের কাছে বিনয় ছিলেন, ‘পাগল দাদু’।
ফলে কে বড় লেখক বা কবি, তা সাব্যস্ত করবে যে জনতা, তাকে আগে লেখার বিষয়ে জানতে হবে। সেই লেখা জানা জনতার জনমত থেকে বড় বা ছোট লেখকসংক্রান্ত একটা রায় পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য সেই রায়ও যে সবাই মানবেন, তা নয়। কারণ, সমঝদার হিসেবে কে বড়, সেটাও তর্কসাপেক্ষ। এই অবস্থায় ‘বড়’ সমঝদার ‘বড় লেখক’ হিসেবে যাঁকে স্বীকৃতি দেবেন; তাঁর সেই বড়ত্বের স্বীকৃতি ‘ছোট’ সমঝদারেরা স্বীকার করবেন বলে মনে হয় না।
কারণ, এখন প্রত্যাখ্যানের যুগ। অস্বীকৃতির যুগ। আত্মস্বীকৃতির যুগ। তাচ্ছিল্যের যুগ। খারিজের যুগ। ‘ধুর! অমুক আবার কিসের শিল্পী! তমুক বড় লেখক হলো কবে! অমুকটা আবার কে? তার লেখা তো পড়ি নাই! অমুককে তো কবি হিসেবে গোনায়ই ধরি না!’—এই কায়দার যুগ। কবি-লেখকদের মধ্যেও এই ‘খারিজি সম্প্রদায়’ আছে। মূলত ফেসবুক এই সম্প্রদায়ের (গো) চারণভূমি। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে আবার ছোট ছোট উপসম্প্রদায় আছে। প্রতিটি উপসম্প্রদায়ে একাধিক নেতা আছেন। তাঁদের প্রত্যেকের অন্তত একটি ফেসবুক আইডি এবং কিছুসংখ্যক ‘সহমত ভাইডি’ আছেন। ‘কারও লেখা কিসসু হচ্ছে না,’ এই নীতিগত সিদ্ধান্ত আগে থেকেই ঠিক করে রাখার পরও তাঁরা নিয়মিত বড়-ছোটবিষয়ক রায় ফরমায়ে থাকেন। কে বড় লেখক, কে মাঝারি কবি, কে ছোট ছড়াকার, কে পাতি সাহিত্যিক, কার কিছুটা হয়, কার হলেও হতে পারে, কে ধরে রাখতে না পারায় তাল কেটে যায়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন জায়গাটা আরেকটু ডেভেলপ করতে পারলে আরেকটু ভালো করতে পারতেন, জীবনান্দ দাশ কেন মাঝারি মানের কবি, আল মাহমুদের সোনালি কাবিন–এর কোন জায়গাটায় মাত্রায় গন্ডগোল আছে, এই সময়ে কে সেরা কবি—এই সব সিদ্ধান্ত তাঁরা দিয়ে থাকেন।
একজনকে বড় করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যজন ছোট হয়ে যায়—এই থিওরির ওপর ভর করা একটা ‘ছোট-বড়’ খেলা সারাক্ষণ চলতে থাকে। কেউ আবার ছোট লেখককে বড় করে, বড় লেখককে খাটো করার থিওরি ধরে সামনে এগোন। অবজ্ঞার ঢাক পেটানোর কাজে ‘সহমত ভাইডি’রা ঢাকের কাঠি হিসেবে লাইক-কমেন্ট মারেন। কে কত বড় লেখক বা কবি, তা তার টেক্সটের ওপর আর ভর করে না, ভর করে ফেসবুকে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা কত, তার ওপর। একটা ট্রেন্ডি প্রজন্মের হুজুগে সাহিত্যের স্রোতে লেখকের স্টাইল বা স্বকীয়তার ধারণা কোথায় ভেসে গেছে!
শেষের কবিতার অমিতের মতো আমারও বিশ্বাস, ‘আমাদের দেশের সাহিত্যবাজারে যাঁদের নাম আছে, তাঁদের স্টাইল নেই।...ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী। যাঁরা সাহিত্যের ওমরাও দলের, যাঁরা নিজের মন রেখে চলেন, স্টাইল তাঁদেরই। আর যাঁরা আমলা দলের, দশের মন রাখা যাঁদের ব্যবসা, ফ্যাশন তাঁদেরই। বারোয়ারি তাঁবুর কানাতের নিচে ব্যবসাদার নাচওয়ালির দর্শন মেলে, কিন্তু শুভদৃষ্টিকালে বধূর মুখ দেখবার বেলায় বেনারসি ওড়নার ঘোমটা চাই। কানাত হলো ফ্যাশনের আর বেনারসি হলো স্টাইলের, বিশেষের মুখ বিশেষ রঙের ছায়ায় দেখবার জন্য। হাটের লোকের পায়ে চলা রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরতে ভরসা পায় না বলেই আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর।’
স্মার্টফোনের হাত ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লোকের রুচি স্থায়ীভাবে বদলে দিতে পেরেছে। মননশীলতার বদলে চটুলতা আর ‘আমাকে দেখুন’ টাইপের আত্মপ্রদর্শন এখন এই মাধ্যমের ‘ইউএসপি’। পোস্ট করা কবিতায় প্রত্যাশিত লাইক না পেয়ে আজকের কবিরা মুষড়ে পড়েন, এর জের ধরে ফেসবুকীয় বন্ধুবিচ্ছেদও হয়।
যেহেতু ফেসবুকে লেখক নিজেই একাধারে সম্পাদক ও প্রকাশক; যেহেতু আঙুল ছুঁইয়ে মুহূর্তে নিজের রচনা অলীক পাতায় নিজের লেখা হাজির করা যায়; সেহেতু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে এখানে কোনো বাধা নেই।
এই রকমের আবহে সময় কাটানোর পর লেখক-পাঠক উভয়ের মানের যে অবনমন ঘটে, সেটিই অগভীর ও লঘু রচনাকে তাদের কাছে ‘অসাধারণ’ করে তোলে। তখন বিপ্লবস্পন্দিত বুকে ত্যালাচোরারও মনে হয়, ‘আমিই রবীন্দ্রনাথ!’ তখন এই অতিবিপ্লবীদের মনে হয়, তাঁরা নিজেরা এবং তাঁদের খারিজি সম্প্রদায়ের বাইরে ‘আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়।’