মার্থা, একুশে আর বরফ গলা নদী
আমার বেঁচে থাকার অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে, আমি দেশবিখ্যাত এমন এক বাবার সন্তান, যার ছটাক স্মৃতিও আমার নেই। আর এ কারণেই তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে মানুষটিকে বোঝার মধুর ব্যাপ্তি পাওয়া। কৈশোর থেকে এই প্রায় বাতিল বয়সে এসেও তিনি আমার কাছে রহস্যময়; আর তাই রোমান্টিক এক বাবা। যিনি লেখেন, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’—এই এক বাক্যেই তিনি পুত্রের কাছে সেই যে কৈশোরের বিস্ময় এনে দিয়েছিলেন, তা এখন এক পরিচ্ছন্ন ভবিষ্যতের ঠিকানা জানায়।
স্কুলে থাকতেই বাবার বইগুলো প্রথম পড়া হয়। আর তার মধ্যে মহাবিস্ময় ছিল আরেক ফাল্গুনে–এর ওই মহাবাক্য! আমি কিন্তু বুঝেছিলাম, পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারির সমাবেশে ছাত্র-জনতার সংখ্যা দ্বিগুণ হবে, বাবা শুধু এই–ই বলছেন না, বলছেন এক তাগড়াই পাহাড়ি নদীর কথা! নদীর প্রতিটি স্রোত আগেরবারের চেয়ে তেজি। আরেক ফাল্গুন–এর ওই লাইন পড়ার পর ঠিক এমনই এক কল্পনা আমার হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলন বাবার মজ্জায় গেঁথে গিয়েছিল। তিনি এর অংশ ও ফসল ছিলেন এবং এর ইতিহাসকেও ক্রমাগত আবিষ্কার করে গেছেন। আরেক ফাল্গুন, আর কতদিন—উপন্যাসগুলোর পর জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে তাঁর টান বোঝা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারির দিকে আমার টান বাবার টান থেকেই আহরিত হয়েছে প্রথম।
বাবার আরেকটি উপন্যাস বরফ গলা নদী আমার কৈশোর আর তারুণে৵ অদ্ভুত এক বিবমিষা তৈরি করেছিল। ঢাকায় জহির রায়হানদের কায়েতটুলীর আদি বাড়িটিকে দেখেছি পুরান ঢাকার পুরোনো বাড়িগুলোর মতোই। যেখানে রাত কাটানো খানিক আতঙ্কের ব্যাপার, ছাদ ভেঙে পড়তে পারে! আর আমরা মোহাম্মদপুরে হুমায়ুন রোডের পাকিস্তান আমলের যে একতলা বাসাটায় থাকতাম, তারও তখন বয়সোত্তীর্ণ গোছের হাল! বরফ গলা নদীর মতোই বর্ষায় বাড়িটার ছাদ গলে পানি পড়ে। দেয়াল জলে চুপসে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। মেঝে ভিজে থাকে। আর ছাদের চারদিক ঘিরে রাজ্যের বারোয়ারি গাছের লতাপাতা-শিকড় উঠে গেছে। কয়েক যুগ আগে পরের বাড়ি দুটি যেন একই বাড়ি। একই সব চরিত্রের গল্প লিখছে! মা আর আমরা ভাইয়েরা মাঝেমধ্যে বলাবলি করতাম, যে কোনোদিন এ বাড়ি বরফ গলা নদী হয়ে যেতে পারে। ঝড়ের রাতে জোর মেঘ গর্জনে ঘুম ভেঙে গেলে আগেই চোখ যেত ছাদের দিকে। ছাদ যদি এখন ভেঙে পড়ে, আমি কি আহত হব না মারা যাব?
বরফ গলা নদীর সাংবাদিক চরিত্রটির মতো আমার তো নাইট ডিউটি নেই যে ভোরে কাজ থেকে ফিরে এসে দেখব, মা-ভাইবোনদের নিয়ে বাড়িটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে! মনে আছে, একই আলাপ কায়েতটুলীর বাড়ি নিয়েও আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বলাবলি করতাম। আর আছে মার্থা! তৃষ্ণা উপন্যাসের সেই অ্যাংলো–ইন্ডিয়ান মেয়েটি! অ্যাংলো–ইন্ডিয়ান বলতে আমাদের চোখে ভাসে সাদা চামড়ার কোনো মানুষ। কিন্তু মার্থা হলো কালো। বাবা নিশ্চয়ই এমন মেয়ে দেখেছিলেন। তাই লিখেছেন। ‘খ্রিষ্টান এই মেয়েটির আমি প্রেমে পড়েছিলাম। এমন এক সমাজে প্রকৃতি তাকে জন্ম দিলো যা তার যায়গাই না। এখানে সবাই ভারতীয়। পাঞ্জাবি, বাঙালি, মারাঠি, শিখ—সবাই এ ভূখণ্ডের সন্তান। শুধু অ্যাংলো– ইন্ডিয়ানরা যেন এক জারজ জাত! এরা না ভারতীয় না ইংরেজ না আইরিশ না স্কটিশ!’ ছেলেবেলায় আমাদের পাড়াতেই এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার ছিল। পিংকি বলে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও হয়েছিল। ঝরঝরে ইংরেজি আর অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলা বলত। এমন বাঙালি মেয়ের সঙ্গে আমার আর কখনোই পরিচয় হয়নি। তারপর থেকে যত দিন গেছে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এ শহর থেকে মুছে গেছে। কিন্তু মার্থা মনে গেঁথে আছে। তৃষ্ণা নিয়ে আমি একটি চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। যেখানে জহির রায়হানের মার্থাকে আমি আমার সময়েও ঢাকায় খুঁজে পেয়েছি। তরুণ মার্থা। একই ধরনের সংগ্রামে সে–ও রত। শেষ পর্যন্ত যে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যায়। ফিল্মের নায়ক অর্থাৎ আমিও আমার বাঙালি পরিচয়ের ইতি টেনে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যাই মার্থাকে খুঁজতে এবং জাতজারজ হয়ে বাঁচতে।