সব থাকার পরও কেন ‘মরিবার সাধ’ হয়

দিন কয়েক আগে সাগরে ভেসে উঠল ছিন্নভিন্ন, অর্ধগলিত লাশবাহী ট্রলার। তাতে কি বিপন্ন বোধ করলাম আমরা?

ছবি: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হ’ল তার সাধ।

বধূ শুয়েছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;

প্রেম ছিল, আশা ছিলো—জ্যোৎস্নায়,—তবু সে দেখিল

কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

বধূ, শিশু, প্রেম, আশা—সব থাকার পরও কেন ‘মরিবার সাধ’ হয়? কবিতার মধ্য দিয়ে একদা প্রশ্নটি করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তবে জীবনানন্দ ‘আট বছর আগের একদিন’ শিরোনামে কবিতাটি লেখার বেশ আগে থেকেই সবকিছু থাকার পরও মানুষ কেন মরতে চায়—এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে জেরবার হয়েছেন অস্তিত্ববাদী দার্শনিকেরা। তাঁরা দেখেছেন, মানুষ কখনো প্রকৃত মুক্তি অর্জন করতে পারবে না। সে সব সময় দাঁড়িয়ে থাকবে এক পাহাড়ের কিনারায়।

আলবেয়ার কামু
ছবি: সংগৃহীত

কারণ, তার সব সিদ্ধান্ত পূর্বনির্ধারিত। সে অস্তিত্ব পাবে, নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবে, জগতে জেগে উঠবে এবং নিজেকে ব্যক্তি হিসেবে নির্ধারণ করবে। এই প্রেম আর আশা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই ছকে বাঁধা। তাহলে মানুষের স্বরূপ দেখার উপায় কী? তার কি আসলেই বেছে নেওয়ার ক্ষমতা আছে? শেক্‌সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’–এর মতো ‘টু বি অর নট টু বি’ অথবা মানুষের থাকা বা না থাকাটাই হয়তো শেষমেশ একমাত্র জরুরি প্রশ্ন এবং ক্ষমতার পরিচায়ক।

যুক্তি দিয়ে অর্থে পৌঁছাতে না পেরে অস্তিত্ববাদীরা বলেন, এই পৃথিবীর অনেক কিছুই ‘অ্যাবসার্ড’ বা যুক্তির ঊর্ধ্বে। যুক্তির ঊর্ধ্বে এই যে স্থান, সেখানেই ঘোরাফেরা করে ‘এনুই’ বা অবসাদ।

সাম্প্রতিক কালে করোনা মহামারির দাপটের সময় পৃথিবীবাসী টের পেল, কত কত বিষয় কেবল আমাদের বিভ্রান্ত করে রাখে। আমাদের দীর্ঘ কাজের তালিকায় ওপরের দিকে থাকা এই বিষয়গুলো কত অপ্রয়োজনীয়। আমরা ক্রমশ উদ্দেশ্যহীন হতে থাকলাম। একঘেয়েমি একসময় অবসাদে রূপ নিল। এ অবসাদ বিভ্রান্তির জাল ছিঁড়ে জীবনের স্বরূপ দেখার। সে জীবনে যে কারও সঙ্গে যেকোনো সময় ঘটতে পারে যেকোনো কিছু। সে জীবন ভালো আর খারাপের দ্বৈততায় বাঁধা নয়। ভালোর সঙ্গে ভালো হবে, খারাপের সঙ্গে খারাপ—ইশপের গল্পের এই বয়ান এখানে আর খাটে না।

এই অবসাদ কাজের ক্লান্তির নয়, কর্মহীনতার নয়, উদ্দেশ্যহীনতার নয়। এই অবসাদের জন্ম আলবেয়ার কামুর ‘আনক্যানি’র মধ্যে। আনক্যানি হলো এমন এক বিষয়, যা সাধারণত আমাদের বোঝাপড়ার জগতের বাইরে থাকে; সাদা চোখে আমরা যাকে ঠাওর করতে পারি না; কল্পনা দিয়েও আকার দিতে পারি না। আর তা পারি না বলেই এটি কখনো কখনো আমাদের কাছে ভীতিজনক হিসেবে উপস্থিত হয়। এমনকি তা আমাদের অস্তিত্বের মূলেও আঘাত হানে। আনক্যানির পুরো ব্যাপারটি আসলে ব্যাখ্যাহীন এবং অদ্ভুত—সেই ‘অদ্ভুত’ আমাদের অস্তিত্বকে অর্থহীন করে তোলে এক লহমায়। একেই হয়তো জীবনানন্দ দাশ নাম দিয়েছেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’।

উপকূলে টেনে আনা ট্রলার থেকে লাশ উদ্ধারের অভিযান চলছে। রোববার দুপুরে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক সমুদ্র উপকূল থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সাম্প্রতিককালে করোনা মহামারির দাপটের সময়ে পৃথিবীবাসী টের পেল, কত কত বিষয় কেবল আমাদের বিভ্রান্ত করে রাখে। আমাদের দীর্ঘ কাজের তালিকায় ওপরের দিকে থাকা এই বিষয়গুলো কত অপ্রয়োজনীয়। আমরা ক্রমশ উদ্দেশ্যহীন হতে থাকলাম। একঘেয়েমি একসময় অবসাদে রূপ নিল। এ অবসাদ বিভ্রান্তির জাল ছিঁড়ে জীবনের স্বরূপ দেখার। সে জীবনে যে কারও সঙ্গে যেকোনো সময় ঘটতে পারে যেকোনো কিছু। সে জীবন ভালো আর খারাপের দ্বৈততায় বাঁধা নয়। ভালোর সঙ্গে ভালো হবে, খারাপের সঙ্গে খারাপ—ইশপের গল্পের এই বয়ান এখানে আর খাটে না।

ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে বলেছিলেন, ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি।’ একসময় এটাই পশ্চিমা দর্শনের চূড়ান্ত বাক্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই চিন্তা কতটুকু নিজের, আমাদের এই থাকাটা কতটুকু স্বকীয়? আমাদের বোধের দেয়াল যে অতীত–ইতিহাস–ঐতিহ্য আর সংস্কারের ইটে গড়া, তা নিজস্ব মূল্যবোধ তৈরির সুযোগ দেয় কতটুকু?

এসব প্রশ্নের মধ্যেই সাগরে ভেসে ওঠে ছিন্নভিন্ন, অর্ধগলিত লাশবাহী ট্রলার। আমাদের সাক্ষী হতে হয় জীবনের বীভৎস রূপের। আর বোধের অতীত এমন বীভৎসতা আমাদের সেই অদ্ভুতের গোলকে ঢুকিয়ে ফেলে। তখন প্রশ্ন করতেই হয়, জীবনের অর্থ কোথায়?