‘কাদিশ’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

‘কাদিশ’ নামের শর্টফিল্মটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে প্রিয় ডেইজি আপার হাত ধরে। ডেইজি আপার সঙ্গে পরিচয় তানভীর মোকাম্মেলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে (বিএফআই) তিন মাসব্যাপী ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশ নেওয়ার সুবাদে। ডেইজি আপা নিজেও নানা গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের সঙ্গে সংযুক্ত। যাহোক, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের অ্যালামনাইয়ের এক ছোটখাটো আয়োজনে হালের ভার্চ্যুয়াল আয়োজনের মাধ্যমে দেখার সুযোগ হয়েছে রাজিদ সিজনের ‘কাদিশ’।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, রাজিদ সিজনের ‘কাদিশ’ আমার কাছে যেন প্রত্যাশারও বেশি কিছু পাওয়া। ভার্চ্যুয়াল আয়োজনের আগে ডেইজি আপা আমাকে বলেছিলেন যে বিএফআইয়ের এক সাবেক ছাত্রের একটা শর্ট ফিল্ম দেখানো হবে। সত্যি কথা বলতে, এ রকম অনেক আয়োজনে সাবেক বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীর বেশ কিছু ফিল্ম বা শর্ট ফিল্ম দেখা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ সময়ে দেখেছি অ্যাপ্রিসিয়েশন করার তাগিদে। অর্থাৎ নতুন এক ভবিষ্যৎ সিনেমাওয়ালাকে উৎসাহ দেওয়ার তাগিদ থেকে সেসব দেখতাম। যেদিন ‘কাদিশ’ দেখব, সেদিনও আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল তেমনই।

কিন্তু আমি ভাবতেই পারিনি মাত্র ১৫ মিনিটের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখার পর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ব। শুধু তা–ই না, ‘কাদিশ’ যাঁরা দেখছিলাম, রীতিমতো দীর্ঘক্ষণ ধরে সেটার পর্যালোচনা, রিভিউ শুরু করে দিলাম। সেদিন আরও একবার বুঝেছি, নির্মাতা যদি যথার্থভাবে গল্প, দৃশ্য আর করণকৌশলের সমন্বয় ঘটাতে পারেন, তাহলে তা দর্শকমনে ছুঁয়ে যাবেই! ১৫ মিনিটের ‘কাদিশ’ দেখার পর আমি নিশ্চিন্ত মনে বলতে পারি, রাজিদ একজন দুর্দান্ত নির্মাতা হতে যাচ্ছেন। এত উচ্চ প্রশংসা দেখে অনেকে ভাবতে পারেন কথাগুলো বড্ড বাড়িয়ে বলছি। কথাগুলোর পেছনের যৌক্তিকতা আঁচ করার একমাত্র পন্থা হলো, এক বসায় ‘কাদিশ’ দেখে ফেলা।

‘কাদিশ’ দেখতে গিয়ে প্রথম যে ধাক্কাটা খাই, তা হলো এর গল্পে। গল্পটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নাৎসি বাহিনীর নির্মমতায় বিশ্বজুড়ে ঘৃণিত হলোকাস্ট নিয়ে। জার্মান নাৎসি সৈনিকেরা এক জঙ্গলে ইহুদি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাউকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করছে আর কাউকে পোল্যান্ডের ক্রাকো শহরের গ্যাস চেম্বারে চালান করে দিচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে দুই যমজ বোনদের দেখা যায় নাৎসিরা পাচার করে দিচ্ছে। সে সময় তাদের মা আর্তনাদ করতে করতে মেয়েদের দিকে এগোতে থাকে। তখনই নাৎসি অফিসার খুন করে তাদের মাকে। এই পুরো হত্যাকাণ্ড দূর থেকে দেখে এক তরুণ ইহুদি যুবক, যে নিজেও জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এক র‍্যাবাইয়ের (ইহুদি ধর্মীয় পণ্ডিত) সঙ্গে এই যুবককে একত্রে দেখতে পাই নাৎসিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া অবস্থায়।

তারা দুজন কথা বলছে তাদের ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী মৃত্যু–পরবর্তী যে আচার, তা কীভাবে করবে, তা নিয়ে। কেউ মারা গেলে তার কবরে একটা পাথর রেখে দিতে হয়। সঙ্গে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করতে হয় নির্দিষ্ট কিছু অংশ। এই পুরো প্রক্রিয়াকেই সাধারণভাবে, তাদের ধর্মাচার অনুযায়ী ‘কাদিশ’ বলা হয়। ওই যুবক ও র‍্যাবাই—দুজনেই তাদের সব কাছের মানুষদের হারিয়েছে। এখন তারা ভাবছে তাদের কাদিশ কে সম্পন্ন করবে? শেষের দিকে দেখতে পাই, তারা শেষমেশ নাৎসিদের কাছে ধরা পড়ে। এমন সময় দূর থেকে একজন আরেকজনের ‘কাদিশ’ পড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পর তাদের গুলি করার আওয়াজ শোনা যায়। এটাই ‘কাদিশ’–এর গল্প।

গল্পটা সাদামাটা হলেও বিষয়ের দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হাজির করেছেন পরিচালক। মৃত্যুর মতো অমোঘ বিষয়ের আচারশাস্ত্র আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। মৃত্যু যেহেতু আমাদের আপাতজীবনের সর্বশেষ পরিণতি—প্রতিটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, সংস্কৃতিতে মৃত্যু–পরবর্তী আচারগুলো এই ইঙ্গিত দেয় যেন সবার মৃত্যুর সার্থকতা অর্থপূর্ণ হয়। এদিক থেকে ‘কাদিশ’–এর সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলেও বিষয়ের দিক থেকে এই সিনেমা মৃত্যুর সার্থকতার মতো গভীরতাকেই স্পষ্ট করে। শুধু তা–ই নয়, মৃত্যুর সঙ্গে মানবতার যে বিশেষ কালসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো পবিত্র সম্পর্ক আছে, এখানে তা–ও  দেখিয়েছেন পরিচালক। ‘কাদিশ’ যদিও সম্পন্ন হতে হয় নিজের পরিবারের স্বজনদের মাধ্যমে, সিনেমার শেষ দিকে দেখতে পাই দুই আগন্তুক, যাদের পরিচয় সেই জঙ্গলে, তারা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ নয়, কিন্তু নাৎসিদের হাতে মৃত্যুর আগে তারা একজন আরেকজনের জন্য কাদিশের নিয়ম অনুযায়ী তাদের শাস্ত্রের অংশটুকু পাঠ করছে। যুদ্ধের মতো মানবতাবিরোধী বিপর্যস্ত মুহূর্তে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার যে অভিজ্ঞতা, তা মানবতার সীমাবদ্ধ পরিচয়ের সীমানাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত দেয়—এই ব্যাপারটাই যেন অনুরণিত হচ্ছিল রাজিদের শেষ দৃশ্যে।

মোদ্দাকথা, ‘কাদিশ’–এর গল্প হলো নাৎসি সৈন্যদের দ্বারা ইহুদিদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের গল্প, যার মধ্যে আছে নাটকীয়তার ওপরে নাটকীয়তা।

সে অর্থে এটা চেইজের গল্প, কিন্তু এর মধ্যেই ইহুদি ধর্মের সংস্কৃতির মৃত্যুর আচার–বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে রিচুয়ালের গল্পকে প্রধান করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধু তা–ই নয় বরং সেই গল্পের একটা ড্রামাটাইজেশন হাজির করা। ড্রামার মধ্যে সাসপেন্সও হাজির করেছেন। মূল দুই চরিত্র আফসোস করছিল যে তাদের কাদিশ করার জন্য কেউ থাকবে না। তাই তারা ধরা পড়ার আগে দুজন দুজনের কাদিশ পড়ে দেয়। যুদ্ধবিগ্রহ সব ছাপিয়ে এ যেন আত্মিক পরিপূর্ণতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর ভ্রমণ। স্বপ্নের দৃশ্যের মানবিক প্রশান্তি দেখে তারকোভস্কিয়ান মুহূর্তের কথা মনে আসে। এ যেন স্পিলবার্গীয় রহস্য প্রশ্নে তারকোভস্কির মানবিক বোধের প্রশান্ত দৃশের উন্মোচন!

গল্প যতই দারুণ হোক, তা যদি দৃশ্য, সম্পাদনা ও সংগীতের মাধ্যমে আমাদের হৃদয় না ছুঁতে পারে, তবে তা শেষাবধি পরিণত উৎকর্ষের জায়গায় পৌঁছায় না। এদিক থেকেও রাজিদ অসাধারণ কাজ করেছেন। আমরা সবাই–ই জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টের ন্যারেটিভ কত ব্যাপক। যুদ্ধের প্রায় ৮০ বছরেরও বেশি হতে চলছে। প্রতিবছর শত শত গবেষণা অভিসন্দর্ভ, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিনেমা, ডকুমেন্টারি হচ্ছে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। হলোকাস্টের সিনেমা হিসেবে আমাদের হৃদয়ে ছুঁয়ে যাওয়া কিছু নামকরা চলচ্চিত্রের কথা বলতেই চলে আসে কত কালজয়ী নাম: ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’, ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ প্রভৃতি। রাজিনের কাজকে আমি কালজয়ী এসব কাজের সঙ্গে তুলনা করব না। তবে এটুকু বলতে চাই, ‘কাদিশ’–এর গল্প, সহজ–সরল ও মানবিক নির্মাণশৈলী মনের মধ্যে একটা আলতো প্রশান্তি ছুঁয়ে দেয়। ১৫ মিনিটের ‘কাদিশ’ দেখার পর একটা ভালো স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখার অনুভূতি নিয়ে দর্শক বাড়ি ফিরতে পারেন।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ‘কাদিশ’ দেখার পরে রাজিনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর মারফতই জানতে পারলাম, ‘কাদিশ’–এ ইহুদিদের যে ঈদিশ ভাষার ব্যবহার হয়েছে, এই ভাষা এখন প্রায় বিলুপ্তিরই পথে। খোদ বিশ্বখ্যাত পরিচালকদের সিনেমাতেই এই ভাষার ব্যবহার দেখা যায়নি, যখন তাঁরা ইহুদিদের নিয়ে কোনো সিনেমা বানান। ফলে নানা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রাজিদ যখনই এই সিনেমা নিয়ে যান, প্রচুর গবেষক, চলচ্চিত্রানুরাগী, ভাষাতাত্ত্বিকেরা ঈদিশ ভাষার এই ব্যবহার নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চান। একজন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার ঈদিশ ভাষার মতো সমৃদ্ধ কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন; এ ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য বলেই মনে হয়।