মাংস

ব্যাপারটা বেশ সাদামাটাভাবেই ঘটে গেল, কোনো রকম ভাণ-ভণিতা বা রাখঢাক ছাড়াই। নগরে মাংসের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল এবং তার কারণও ছিল বৈকি; কিন্তু সেসব ব্যাখা করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকেই বেশ নড়েচড়ে উঠেছিল আর তিক্ত সব মন্তব্য, কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল সবখানে; কেউ কেউ তো এমনকি মারমুখী কথাও বলছিল। কিন্তু ওই যা হয় সব সময়, প্রতিবাদগুলো হুমকি-ধামকির বেশি আর এগোল না এবং খুব শিগগিরই উপদ্রুত নগরবাসী বিচিত্রতম শাকসবজি খেতে শুরু করল।

ব্যতিক্রম কেবল মহাশয় আন্‌সাল্‌দো; তিনিই এই গড্ডলে যোগ দিলেন না। একদম ঠান্ডা মাথায় তিনি রান্নাঘরের অ্যাববড় একটা ছুরিতে শাণ দিতে লেগে গেলেন আর তারপর পাতলুনটা হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে, তিনি তাঁর বাঁ নিতম্ব থেকে হাড্ডিছাড়া চমৎকার খানিকটা মাংস কেটে নিলেন। নুন আর ভিনেগার দিয়ে সেই হাড্ডিছাড়া মাংস পরিষ্কার আর কেটে-কুটে রান্নার জন্য তৈরি করার পর সেটাকে তিনি ব্রয়লারের ভেতর দিয়ে চালান করে দিলেন এবং সবশেষে রোববার রোববার টরটিলা বানানোর জন্য তিনি যে বড় কড়াইটা ব্যবহার করেন, তার মধ্যে সেটাকে ভেজে নিলেন। অতঃপর টেবিলে বসে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে থাকলেন তাঁর জব্বর হাড্ডিছাড়া মাংস। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল: আন্‌সাল্‌দোর প্রতিবেশী, তার মনের ক্ষোভ আর হতাশার কথা বলতে এসেছে...আর আন্‌সাল্‌দো বেশ রমণীয় একটা ভঙ্গি করে তাঁর প্রতিবেশীকে চমৎকার হাড্ডিবিহীন মাংসটা দেখালেন। প্রতিবেশী সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে আন্‌সাল্‌দো অবলীলায় তাকে তাঁর বাঁ পাছাটা দেখালেন। সবকিছু খুলে বলা হলো। রীতিমতো অভিভূত আর চমৎকৃত প্রতিবেশী কোনো কথা না বলে বিদায় নিয়ে, খানিক পর শহরের মেয়রকে নিয়ে ফিরে এল। মেয়র বললেন যে তিনি খুব করে চান যে তাঁর প্রিয় শহরবাসী—আন্‌সাল্‌দোর মতো—তাদের ব্যক্তিগত মজুত থেকেই, মানে নিজের গায়ের মাংস থেকেই নিজেদের পুষ্টির ব্যবস্থা করুক। সমস্যাটা খুব সহজেই মিটে গেল এবং সুশিক্ষিত লোকজনের ফেটে পড়া উচ্ছ্বাসের পর আন্‌সাল্‌দো শহরের মূল চত্বরে গিয়ে—তাঁর নিজের স্বভাবসুলভ ভাষায় বললে, ‘জনগণের জন্য একটা ব্যবহারিক প্রদর্শনী’ দেখাতে গেলেন।

সেখানে গিয়ে তিনি বুঝিয়ে বললেন যে প্রত্যেকে যার যার নিজের বাঁ নিতম্ব থেকে দুটো করে হাড্ডিছাড়া মাংসের টুকরো কাটতে পারবে, ঠিক যেমনটা তিনি মাংস ঝোলানোর চকচকে আংটা থেকে মাংস-রঙের প্লাস্টারের তৈরি মডেল ঝুলিয়ে দিয়েছেন, সেটার মতো। তিনি দেখিয়ে দিলেন কী করে হাড্ডিছাড়া বড় একটা নয়, দুই টুকরো মাংস কাটা যায়। কারণ তিনি যদি তার নিজের নিতম্ব থেকে হাড্ডিছাড়া চমৎকার এক টুকরো মাংস কেটে নিতেন, তাহলে অন্যরাও তাই করত, ফলে আরেক টুকরো মাংস থেকে তারা বঞ্চিত হতো। একবার বিষয়টা খোলাসা হয়ে যাওয়ার পর সবাই যার যার বাঁ নিতম্ব থেকে দুই টুকরো হাড্ডিছাড়া মাংস কেটে নিতে শুরু করল। সে একটা দেখার মতো দৃশ্য বটে, তবে অনুরোধ করা হলো যেন ফলাও করে সেটার বর্ণনা প্রচার করা না হয়। শহরটা কত দিন এই মাংসের সুবিধা ভোগ করতে পারবে, চট করে সেটার একটা হিসাবও কষে ফেলা হলো। একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, (নাড়িভুঁড়ি আর ভক্ষণ-অযোগ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়া) এক শ পাউন্ড ওজনের কোনো মানুষ দিনে আধা পাউন্ড করে এক শ চল্লিশ দিন (নিজের) মাংস খেয়ে যেতে পারবে। তবে অবশ্যই, হিসাবটা বিভ্রান্তিকর। কিন্তু যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, প্রত্যেক মানুষই যার যার চমৎকার হাড্ডিছাড়া মাংস খেতে পারবে। শিগগিরই শোনা গেল, নারীরা আন্‌সাল্‌দো মহাশয়ের বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই যেমন, যারা তাদের স্তন খেয়ে ফেলেছে, তাদের আর কাপড় দিয়ে ধড়টা ঢাকতে হতো না এবং ¯স্রেফ নাভি পর্যন্তই থাকত তাদের কাপড়চোপড়। কিছু কিছু নারী—যদিও সবাই নয়—কোনো কথা বলত না। কারণ তারা তাদের জিভ সাবড়ে দিয়েছিল (যা কিনা আবার রাজাদের খুব প্রিয়)। আর রাস্তায় দেখা গেল সবচেয়ে মজার ঘটনা: অনেক দিন পর দেখা হওয়া দুই নারী একে অপরকে চুম্বন করতে পারল না, কারণ তারা দুজনেই চমৎকার ফ্রিটার তৈরি করার জন্য তাদের ঠোঁটজোড়া রান্না করে ফেলেছিল। কারাগারের ওয়ার্ডেন এক আসামির মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানায় সই করতে পারলেন না। কারণ তিনি তাঁর আঙুলের মাংসল ডগাগুলো খেয়ে ফেলেছিলেন, যা কিনা সেরা ভোজনরসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী (যাঁদের মধ্যে অবশ্য ওয়ার্ডেন নিজেই একজন) ‘আঙুল চেটে খাওয়ার মতো ভালো’—এই কথাটার জন্ম দিল।

অবশ্য ছোটখাটো বাধাও যে এল না, তা নয়। নারী পোশাককর্মী ইউনিয়ন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের একেবারে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ দাখিল করল এবং সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ এ কথা বলে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল যে দরজিদের আবার পৃষ্ঠপোষকতা করতে রমণীদের উৎসাহ দিতে পারে এমন কোনো স্লোগান তৈরি করা আর সম্ভব হবে না। তবে বাধাটা তেমন জোরালো হলো না কখনোই এবং শহরবাসীর আপনা মাংস ভক্ষণে কোনো বিঘ্নই ঘটাতে পারল না।

সেই আনন্দঘন পর্বের সবচেয়ে বর্ণিল ঘটনাটা ছিল নগরের ব্যালে নর্তকের গায়ের মাংসের শেষ টুকরোখানার ব্যবচ্ছেদ। নিজের শিল্পের প্রতি সমীহবশত তিনি তাঁর পায়ের আঙুলগুলো শেষের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। তাঁর পড়শিরা খেয়াল করেছিল যে কয়েক দিন ধরে তিনি যারপরনাই অস্থির আচরণ করছেন। তো, এখন পায়ের একটা বড় আঙুলের মাংসল ডগাটা বাকি রয়েছে কেবল। এই সময় তিনি কর্তনটা দেখনোর জন্য তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে আমন্ত্রণ জানালেন। রক্তাক্ত নীরবতার মধ্যে তিনি শেষ অংশটা কেটে নিলেন এবং সেটা এমনকি গরম না করেই সেই গহ্বরটার মধ্যে টুপ করে ফেলে দিলেন, যেটা এককালে তাঁর সুন্দর মুখ ছিল। উপস্থিত সবাই হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন।

কিন্তু জীবন বয়ে চলে আর সেটাই বড় কথা। আর যদি হঠাৎ...? আর সেই কারণেই কি নর্তকটির জুতাগুলো ‘বিখ্যাত স্মৃতিচিহ্নের জাদুঘর’-এ পাওয়া যায় এখন? এটা এখন নিশ্চিত যে শহরের সবচেয়ে স্থূলকায়দের একজন (যার ওজন চার শ পাউন্ডের ওপরে), তার একবার ব্যবহারযোগ্য মাংসের পুরো ভান্ডারটা ১৫ দিনের সংক্ষিপ্ত সময়ে উড়িয়ে দিয়েছিল (সে আবার হালকা জলখাবার ও মিষ্টান্নের বড় ভক্ত আর তা ছাড়া তার শরীরের বিপাকক্রিয়ার খাই একটু বেশি ছিল)। কিছুদিন পর কেউ আর তাকে খুঁজে পেল না। বোঝাই যাচ্ছিল, সে গা-ঢাকা দিয়েছিল...কিন্তু গা-ঢাকা যে কেবল সে-ই দিয়েছিল তা নয়; সত্যি বলতে কি, আরও অনেকে একই ধরনের আচরণ করতে শুরু করল...আর তাই, মিসেস অরফিলা তাঁর পুত্রের কাছে (যে কিনা তার বাম কানের লতি উদরসাৎ করার কাজে ব্যস্ত ছিল) এ কথা জিজ্ঞেস করে কোনো জবাব পেলেন না যে সে একটা জিনিস কোথায় রেখেছে। অনুনয়-বিনয় বা হুমকি কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞকে তলব করা হলো, কিন্তু যেখানে ছেলেটা বসে ছিল বলে মিসেস অরফিলা দিব্যি দিয়ে বললেন, যখন তিনি তাকে জেরা করছিলেন, সেখানে ছোট্ট একদলা পায়খানা আবিষ্কার করা ছাড়া সেই বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক আর কিছুই বের করতে পারলেন না। কিন্তু এসব ছোটখাটো ঝামেলা নগরবাসীর সুখ-শান্তির এতটুকু বিঘ্ন ঘটাতে পারল না। কারণ, যে নগরের গ্রাসাচ্ছাদন নিশ্চিত করা হয়েছে তা কেন কোনো অভিযোগ করতে যাবে? মাংস-সংকটজনিত জনশৃঙ্খলাবিষয়ক সমস্যা কি সুনিশ্চিতভাবে নিরসন করা হয়নি? মানুষজন যে ক্রমবর্ধমান হারে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, সেটা মূল সমস্যার একটা পরিশিষ্ট মাত্র এবং নিজেদের প্রধান রসদ সংগ্রহের ব্যাপারে জনগণের স্থির সংকল্পকে তা কোনোভাবেই ব্যাহত করেনি। পরিশিষ্ট কি সেই মূল্য, যা নরমাংস প্রত্যেকের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে? কিন্তু এ ধরনের কোনো অসময়োচিত প্রশ্ন করা খুবই ফালতু কাজ হবে, বিশেষ করে এখন যখন এই চিন্তাশীল জনসমাজটির উদর একেবারে পরিপূর্ণ।

>

ভার্জিলিও পিনেরা

ভার্জিলিও পিনেরার জন্ম ১৯১২, কারদেনাস, কুবা; মৃত্যু ১৯৭৯, হাবানা, কুবা। নাট্যকার, কবি, ছোট গল্পলেখক ও প্রবন্ধ রচয়িতা। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা দুটোর নাম ‘লা ইসলা এন পেসো’ (১৯৪৩) ও ‘লা গ্রান পুতা’ (১৯৬০)। কুবার প্রথিতযশা সাহিত্যিক হোসে লেযামা লিমার নেতৃত্বাধীন ‘অরিজেনেস’ নামের একটি সাহিত্যগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন তিনি, যদিও তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রায়ই তাঁর বিরোধ দেখা দিত। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি সিক্লোননামের একটি সাহিত্যবিষয়ক জার্নাল প্রকাশ করেন। আর্হেন্তিনার বুয়েন্স এইরেসে দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে কুবার বিপ্লব সফল হওয়ার ঠিক মাস কয়েক আগে—১৯৫৮ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। আর্হেন্তিনায় থাকাকালে বেশ কিছু লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পিনেরার, যাঁরা অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিকসের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন: হোর্হে লুইস বোর্হেস, মাসেদোনিয় ফারনান্দেজ (যিনি বোর্হেসের ভাষ্য অনুযায়ী, প্লেটো এবং শোপেনহাওয়ার অধ্যয়নের আগেই তাঁদের মতো একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, সান্তিয়াগো দাবোবে, লিওপোলদো মারেচাল—এবং নিশ্চিতভাবেই তাঁরা তাঁর রচনাকে প্রভাবিত করেছিল) এবং তাঁর লেখা বিখ্যাত সুর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

ভার্জিলিও পিনেরার রচনাবলির মধ্যে রয়েছে সাহিত্য-সম্পর্কিত প্রবন্ধাবলি, সাহিত্য সমালোচনা, কোল্ডটেলস শিরোনামে একত্রে নানান ছোটগল্পের একটি সংকলন, অসংখ্য নাটক আর তিনটি উপন্যাস: লাকার্নেদেরেনে (রেনের গায়ের মাংস), প্রেসিওনেসদিয়ামেন্টেস (চাপ ও হিরে) ও লাসপেকিয়িসমানিওব্রাস(ছোট ছোট চক্রান্ত)। কুবার ও লাতিন আমেরিকার নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর রচনা আজ আদর্শ বা নমুনা হিসেবে দেখা হয়।

পিনেরার মৃত্যুর পর ইউনিয়ন নামের একটি পত্রিকায় তাঁর আত্মজৈবনিক কিছু লেখা প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি যে সমকামী, সে ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া নিয়ে আলাপ করেছেন। কিন্তু পিনেরার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি এই যৌনতা ছাড়িয়ে জাতীয় ও মহাদেশীয় পরিচয়, থিয়েটারের প্রতি দার্শনিক দৃষ্টি, লেখালেখি ও রাজনীতি ইত্যাদি নানান দিকে ধাবিত হয়েছে। আর সে জন্য তাঁকে কুবার কবি সিন্তিও বিতিয়ার ও রবার্তো ফারনান্দেজ রাতামারসহ তাঁর সময়ের হিস্পানি মার্কিন সাহিত্যগোষ্ঠী এবং এমনকি ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার রোষানলে পড়তে হয়েছিল।

পিনেরার লেখা ইংরেজিতে যতই অনূদিত হচ্ছে, ততই সেগুলোকে বিংশ শতকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সপক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

পিনেরার গল্পে অদ্ভুত আর উদ্ভটের একটা মেলবন্ধন ঘটে আর মাঝেমধ্যে সেখানে কাফকাসুলভ ভ্রম-বাতুলতার (প্যারোনাইয়া) ছোঁয়া পাওয়া যায়।

হিস্পানি থেকে ইংরেজি অনুবাদ: মার্ক শেফার; ইংরেজি অনুবাদ সংশোধন ও পরিমার্জনা টমাস ক্রিস্টেনসেন

অনুবাদ: জি এইচ হাবীব