শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ

>

২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ বার্ষিকী। এ উপলক্ষে চোখ ফেরানো যাক পূর্ববঙ্গের রবীন্দ্রনাথের দিকে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী

জমিদারি দেখভালের জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর টানা প্রায় ১০ বছর (১৮৯০-১৯০০) রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে জীবন অতিবাহিত করেছেন, গ্রহণ করেছেন নানা কর্মোদ্যোগ, প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান। জমিদারির কাজেই তিনি প্রথম শাহজাদপুরে আসেন, ১৮৯০ সালে। শাহজাদপুর (রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ব্যবহার করেছেন সাজাদপুর বানান) তখন পাবনা জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ মহকুমার একটি থানা—একেবারে নিভৃত পল্লি। চারদিকে নদ-নদী—করতোয়া, বড়াল, গোহালা, হুড়োসাগর—অদূরেই বিশাল চলনবিল। নিভৃত এই উদার প্রকৃতিতে এসে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল প্রতিভা যেন পেয়ে গেল নতুন রসদ। শাহজাদপুর বসবাসকালে তিনি একের পর এক রচনা করেছেন উজ্জ্বল সব সাহিত্যকর্ম—বললেন এই কথা, ‘পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে লিখেছি, কিন্তু সাজাদপুরের মতো লেখার প্রেরণা আমি আর কোথাও পাইনি।’

শাহজাদপুরে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ কবিতা-ছোটগল্প-নাটক-গান-প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সোনার তরী কাব্যের বিখ্যাত ‘আকাশের চাঁদ’, ‘ভরা ভাদরে’, ‘পুরস্কার’, ‘দুই পাখি’—এসব কবিতা শাহজাদপুরে বসে লেখা। নিভৃত পল্লি আর উদার প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের চেতনায় দার্শনিকতা নিয়ে এল, ‘পুরস্কার’ কবিতায় উচ্চারণ করলেন অসামান্য এসব পঙ্‌ক্তি:

বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,

বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা,

লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা

সুন্দর ধরাতল।

মর্ত্যপ্রীতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা রবীন্দ্র-কাব্যধারার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, শাহজাদপুরে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ যেসব কবিতা লিখেছেন, সেখানে এই মর্ত্যপ্রীতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা পৌনঃপুনিক উচ্চারিত হয়েছে। যেমন দেখা যায় ‘আকাশের চাঁদ’ কবিতায়, ‘দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ/ সুন্দর লোকালয়/ প্রতিদিবসের হরষে বিষাদে/ চির কল্লোলময়।/ স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী/ ফিরিছে গৃহের মাঝে,/ প্রতিদিবসেরে করিছে মধুর/ প্রতিদিবসের কাজে।’

আত্মমুক্তি রবীন্দ্র-জীবনদর্শনে উল্লেখযোগ্য। বন্ধন ও মুক্তির দর্শন রবীন্দ্রনাথের অনেক সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয় ভাববস্তু। শাহজাদপুরে বসে লেখা ‘দুই পাখি’ কবিতায় আছে বন্ধন ও মুক্তির দার্শনিক ভাষ্য। দেবতা ও মানুষ রাবীন্দ্রিক জীবনার্থের কাছে যে দাঁড়িয়ে যায় একই মোহনায়, ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় আছে এর নিপুণ প্রকাশ। দেবী আর নারী, মানুষ আর দেবতা রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ধরা দেয় অভিন্ন সত্তায়, ‘আমাদেরি কুটির কাননে/ ফুটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতা চরণে,/ কেহ রাখে প্রিয়জন-তরে—তাহে তাঁর/ নাহি অসন্তোষ। এই প্রেমগীতি-হার/ গাঁথা হয় নরনারী-মিলনমেলায়,/ কেহ দেয় তাঁরে, কেহ বঁধুর গলায়।/ দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই/ প্রিয়জনে—প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই/ তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!/ দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।’

কেবল কবিতাই নয়, শাহজাদপুরে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু ছড়া রচনা করেছেন, সংগ্রহ করেছেন কিছু লোকছড়া। এ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ যেসব ধারা নির্মাণ করেছেন, সেখানে শাহজাদপুরের নানামাত্রিক অভিজ্ঞতার রূপায়ণ ঘটেছে। যেমন নিচের ‘ছেলে-ভুলানো ছড়া’য় দেখা যায় শাহজাদপুরের তেলিপাড়ায় ছবি শিল্পিতা পেয়েছে। ছড়া থেকে উদ্ধৃত করা যাক, ‘খোকা যাবে বেড়ু করতে তেলিমাগীদের পাড়া।/ তেলিমাগীরা মুখ করেছে কেন রে মাখনচোরা।/ ভাঁড় ভেঙেছে, ননী খেয়েছে, আর কি দেখা পাব।/ কদমতলায় দেখা হলে বাঁশি কেড়ে নেব।’

শুধু ছড়া রচনা কিংবা সংগ্রহই নয়, শাহজাদপুরে বসে তিনি রচনা করেছেন ছড়া সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ ‘ছেলে-ভুলানো ছড়া’, যেখানে তিনি উচ্চারণ করেন অসামান্য এই ব্যাখ্যা, ‘আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছাভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচার শাস্ত্রের বাহির, মেঘবিজ্ঞানও শাস্ত্রনিয়মের মধ্যে ভালো করিয়া ধরা দেয় না। অথচ জড়জগতে এবং মানবজগতে এই দুই উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিতেছে। মেঘ বারিধারায় নামিয়া আসিয়া শিশু-শস্যকে প্রাণদান করিতেছে এবং ছড়াগুলিও স্নেহরসে বিগলিত হইয়া কল্পনা-বৃষ্টিতে শিশু-হৃদয়কে উর্বর করিয়া তুলিতেছে। লঘুকায় বন্ধনহীন আপন লঘুত্ব এবং বন্ধনহীনতা-গুণেই জগদ্ব্যাপী হিতসাধনে স্বভাবতই উপযোগী হইয়া উঠিয়াছে; এবং ছড়াগুলিও ভারহীনতা অর্থবন্ধনশূন্যতা এবং চিত্রবৈচিত্র্যবশতই চিরকাল ধরিয়া শিশুদের মনোরঞ্জন করিয়া আসিতেছে।—শিশু-মনোবিজ্ঞানের কোনো সূত্র সম্মুখে ধরিয়া রচিত হয় নাই’।

শাহজাদপুরে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ যেসব ছোটগল্প রচনা করেছেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ছুটি’, ‘অতিথি’, ‘সমাপ্তি’ প্রভৃতি। প্রতিটি গল্পেই আছে প্রকৃতির নিপুণ ব্যবহার। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের গল্পে প্রকৃতি কেবল একজন সার্বভৌম লেখকের দ্বারা ব্যবহৃত হয়নি, বরং হয়ে উঠেছে একটা চরিত্র। তাই ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে জীর্ণ চাল ভেদ করে টপটপ বৃষ্টি হয়ে ওঠে রতনের অন্তর্গত কান্না, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে মৃণ্ময়ীর আত্মিক মৃত্যু ঘটে, ফটিক তো চলেই যায় পৃথিবী ছেড়ে, আর তারাপদর অবস্থা হয় এ রকম: ‘বন্ধন, এমনকি স্নেহবন্ধনও তাহার সহিল না; তাহার জন্মনক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে। সে যখনই দেখিত নদী দিয়া বিদেশী নৌকা গুন টানিয়া চলিয়াছে, গ্রামের বৃহৎ অশ্বত্থগাছের তলে কোন দূরদেশ হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে, অথবা বেদেরা নদীর তীরের পতিত মাঠে ছোটো ছোটো চাটাই বাঁধিয়া বাঁখারি দুলিয়া চাঙারি নির্মাণ করিতে বসিয়াছে, তখন অজ্ঞাত বহিঃপৃথিবীর স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়া উঠিত।’ (‘অতিথি’)

 ছিন্নপত্র-এর ১৪৪-সংখ্যক পত্রে ‘অতিথি’ গল্পের প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরকে তুলে ধরেছেন এভাবে:

একটু একটু করে লিখছি এবং বাইরের প্রকৃতির সমস্ত ছায়া আলোক বর্ণ ধ্বনি আমার লেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমি যে সকল দৃশ্যলোক ও ঘটনা কল্পনা করছি তারই চারিদিকে এই রৌদ্রবৃষ্টি নদীস্রোত এবং নদীতীরের শরবন, এই বর্ষার আকাশ, এই ছায়াবেষ্টিত গ্রাম, এই জলধারা প্রফুল্ল শস্যের ক্ষেত ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যে ও সৌন্দর্যে সজীব করে তুলেছে।

 ছিন্নপত্র বাংলা গদ্যসাহিত্যের ধারায় চিরকালের স্মরণীয় এক নির্মাণ। ছিন্নপত্র পাঠ করলে বাংলাদেশটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘ছিন্নপত্র শব্দটা উচ্চারণ করলেই বাংলাদেশের একটা মানসমূর্তি আমরা দেখতে পাই।’ ছিন্নপত্র-এর অনেক লেখাই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন শাহজাদপুর বাসকালে। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন স্মরণীয় কিছু গান। এসব গানের মধ্যে আছে ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’, ‘যদি বারণ করো’, ‘হেরিয়া সজল ঘন নীল গগনে’, ‘ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে’ ইত্যাদি। এসব গানে বাঙালির প্রেম ও সৌন্দর্য ও বেদনার অনেকান্ত রূপ শিল্পিতা পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরে বসবাসকালেই রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের চিরকালের স্মরণীয় কাব্যনাটক বিসর্জন। এই নাটকে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস এবং প্রতাপের পরাজয় দেখানো হয়েছে—জয় ঘোষিত হয়েছে মানবপ্রেমের। রাজা গোবিন্দ মাণিক্য যে বলেছেন, ‘দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ’, সেটাই বিসর্জন-এর কেন্দ্রীয় ভাবসম্পদ, আজও যা সমানমাত্রায় আছে প্রাসঙ্গিক। কালোত্তীর্ণ এই প্রাসঙ্গিকতাই আলোচ্য নাটকের শিল্পসার্থকতার মূল উৎস।

সামাজিক অনেক কর্মকাণ্ডেও রবীন্দ্রনাথ সংশ্লিষ্ট হন শাহজাদপুরে বসবাসকালে। শাহজাদপুরের বাথানভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের নাম। গরু চরানোর মাঠের অভাবের কথা চাষিদের কাছে শুনে রবীন্দ্রনাথ বুড়িপোতাজিয়া ও রামকান্তপুর মৌজার প্রায় ১২০০ একর জমি গোচারণের জন্য লাখেরাজ দান করেন। সে জমিতে এখনো বাথান আছে, আছে শত শত গরু। এই বাথানভূমির একটা অংশে, ২০০ একর জমিতে গড়ে উঠবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথ যে গোচারণের জন্য জমি দিয়েছেন, তা নয়—উন্নত ভালো জাতের ষাঁড় এনে গাভি প্রজননের মাধ্যমে উন্নত গোসম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছেন। এখনো সেই গাভির জাত শাহজাদপুরে রয়েছে, যে গাভির দুধ দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘মিল্ক ভিটা’।

শাহজাদপুরের জনপদ ও ভূপ্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শাহজাদপুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে বড়ো একটি নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুদীর্ঘ সুন্দর অবসর—সবসুদ্ধ জড়িয়ে আমাকে ভারি উদাস ও আকুল করে।’ (ছিন্নপত্র)। এই উদাস ও আকুল করা ভূপ্রকৃতিই শাহজাদপুর পর্বে রচিত রবীন্দ্র-সৃষ্টিশীলতায় নিয়ে এসেছে দার্শনিকতার ঋদ্ধি। শাহজাদপুর মানুষের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করেছে কবি রবীন্দ্রনাথকে। সোনার তরী কাব্যের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:

এইখানে নির্জন-সজনের নিত্যসংগম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নাগ সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়।