পুনশ্চ তৈল

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

তেলের তেলেসমাতি তড়িৎ প্রবাহের মতো দ্রুততর এবং বাড়াবাড়ি রকমের বিস্ময়কর! ভুবনসংসারে এই বাক্য ভুলে থাকেন এমন মানুষ বিরল। কিন্তু তেল চর্চায় প্রধান বিবেচনার বিষয় কাল-মাত্রা বুঝে প্রয়োগ। স্থানভেদে তিন ফোঁটার জায়গায় চার হলেই সম্ভাবনা চৌচির। সুতরাং সিদ্ধ না হলে এ কাজ সম্ভব নয়; সবার দ্বারা তো নয়ই।

এ কালে কলুদের এতটা কায়দা না জানলেও চলে। কিন্তু করপোরেট কলুদের এটুকু জানতেই হয়। যিনি যত তেলসিদ্ধ তাঁর কার্যসিদ্ধি তত বেশি। জীবনের জয়রথ তাঁর সাঁই সাঁই বেগে ধায়। সহকর্মীদের তখন তিল থেকে তেল বের করে নেওয়া খৈলজীবন দশা। অথচ মুখে প্রশংসার ফুল! শ্রদ্ধা-স্নেহের বেসাতি।

তেল¯স্নেহজাতীয় পদার্থই বটে। মহামতি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন, ‘যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’

যথার্থ উবাচ। তবে তিনি যা ঊহ্য রেখেছেন তা হলো মাত্রা। তেল বা স্নেহের মহিমায় জীবন যেমন চকচকে হতে পারে, অতি স্নেহে ফকফকাও হতে পারে। এ কথা পৃথিবীর সব মা-বাবাই মানবেন। এবং এই আশঙ্কা স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁর ছেলেকে নিয়ে করেছেন।

ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট ছেলে ঈশানচন্দ্র এবং বড় নাতি অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছেলে নারায়ণকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। ফলে দুজনের বাঁদরামি গেল বেড়ে। কারও কথা তারা শোনে না, এতই বেয়াড়া। অথচ বাড়ির অন্য কেউ তাদের শাসন করবেন, সে সাহসও নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে বিদ্যাসাগর অনুযোগের স্বরে একদিন বলেই ফেললেন, ‘বাবা, আপনি না নিরামিষাশী?’

ছেলের এমন প্রশ্নে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্মিত। তাঁর ঠোঁটের স্মিত হাসি উবে গেল। ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ’। এ সময় ঈশ্বরচন্দ্র ততোধিক বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘এরপরও আপনি দুবেলা ঈশান আর নারায়ণের মাথা খাচ্ছেন!’

কথায় বলে, অতি দর্পে হতো লঙ্কা। অভিধান বলছে, দর্প, তেজ, অহংকার ইত্যাকার শব্দগুলো তেলের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি। আবার জ্ঞানচক্ষু মেলে দেখুন, আদর, সোহাগ, প্রণয়, প্রীতি স্নেহের প্রতিশব্দ। সুতরাং জীবনে তেলের প্রয়োজন আলবাত আছে; এবং অতি অবশ্যই জীবন তেলময়।

বঙ্গে তেলের সঙ্গে শিশুর প্রথম পরিচয় অঙ্গে, নানি-দাদির হাতে। তারা অরুণ আলোয় পা ছড়িয়ে নাতিকে নিয়ে বসেন আয়েশ করে। পাশেই থাকে তেলের বাটি। ওদিকে আধুনিক মায়েরা তেলে-বেগুনে জ্বলতে থাকেন। এ পদ্ধতিতে তাঁদের প্রবল আপত্তি। ফলাফল—অভিজ্ঞতা বনাম আধুনিকতা মুখোমুখি। এ যাত্রা চাইলেই দাদিমার দল জিততে পারে। ঠোঁট টিপে শুধু বললেই হবে, ‘বউমা, তোমার মতো টানা টানা চোখ, ওরকম টিকালো নাক; তেল দিয়ে একটু টেনে না দিলে হবে কী করে?’

ব্যস হয়ে গেল। এ হলো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো ব্যাপার। তেলবিষয়ক এই যুদ্ধে তেলই হলো ব্রহ্মাস্ত্র। সেই অস্ত্রে ব্রহ্মতালু ঠান্ডা, বউমাও খুশি।

তেল যিনি দিতে পারেন তাঁর খুশি সবচেয়ে বেশি। কারণ, তিনি মহা ভাগ্যবান। তিনি কাশি দিলেও আশপাশের কানগুলো সজাগ হয়। তাঁর হাসিতেও স্বার্থ ঝরে; না জানি কোন কার্যসিদ্ধি তিনি করেন। তাঁর কর্মদক্ষতা অতিশয় অপকর্মে পটু পিকেটারকেও হার মানায়। তাঁর বুদ্ধি বীরবল, হোজ্জা, ভাঁড়—ত্রিরত্ন সমতুল্য। বীরত্বে তিনি মহাবীর আলেক্সান্ডার। তবে হ্যাঁ, বিদ্যায় তাঁকে বিদ্যাসাগর হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং বিদ্যা সঠিক মাত্রায় থাকলেই এ কাজে বাধা।

¯স্নেহহীন জীবন তেলহীন মরুভূমির মতো। সেই তেলের মূল্য মরুবাসী জানত। আর সেই বয়সেই জেনেছিল ভবের আলী, ওরফে ভবা—আমাদেরই সহপাঠী। আমরা তখন তেল চুকচুকে চুলে চিরুনি চালিয়ে সবেমাত্র স্কুলের বারান্দায় পা রাখতে শুরু করেছি। অথচ ভবা মাথায় তেল দিত না। কেন দিত না, এখন অনুমান করতে পারি। কারণ সে তেল দিত অন্যের তেলেমাথায়।

ভবা ক্লাসে ঢুকেই চকিতে দেখে নিত চারপাশ। তারপর চুপচাপ বসত ক্লাস ক্যাপ্টেনের পাশে গিয়ে। মাথা তার মন্দ ছিল না। আমাদের মন্দ লাগত তার ওই উঠতি বুদ্ধিজীবী স্বভাব। সেই স্বভাবদোষেই একদিন বিচার দিলাম স্যারের কাছে, ও সব সময় ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বসে কেন?

স্যার ভবার কাছেই এর ব্যাখ্যা চাইলেন। ভবা প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও সামলে নিয়ে যে উত্তর দিল, তাতে আমরা ভাবনায় পড়ে গেলাম। মা বলেছেন, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস। ভবা ক্যাপ্টেনের মধ্যে নাকি স্বর্গ খুঁজে পেয়েছে। তাই তার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা।

এর অর্থ আমাদের সঙ্গ নরকতুল্য! টিফিন পিরিয়ডে ওকে তুলোধুনো করা হবে মোটামুটি ফাইনাল। অপমানে আমাদের মনোজগতে নারকীয় তাণ্ডব শুরু হলো। মাঝখান থেকে ক্যাপ্টেন এসে পরিকল্পনার ফর্দাফাই করে দিল। ভবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে।

তবে তেল দেওয়াটা ভবা ছাড়তে পারল না। ক্লাসে স্যার পড়া ধরলেই সে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। একদিন তো বলেই ফেলল, স্যার ক্লাসে আপনি এত সুন্দর পড়ান, বাসায় গিয়ে পড়ার আর দরকার হয় না।

তাহলে পরীক্ষায় এত কম পেলি কেন? স্যার জিজ্ঞেস করতেই ভবা সটান বলে দিল, স্যার, আপনারা এত কষ্ট করে পড়ান। আবার এত কষ্ট করে খাতা দেখবেন, তাই তো একটু কম কম লিখি।

পাটিগণিতের বানর যেমন তেলতেলে বাঁশ বেয়ে ওঠানামা করে, মানুষের ভাগ্যও তেমনি ওঠানামা করে ওই তেলের কল্যাণে। পেশাজীবনে এসে এ কথা ভবা ভুলে যায়নি। এই জায়গায় সে অকৃত্রিম ও অকৃপণ। তার চাকরিজীবন বেশি দিনের নয়। অথচ এরই মধ্যে সহকর্মীদের ‘ওভারটেক’ করে ওর প্রমোশন হয়েছে দুবার!

কান পেতে শুনেছি ভবা দুহাত কচলালে কটকট শব্দ হয়। কারণ, কচলানোর কসরতে হাতের রেখা তো মুছেছেই, চামড়া-মাংস পাতলা হয়ে হাড়ে হাড়ে বাড়ি খায় যেন। জি স্যার জি স্যার...হ্যাঁ হ্যাঁ...তা যা বলেছেন...সেই সেই...আহাহা—এসবÑশব্দ ছাড়া ভবা এখন আর কথাই বলতে পারে না। সহপাঠী থেকে সহকর্মী হয়েছি বিধায় আমি এসব বিলক্ষণ জানি।

ভবা জানে এবং মানে বউ এবং বস অলওয়েজ রাইট। এই নীতিতে সে অটল। বস যদি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, হাসিনা-খালেদা দুজনে মিলে দেশ চালালে কত সুন্দরই না হতো।

হ্যাঁ, সেই সেই। ভবার কণ্ঠে তখন দীর্ঘ আশ। ভরসা নিয়ে বলে, স্যার, একবার চেষ্টা করেই দেখুন না। আপনাদের কত ওপরে চলাফেরা। এত বড় প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন আর এই দুজনকে এক করতে পারবেন না? কী যে বলেন স্যার, আপনারা চাইলে কী না হয়!

এই তো সেদিন ভবা এসে বলল, বাইরে একটু ক্যাফেতে বসব চল। বলি এটা আমন্ত্রণ নাকি নিমন্ত্রণ? নিমন্ত্রণে সে নিমরাজি। আমন্ত্রণে আমার আপত্তি। অবশেষে তার জোরাজুরিতে উঠতেই হলো। অথচ হঠাৎ তার এই জারিজুরির কারণ বুঝতে পারছিলাম না। বুঝলাম ক্যাফেতে বসার পর। দুকাপ কোল্ড কফির অর্ডার দিয়েই সে সাঁই করে আমার হাত থেকে সেলফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, আমার এমবি ফুরিয়ে গেছে। শুনলাম, বসের ওয়াইফ নাকি নিউ লুকে হ্যাব্বি একটা সেলফি পোস্ট করেছে। লাইক না দিলে কেমন হয় ব্যাপারটা বল?

আমি বলব কী, ততক্ষণে বাকহারা। ওদিকে ভবা বসগিন্নির বয়কাট চুল দেখে আত্মহারা। পরামর্শ চাইল, কমেন্টে গিয়ে কিছু লিখে দেব নাকি?

বললাম, দিতে পারিস যদি সে রকম আউটস্ট্যান্ডিং থাকে।

এইবার মার্কেটিং ঝাড়তে শুরু করল ভবা। শোন, পৃথিবীতে কোনো কিছু বিক্রি হয় না, বিক্রি করতে হয়। আন্ডারস্ট্যান্ড?

আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। উঠতে হবে। ভবা হাত ধরে টেনে বসাল। তারপর কমেন্টে গিয়ে সত্যি সত্যি লিখে দিল, ম্যাডাম, দারুণ লাগছে! একেবারে চুল তার কবেকার অন্ধকার...।

মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, এইবার ভবার চাকরিলীলা বুঝি সাঙ্গ হতে চলল। পেশাজীবনে লোডশেডিং বুঝি আর ঠেকানো গেল না। অন্ধকারই অন্ধকার। কিন্তু কিসের কী! কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টা কমেন্ট, থ্যাংক ইউ। বাসায় দাওয়াত রইল। ভাবিকে নিয়ে একদিন আসুন। বাসায় ফিরে তেল চিটচিটে বালিশে শুয়ে ভবা স্বপ্ন দেখে আরেকটি প্রমোশনের। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বসগিন্নির তেলসিক্ত মুখ। তেল সবাই পছন্দ করে কিন্তু তেলতেলে মুখ কেউ পছন্দ করে না। অথচ ভবাকে এখন তাই পছন্দ করতে হচ্ছে। উপায় নেই।

ভবাকে হঠাৎ অন্যমনস্ক দেখে সন্দিহান হয়ে ওঠে স্ত্রী। মেঘস্বরে জানতে চায়, মশারি না লাগিয়ে শুয়ে শুয়ে কার কথা ভাবছ?

ভবা সচকিত হয়ে ওঠে, না না, কার কথা ভাবব? ম্যাডাম দাওয়াত দিয়েছেন। তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন হে হে।

স্ত্রী বেচারি হাসির ধারেকাছেও যায় না। ভ্রু কুঁচকে চোখের ওপর সন্দেহের সেতু বানিয়ে পানি পানরত হরিণীর মতো সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায়, অফিসে এত লোক থাকতে সে তোমাকে দাওয়াত দেবে কেন? তার মেঘস্বর কণ্ঠে গুরু গুরু ডমরু বাজে।

সংসারজীবনে ভবা এই শব্দ বহুবার শুনেছে। এ হলো ভারী বিপৎসংকেত। দ্রুত ধেয়ে আসা ঝড় ঠেকাতে ভবা অতি দ্রুত কচলাতে শুরু করেÑদুহাত, ইয়ে মানে, হয়েছি কি, আমরা ফেসবুকে যে ম্যারেজ ডের ছবি পোস্ট করেছিলাম, ম্যাডাম সেটা দেখেছে। উইশ করে তোমার খুব প্রশংসা করল। বলল, ছবিতে তোমাকে নাকি দীপিকার মতো লাগছে হে হে। তোমাকে দেখতে চায়।

চুপ! একদম বকবে না। ঘরে যেন এবার বাজ পড়ে। সেই শব্দে পুনরায় ভ্যাবাচ্যাকা খায় ভবা। মনে মনে ভাবে, ভুলটা হলো কোথায়?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘তৈল’-এর শেষ বাক্যে লিখেছেন: ‘মনে রাখা উচিত—এক তৈলে চাকা ঘোরে, আর-তৈলে মন ফেরে।’ তিনি সম্ভবত স্ত্রী-মনের কথা ভুলে গিয়েছিলেন।