রোদ্দুর হতে চেয়েছিল অমলকান্তি
যিনি লিখেছেন কলকাতার যীশু, সেই ‘কলকাতার যীশু’ বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় সেই ১৯৬৯ সালে। তবে তাতে কিছু জল-হাওয়া ছিল, ছিল মেঘের হাতছানি। তাই ছুঁয়ে গেলেও স্পর্শ পাওয়া হয়নি। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর ১৯৭২-এ এসে মুক্ত হলো উলঙ্গ রাজায়। সমগ্র বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাওয়া মানে—কবিতাকে করতলে স্থাপন করে মুষ্টিবদ্ধ করা। বুঝি সেখানেও খোলার ব্যাপারটি মুখ তুলে দেখে—কেই–বা রাজা আর কেই–বা শিশু। এই যেমন—
‘সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টালমাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক কিনার থেকে অন্য কিনারে চলেছ।’
(‘কলাকাতার যীশু’)
গল্পটা সবাই জানলেও বলে না, বলার সাহস নেই। জিজ্ঞাসা করে না—
‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’
(‘উলঙ্গ রাজা’)
আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে বাস্তবে নিয়ে এসে যিনি দৃশ্যটি উন্মুক্ত করেন, তিনি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ফরিদপুরের চান্দ্রা গ্রামে জন্ম নেওয়া এই কবি আনন্দবাজার পত্রিকায় শুরু করেন কর্মজীবন। আনন্দমেলার সম্পাদনায় যুক্ত হন। এর মাঝখানে তো এই কবির নীলনির্জন–এ (১৯৫৪) প্রবেশ এবং যাত্রাপালে হাওয়া লাগানো। কবিতা, ছড়া, ভ্রমণকাহিনির পাশাপাশি প্রবন্ধ, গোয়েন্দাগল্প এবং প্রয়োজনের গদ্য রচনায় ভরিয়ে দেওয়া বাংলা সাহিত্য।
তাঁর কবিতা তাঁর মতোই ঋজু, তাঁর মতোই হৃদয়-সারল্য নিয়ে পাঠককে বৃত্তটি পূর্ণ করতে সহায়তা করে। সম্মুখের চালচিত্রটি পরিস্ফুটিত হয় মনোজানালায় এবং একসময় আলো হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিকে। বিস্মৃতির এই কালে একজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেমন হরণপ্রত্যাশী, তেমনি আবার সংযোগসাধকও। তাই তো অমলকান্তিকে নিয়ে তাঁর সগৌরবকথন—
‘আমরা কেউ মাস্টার
হতে চেয়েছিলাম,
কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু
হতে চায়নি
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।’
(‘অমলকান্তি’)
আপনার মুখচ্ছবি পরিচ্ছন্ন অবস্থায় আয়নায় দেখেছেন কবি—আর এ দেখার মধ্যেই অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে বাংলা কবিতা। হ্যাঁ, মাত্রই গত হয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কিন্তু সত্যিই কি তিনি চলে গেছেন? তাঁর শব্দকল্পদ্রুম তো আমাদের চোখের সামনেই। আমরা মনে করতে চাই তাঁর দীর্ঘজীবনের কাব্যসাধনার রূপ-প্রকৃতি, ক্ষীণভাবে হলেও আমরা বিচার করতে চাই গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের এই কবির অবস্থান এবং সেই স্মরণে ও বিচারে নিঃসন্দেহে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর দেখাকে অবলোকন করেছেন। তাঁর যাত্রাকে করেছেন ভ্রমণ। তা নীলনির্জন কাব্যগ্রন্থ দিয়ে শুরু করে একে একে অতিক্রম করে অনেকগুলো স্টেশন, অনেকগুলো গ্রন্থ। সেখানে চল্লিশের দিনগুলি যেমন আছে, আছে কবি চেনে সম্পূর্ণ চেনে না নামক কাব্য-জংশন। যাবতীয় ভালোবাসাবাসিএক অম্লমধুর স্বাদে ভরিয়ে তোলে জিহ্বার অগ্রভাগ এবং মস্তিষ্কের চেতনা।
‘কিছু কথা অন্ধকারে বিদেশে ঘুরছে,
কিছু কথা বাতাসে উড়ছে,
...
হেমলতা,
এক্ষুণি ভেঙো না তুমি ঘর।
ধৈর্য ধরো, ভিক্ষা দাও
আর মাত্র কয়েকটি বছর।’
বছর অতিক্রান্ত হয়,—কবিতা যেন মায়া ও ছায়া নিয়ে তার দীর্ঘ বাহু বাড়িয়ে দেয় আলোর দিকে।
‘আমি পাহাড় থেকে
পড়তে পড়তে
তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি
কবিতা।’
এ তো গেল আলোর কথা, মানুষের কথা। অন্যদিকে—
‘অন্ধকারের মধ্যে পরামর্শ করে
গাছগাছালি,
আজ এই রাত্রে কার ভালো আর
মন্দ কার।’
(‘বুকের মধ্যে চোরাবালি’)
বুকের সঙ্গে বুক মিলিয়ে অধিকারের স্থানটি পোক্ত করেছেন বাংলা কবিতায়। সময়কে আঙুলের অগ্রভাগ হতে কখনো ছেড়ে দেননি এবং এর ফলেই যে শব্দ–স্রোত প্রবাহিত হয়েছে, তিনি রয়ে গেছেন তার সঙ্গী হয়ে।
সৃষ্টির নানান প্রান্তে টোকা দিয়ে যা কবিতা তা তুলে নিয়েও হেলা তিনি করলেন না শিশুতোষ রচনায়। লিখলেন ছড়া—নির্মাণ করলেন ‘ভাদুড়ী মশাই’-এর মোহমুক্ত নিবাস। আর ‘মোহনভোগের সঙ্গে লুচির’ মেলবন্ধনে বাংলা কবিতার ছন্দ আনন্দরূপে কবিতার ক্লাশ হয়ে ধরা দিল পাঠকের চিত্তে। অক্ষর, স্বর ও মাত্রা যেন তাঁর সরস এবং সরল বর্ণনায় কাব্যামোদীকে নবদ্বার উন্মোচনে সহায়তা করল।
কবিতা কী ও কেন তাঁর লেখা বই। কিন্তু ববিতা কী ও কেন প্রশ্নটিও বড় জটিল, তার পরও উল্লিখিত বইয়ে কবির উত্তর ঘোর অতিক্রম করে অঘোর। গদ্যের লাবণ্যে কঠিনও যেন পেল পেলব অবয়ব, আমরা আপন করে নিলাম কবিতার এই প্রাণপুরুষকে উৎস-মাত্রায়।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার থেকে আনন্দ পুরস্কার, উল্টোরথ পুরস্কার, তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। এত কিছুর পরও এক মোমবাতি তিনি অহংকারে দুদিকে জ্বালেননি।
‘পোড়া কাঠ আর
ভাঙা কলসির দিকে
ফিরে তাকাবার নিয়ম নেই।
চলো,
আর এক পরিচ্ছেদ
আমাদের ডাকছে।’
(‘অন্য যন্ত্রণার দিকে’)
সেই ডাকে সাড়া দেওয়াই যেন নিয়তি—
তবে কাঠ পুড়ে গেলেও অবশিষ্ট থাকে ছাই, কলসি ভাঙলেও জল গড়িয়ে ভেজে মাটি। নতুন সে আহ্বানে জয় গাই নতুন আরেক কবির—কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।