গুডবাই শ্যারোল

ভ্যাসন আইল্যান্ডে যাওয়ার ফেরি, এই ফেরিতে করেই যাওয়া হয়েছিল মিসেস শ্যারোল সিলভারম্যানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। ছবি: লেখক
ভ্যাসন আইল্যান্ডে যাওয়ার ফেরি, এই ফেরিতে করেই যাওয়া হয়েছিল মিসেস শ্যারোল সিলভারম্যানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। ছবি: লেখক

লেসের পর্দা ঝোলানো জমকালো সব কালো লিমোজিনে চড়ে আমরা সিয়াটল থেকে ভ্যাসন আইল্যান্ডে যাওয়ার ফেরিঘাটে এসে উঠি। ওখানে দাঁড়িয়ে একজন নিঃসঙ্গ বাদক স্কটিশ কেতার ধড়াচূড়া পরে বাজিয়ে চলেছেন ব্যাগপাইপ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ে শুনি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিদায় প্রতীক হিসেবে যুগ যুগ ধরে বাজানো অ্যামেজিং গ্রেইস বলে পরিচিত খ্রিষ্টান হিম। সংগীতপ্রিয় মিসেস শ্যারোল সিলাভারম্যান ইংরেজ কবি জন নিউটন (১৭২৫-১৮০৭) রচিত এ থিমটি তাঁর কৈশোরে পাড়ার চার্চে অর্গানে বাজাতেন। তারুণ্যে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে ইহুদি বৈজ্ঞানিক ড. উইলিয়াম সিলভারম্যানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন থেকে পার্টি-পরবে শ্যারোল সংগীতটি পিয়ানোতে বাজাতেন। আমরা যারা আজ মিসেস শ্যারোল সিলভারম্যানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাত্রী হয়ে এসেছি, তাদের ফেরিতে উঠে দ্বিতলে একটি রিজার্ভ কেবিনে বসতে মেগাফোনে বলা হয়।

গেল সপ্তায় মিসেস শ্যারোল সিলভারম্যানের মৃত্যু হয়েছে স্তন ক্যানসারে। তাঁর স্বামী ড. উইলিয়াম সিলভারম্যানের উত্তরাধিকারসূত্রে বিত্ত আছে অঢেল। এ নিঃসন্তান ইহুদি দম্পতি তা দেদার ব্যয় করেছেন বিলাসবহুল ইয়াট আর ক্রুজ শিপে ক্যারিভিয়ান সমুদ্রের নানা দ্বীপ বাহামা আর আলাস্কায় নৌভ্রমণ করে। শ্যারোল ভালোবাসতেন সমুদ্রের নোনা জল, তাই মওকা পেলেই পালতোলা ইয়াটে ভাসতেন আর পর্যবেক্ষণ করতেন তিমির সন্তরণ বা হাজারবিজার স্যামন মাছের দল বেঁধে অভিবাসী হয়ে দরিয়া থেকে প্রণালির দিকে চলে যাওয়ার দৃশ্যপট। মৃত্যুর দিন কয়েক আগে তিনি তাঁর উইলে মেরিন রিসার্চের উন্নয়নের জন্য লাখ তিনেক ডলার দান করে গেছেন।

আজ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের অনেকেই এসেছেন। সমুদ্রের সঙ্গে শ্যারোলের অন্তরঙ্গতা ছিল গভীর। তাঁর জন্ম হয়েছিল আজ থেকে সাতান্ন বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহর থেকে অল্প দূরে ভ্যাসন আইল্যান্ড নামে ছোট্ট একটি দ্বীপে। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তিকে উপসাগরের মতো এ জলভাগকে পিজিট সাউন্ড বলা হয়। কিশোরী শ্যারোল এই ফেরি ধরে বহুবার ভ্যাসন দ্বীপ থেকে সিয়াটলে এসেছেন। খুব অল্প বয়সে এ দরিয়ায় ভেসে বেড়ানো কিলার হোয়েল বা একধরনের তিমি মাছ ও হারবার সিলের ছবি তুলে তিনি স্কুলে নাম করেছিলেন। যেহেতু তিনি লোনা দরিয়া দারুণভাবে ভালোবাসতেন, সুতরাং তাঁর দেহভস্ম আজ সমুদ্রজলে ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাঁর স্বামী নিউক্লিয়ার সায়েস্টিস্ট সিলভাম্যান ধাতব একটি বউলে রাখা তাঁর দেহভস্ম বুকের কাছে ধরে আছেন। আর বেলকনির হু হু হাওয়ায় দাঁড়িয়ে এক ইহুদি রাবাই বা ধর্মযাজক পবিত্র গ্রন্থ তালমুদ থেকে পাঠ করে যাচ্ছেন।

শ্যারোল জানতেন যে তাঁর অন্তিম সময় এগিয়ে আসছে দ্রুত। তাই একদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে তাঁর স্বামী ড. সিলভারম্যানকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ আ ভেরি গুড লাইফ ইন দিস ওয়ার্ল্ড। আমার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। কী আর করা যাবে? তুমি আমার হাইস্কুল–জীবনের সুইটহার্ট, আমি যখন নাইনথ গ্রেডে পড়ি, তখন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম ডেট হয়। তারপর অনেক দিন একসঙ্গে। আমার মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তোমরা শোক না করে যদি আমার জীবনকে সেলিব্রেট করতে পারো, তাহলে আমার আত্মা খুশি হবে।’

আমি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহর থেকে হাজার মাইল দূরে ম্যাসাচুসেটসে থাকি। তাই হাসপাতালে অসুস্থ শ্যারোলকে দেখতে যেতে পারিনি, তবে টেলিফোন করেছিলাম। কথা বলে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে। তিনি কেমোথেরাপির রিঅ্যাকশনের ভেতরও স্পষ্টভাবে আমার লেখা একটি ফিচারের ডিটেইলড বর্ণনা মনে রাখতে পেরেছেন। ঢাকার বলধা গর্ডেন নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটি–ভিত্তিক পত্রিকায় ছোট্ট একটি ফিচার লিখেছিলাম। অনেক বছর আগে বলধা গার্ডেনের এক তরুতলে দাহ করা হয়েছিল বাগিচার স্বত্বাধিকারীকে। পাথরে বাঁধানো এপিটাফটি বোধ করি আজও বলধা গার্ডেনে আছে, যাতে লেখা: জীবনে অনেক পুষ্প ফুটেয়েছি, শুনেছি রহস্যময় সংগীত, সুকুমার শিল্পের চর্চায়ও কেটে গেছে চাঁদনি রাত, এভাবেই তো কাটল এ জীবন; পুনরায় জনম নিয়ে আর আসতে চাই না এ ভুবনে। শ্যারোল ফিচারটির রেফারেন্স দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘লিসেন, আই হ্যাভ আ গুড লাইফ, আই হ্যাভ এনজয়েড প্লেন্টি অব ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক কনসার্ট, অবজার্ভড ফাইন আর্টস, উয়েন্ট টুওস্যানক্রুজ অ্যান্ড অল দ্যাট। লিসেন, ইট ইজ মাই টাইম টু গো।’

ধড়াচূড়া পরে ফেরিঘাটে সেই নিঃসঙ্গ বাদকের ব্যাগপাইপ বাদন
ধড়াচূড়া পরে ফেরিঘাটে সেই নিঃসঙ্গ বাদকের ব্যাগপাইপ বাদন

ফেরি ভ্যাসন আইল্যান্ডে পৌঁছার খানিক আগে আমরা—তথা তাঁর অত্মীয়স্বজন ও সুহৃদরা প্রয়াত শ্যারোলের স্মৃতি নিয়ে মন্তব্য করি। তিনি আমাকে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কোর্তা-পাজামার সঙ্গে কটি পরে আসতে বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘তুমি স্বদেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশে এসেছ, তোমার সংস্কৃতি ভিন্ন, তুমি তোমার নিজ দেশের কাপড়চোপড় পরবে, পোশাকাদি নিয়ে কম্প্রোমাইজ করার কোনো প্রয়োজন নেই।’ আজকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে সবাই ডার্ক স্যুট বা কালো গাউন পরে এসেছে, তাদের মধ্যে বাঙালি পোশাকে আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি। খানিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বেও ভুগি শ্যারোলের কোন স্মৃতিটি বলব, তা নিয়ে। তাঁর স্মৃতি এতই টাটকা যে মনে হয় তিনি ফেরিতে আমাদের পাশেই বসে কাপাচিনোর কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে আছেন প্রশান্ত মহাসাগরের জলের দিকে। আমি যখন দ্বিতীয়বার আমেরিকাতে পাকাপাকিভাবে চলে আসি, তখন আমার প্রয়োজন হয়েছিল স্পনসরের। স্পনসর ছাড়া ইমিগ্রেশন ভিসা পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না, বিষয়টি জানতে পেরে তিনি ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্পনসরশিপের কাগজপত্র। তারপর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের প্রথম দিকে আমি মৎস্যভুক জানতে পেরে মাঝেমধ্যে স্মোকড স্যামন বা ট্রাউট মাছের প্যাকেট মেইল করে পাঠাতেন।

মেমোরিয়াল সার্ভিসে আমার মন্তব্য করার পালা আসে। আমি ওরিগানে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমার ভ্রমণের গল্প বলি। আমরা সবাই সি বিচে রিলাক্স করছিলাম। শ্যারোল জানতে চেয়েছিলেন, ওরিগানের কোনো বিশেষ এলাকায় যাওয়ার আমার ইচ্ছা আছে কি? আমি হেল ক্যানিওন বলে পরিচিত পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি দুর্গম গিরিপথের উল্লেখ করেছিলাম। পরদিন সত্যি সত্যিই তিনি ও তাঁর স্বামী ফোরহুইল লাগানো আর-ভি ভাড়া করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হেল ক্যানিওনের গিরি উপত্যকায়। আমরা পাহাড়ের ওপর এক পাথুরে কন্দরে বসে তাকিয়ে ছিলাম, দূরে অনেক নিচে পাহাড়টির তলায় মস্ত সব শিলায় বাড়ি খেয়ে উছলে ওঠা নদীজলের দিকে। বাইনোকুলার হাতে শ্যারোলকে সেদিন খুব এক্সাইটেড দেখাচ্ছিল। পাহাড়ি নদীতে বিরাট গোলাকার আধডোবা পাথরখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে ছানাপোনাসহ একটি ভালুক পরিবার। জলের তোড়ে লাফিয়ে উঠছিল রুপালি সব মাছ, আর ভালুকেরা শূন্য থেকে ওই মাছগুলো লুফে নিচ্ছিল তাদের মুখে। হেল ক্যানিওন থেকে ফেরার পথে আমি গাড়ির টেপ ডেকে মোৎসার্টের একটি ক্যাসেট বাজিয়ে দিলাম। মোৎসার্টের ট্র্যাজিক জীবন নিয়ে গল্প করতে করতে শ্যারোল বলেছিলেন, ‘তোমাকে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় নিয়ে যেতে হয় কিন্তু। ওখানকার ক্ল্যাসিক্যাল কনসার্ট হলে বসে তোমাকে খাস ভিয়েনা শহরে বাজানো মোৎসার্ট শুনিয়ে দেব, ওকে।’

শ্যারোলের সঙ্গে ভিয়েনায় কোনো দিন মোৎসার্টের সংগীত শুনতে যাওয়া হবে না, এ আফসোসের উল্লেখ করে মন্তব্যের ইতি টানি আমি।

ভ্যাসন দ্বীপের কাছাকাছি এসে ভেঁপু বাজিয়ে ফেরি অল্পক্ষণের মাঝদরিয়ায় থামে। বেলকনিতে বাদক ব্যাগপাইপে ফের অ্যামেজিং গ্রেইসের সুর বাজান। ড. সিলভারম্যান ও রাবাই ধাতব বউল থেকে শ্যারোলের দেহভস্ম ছুড়ে দেন নোনা জলে। ভ্যাসন আইল্যান্ডে প্যাসিনজার্স নামিয়ে ফেরার সময়—কেবিনে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর বিগত জীবনকে সেলিব্রেট করার রিসেপশন। পরিবেশিত হয় শ্যাম্পেন ও ক্যাভিয়ার। ড. সিলভারম্যান সবাইকে তাদের দাম্পত্য জীবনের অনেকগুলো নৌভ্রমণের ছবি দেখিয়ে মন্তব্য করেন, সে অনেক বছর আগের কথা, সিয়াটল শহর থেকে ফেরি ধরে শ্যারোলের সঙ্গে ডেট করার জন্য তিনি ভ্যাসন আইল্যান্ডে যেতেন। ফেরার সময় প্রায়শই শ্যারোল তাঁর সঙ্গী হতেন। এ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাঁরা সমুদ্রের তরঙ্গবহুল বিস্তার দেখতেন।

বিদায় নিয়ে ফেরি থেকে নামার সময় ড. সিলভারম্যান আমার হাতে একটি এনভেলপ দেন। রিটার্ন ফ্লাইটের জন্য এয়ারপোর্টে এসে আমি সেটা খুলি। এনভেলপে ভিয়েনায় যাওয়ার একটি ওপেন টিকিট, শেরাটনে দিন চারেক থাকার গিফট কুপন ও থিয়েটারে মোৎসার্টের কনসার্ট শোনার যাবতীয় বন্দোবস্ত। সঙ্গে ছোট্ট একটি কার্ডে কাঁপা হাতে লেখা, ‘স্যারি, আই কুড নট আকমপেনি ইউ। তোমার সঙ্গে একত্রে বসে ভিয়েনায় মোৎসার্ট শোনার সুযোগ হলো না। কী আর করা যাবে? গুড বাই, লাভ, শ্যারোল।’

এয়ারপোর্টের লবিতে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করতে করতে আমি ভাবি, আজ থেকে যে ভুবন হবে শ্যারোলের বিদেহী আত্মার নিবাস, সেখানে আমার অন্তর্গত অনুভূতিকে পৌঁছে দেওয়ার কোনো উপায় আছে কি?