এমন গল্প সবার হোক

‘কন্যা আর আমরা’ শীর্ষক ২৪ নারীর শিল্পকর্ম প্রদর্শনী কাল শুরু
‘কন্যা আর আমরা’ শীর্ষক ২৪ নারীর শিল্পকর্ম প্রদর্শনী কাল শুরু

পারিবারিক চাপে ১৮ বছর রং তুলি থেকে দূরে ছিলেন শাকিলা চয়ন। তবে ১৮ বছর পর যখন তুলি হাতে নিলেন দেখলেন তিনি ছবি আঁকা ভুলে যাননি। তারপর চারপাশ তাকিয়ে দেখলেন অনেক শিল্পীই পারিবারিক, সামাজিক চাপ বা নিছক আলসেমির কারণে ছবি একদমই আঁকছেন না বা আঁকলেও নিয়মিত না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মেসেঞ্জারে চলতে থাকে আলাপ। অন্যরা যখন দেখলেন, শাকিলা ১৮ বছর পরও নির্দ্বিধায় ছবি আঁকছেন তখন অন্যরাও মনে সাহস পেলেন।

এই সাহসে ভর করেই আঁকিয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ২৪। মেসেঞ্জারেই ‘কন্যা’ নামের একটি গ্রুপ তৈরি করলেন। এই গ্রুপের স্লোগান-চলো আঁকি। আর এই গ্রুপের এক বছর পূর্তিতে এই ২৪ শিল্পীর যৌথ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে কাল শুক্রবার। তিন দিন ব্যাপী এ প্রদর্শনীর নাম-‘কন্যা আর আমরা’। ২৪ জনের প্রত্যেকের তিনটি করে ছবি থাকবে প্রদর্শনীতে। এক একটি ছবির মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। সেলিনা মুন্না এ প্রদর্শনীতে অংশ নিতেই অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে দেশে এসেছেন। আর এই শিল্পীরাই কলকাতার একই ধরনের আরেকটি দল মিলে আগামী আট মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কলকাতায় আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করবেন।

বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে এই প্রদর্শনী নিয়েই কথা হলো শাকিলা চয়নের সঙ্গে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আরেক শিল্পী উম্মে হাবিবা সুমী। জানালেন, এই ২৪ শিল্পীরা হলেন চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। এঁদের মধ্যে কেউ হয়তো ১৯৯৫ সালে মাস্টার্স করেছেন আবার কেউ সদ্য পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছেন। এই গ্রুপের এক সদস্য ৩৫ বছর পর আবার আঁকাআঁকির জগতে ফিরে এসেছেন। সকালে মেসেঞ্জার গ্রুপে গুডমর্নিং দিয়ে শুরু হয় শিল্পীদের কাজকর্ম। কেউ নতুন কিছু আঁকলে তা নিয়ে গ্রুপেই চলে আলোচনা, পরামর্শ। দিন শেষ হয় গুডনাইট জানিয়ে। আর বিভিন্ন প্রদর্শনী বা অনুষ্ঠানে একত্র হন শিল্পীরা।

শাকিলা চয়ন ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। দুই সন্তানের জননী শাকিলা পারিবারিক কারণে নিজে ছবি আঁকতে না পারলেও কোথায়, কখন কোন প্রদর্শনী হচ্ছে তা অন্যদের জানাতেন। তারপর ১৮ বছর পর বিদ্রোহ করে আঁকার জগতে ফিরে এসেই গত চার বছরে ৫০০ ছবি এঁকে ফেলেছেন। কিছু ছবি বিক্রি হয়েছে।

শিল্পী শাকিলা চয়ন ও উম্মে হাবিবা: ছবি: আবদুস সালাম
শিল্পী শাকিলা চয়ন ও উম্মে হাবিবা: ছবি: আবদুস সালাম

উম্মে হাবিবাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে ২০০৩ সালে মাস্টার্স করে বের হন। তিনি এবং তাঁর স্বামী দুজনই শিল্পী। স্বামী আঁকাআঁকির পথে না গিয়ে ব্যবসা করছেন। উম্মে হাবিবা ছবি আঁকা বাদ দেননি তবে সংসার সামলে ছবি আঁকতে বসলেই ঘুম পেত। ছোট ক্যানভাসকে কোলে রেখেই ছবি আঁকতেন। অথচ সব সময়ই বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে ভালো লাগে।

মেসেঞ্জার গ্রুপ এবং প্রদর্শনী নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হাবিবা বলেন, ‘ছবির জগতে ফিরে তিনি অন্যদের বলতে লাগলেন তোমরা ছবি কম আঁকো কেন? একজন ১৮ বছর পরও সাবলীল ভাবে ছবি আঁকছেন। আমরা সাহস পেলাম। এখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের জবাবদিহি তৈরি হয়েছে। নিজেদের তাগিদেই ছবি আঁকি।’

সাবলীল ভঙ্গিতে ছবি আঁকা প্রসঙ্গে শাকিলা বলেন,‘শিল্পীরা সংসার জীবনের মারপ্যাঁচে ছবি আঁকা থেকে দূরে থাকে। কিন্তু ছবি আঁকা ভোলা যায় না। শাকিলা এক্রেলিক, তেলরঙ, জলরঙসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করেই ছবি আঁকেন। অনেকের পোর্ট্রেট এঁকেছেন।

নারী শিল্পীদের ছবি এমন হবে বলে একটি ছকে ফেলে দেওয়া হয় যা শাকিলা পছন্দ করেন না। শাকিলার আঁকার বিষয়বস্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারী। আর ছবির মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কারের জন্য নারী ফিগারের মুখ টিতে নিজের মুখের আদল দেন। এক বছর সময় নিয়ে জেন্টেঙ্গেল প্যাটার্নে জেল পেন ও মার্কার দিয়ে এঁকেছেন ‘দি আর্থ’ শিরোনামের ছবি। আদম-হাওয়ার মাধ্যমে পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমানের হিংসা, রেষারেষি এবং সব শেষে ভালোবাসাসহ সব স্থান পেয়েছে সাড়ে ২৬ ফুটের এ ছবিতে। স্পেনের এই প্যাটার্নে মানসিক প্রশান্তির জন্য সাধারণত হাসপাতালের রোগীদের ছবি আঁকতে দেওয়া হয়। শাকিলা নিজের মানসিক প্রশান্তির জন্যই এ ছবি আঁকা শুরু করেন এবং বর্তমানে এ প্যাটার্নে দেশে বিদেশে এটিই সবচেয়ে বড় ছবি বলেও দাবি করলেন এ শিল্পী।

শিল্পী শাকিলার আকাঁ ছবি
শিল্পী শাকিলার আকাঁ ছবি

ছেলে শিল্পীদের আঁকাআঁকির জগতে জটিলতা কম। কেউ বাধ্য হননি আঁকা আঁকি বাদ দিতে। নিজের ইচ্ছেতেই অনেকে ছেড়ে দেন। আর অফিস থেকে ফিরে চা খেয়েই ছবি আঁকতে বসে যেতে পারেন যা একজন নারী শিল্পীর পক্ষে সম্ভব হয় না। নারী শিল্পীদের আঁকার পর বাসার কোন জায়গায় ছবি রাখবেন তা নিয়ে চিন্তা করেই অস্থির থাকতে হয়। কেননা, পারিবারিক সহায়তা পাওয়া যায় খুব কম ক্ষেত্রে। আঁকা ছবিকে পরিবারের সদস্যরা আবর্জনা হিসেবেই দেখেন।

শাকিলা বললেন, ‘আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে আসার পর এখন অনেকেই নিজের ছবি আঁকার জন্য আলাদা সময় বের করে নিচ্ছেন। আর এই শিল্পীরা দুঃখ, হতাশা, না পাওয়া বা বলতে না পারা গল্পগুলোই ছবিতে ফুটিয়ে তোলেন। আমি নিজেও আমার ভেতরের কষ্ট ফুটিয়ে তুলতে যে ছবিগুলো আঁকি তা আঁকার পর অসুস্থ হয়ে যাই। এখন নারীর হাসিমুখ আঁকি। এটা বাস্তব না, তবে আমি হাসিমুখে থাকতে চাই।’

উম্মে হাবিবা জানালেন, তিনি ছবি আঁকার পাশাপাশি গান গাইতে ভালোবাসেন। তবে গান শিখতে গেলেই সামনে চলে আসে নানান সমস্যা। আর তাই তাঁর বিমূর্ত ছবির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে ‘হার সং’ নামের একটি চিত্রশিল্প।

‘কন্যা আর আমরা’ প্রদর্শনীটি শুক্রবার বিকেল চারটায় উদ্বোধন হবে। এরপর তা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত হবে। শনিবার বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এবং রোববার সকাল ১১টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এটি দর্শকদের জন্য খোলা থাকবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ২ নম্বর গ্যালারিতে এ প্রদর্শনী চলবে। শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় গ্যালারিতে বিনা মূল্যে প্রদর্শনটি আয়োজন করতে পারছেন শিল্পীরা।

শিল্পী সেলিনা মু্ন্নার আঁকা ছবি
শিল্পী সেলিনা মু্ন্নার আঁকা ছবি

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া অন্য শিল্পীরা হলেন-আফরোজা খন্দকার, আঁখিনূর রহমান ঝর্ণা ,মোরসালীন আহসান লাভলী,সেলিনা মুন্না,শামীমা আক্তার, আতিকুন নাহার জ্যোতি,সাহেদা কুলসুম,জাকিয়া ফেরদৌস,মাহফুজা বিউটি,শাহনাজ শাহিন,ফাতেমা বেগম রিনা,খুরশিদা আক্তার, আমিনা আক্তার, ফারহানা ইয়াসমিন,

মাহিন মাহনুমা,নাজমা মুক্তা,রহমান সুখী, শর্মিলা সোমা,সুলতানা পুতুল,সুরভি সোবহানা,তানিয়া বারী কান্তা এবং এস বি নুসরাত জাহান।