'পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি'

>আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের এই দিনে তিনি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।

‘ফার্স্ট ক্লাস এমএ হলেই যে সে সেকেন্ড ক্লাসের চেয়ে বেশি বিদ্বান বা কুশলী শিক্ষক হতে পারে, তা আমি মনে করি না।’ ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে জীবনানন্দের এই পর্যবেক্ষণ বা খোদেক্তির মূল কারণ তিনি নিজেও ছিলেন সেকেন্ড ক্লাস এমএ। আর এই সেকেন্ড ক্লাসের যন্ত্রণা তাঁকে সারা জীবন বইতে হয়েছে।

৫৫ বছরের জীবনে জীবনানন্দ দাশ একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের মধ্যে। সচ্ছলতা কোনোদিনই ধরা দেয়নি। প্রখ্যাত ফরাসি ভাস্কর্যশিল্পী রদ্যাঁর সঙ্গে অনেকটা মিল আছে জীবনানন্দের। র‌দ্যাঁকে জীবনের ৫০ বছর কাটাতে হয়েছে দারিদ্র্য, কষ্ট ও দুশ্চিন্তার ভেতরে (রদ্যাঁ, কবীর চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৭১)।

বিশের দশকে ইংরেজিতে এমএ পাস একজন মেধাবী তরুণকে একটা মনের মতো চাকরির জন্য ঘুরতে হয়েছে দিনের পর দিন। আজ কলকাতা, কাল বাগেরহাট, পরশু দিল্লি তো পরেই বরিশাল, ফের কলকাতা; এভাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ঘুরেছেন। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থে ‘সৃষ্টির তীরে’ কবিতায় সেই খেদোক্তি—‘মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল; পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।’

জীবনানন্দ দাশ চাকরি করেছেন ২০ বছরের কিছু বেশি সময়। এর মধ্যে প্রায় ছয় বছর (১৯২২-১৯২৮) কলকাতা সিটি কলেজ, তিন মাস (১৯২৯) বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজ, একই বছর দিল্লি রামযশ কলেজে চার মাস। এরপর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় একটানা প্রায় ১১ বছর (১৯৩৫-১৯৪৬) জন্মস্থান বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, ১৯৪৭ সালে কলকাতা শহরে ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় সাত মাস, কলকাতা থেকে বেশ দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর কলেজে পাঁচ মাস (সেপ্টেম্বর ১৯৫০—ফেব্রুয়ারি ১৯৫১), কলকাতার বেহালা এলাকায় বড়িষা কলেজে (বর্তমান নাম বিবেকানন্দ মহিলা কলেজ) চার মাস (নভেম্বর ১৯৫২—ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩) এবং সবশেষ হাওড়া গার্লস কলেজে (বর্তমান নাম বিজয়কৃষ্ণ মহিলা কলেজ) এক বছর তিন মাস (জুলাই ১৯৫৩ থেকে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪)। অর্থাৎ মৃত্যু-অবধি এই কলেজে ছিলেন।

১৯৪৮ সালের জুন-জুলাই মাসে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার চাকরি চলে যাওয়ার বছর দুয়েক পর সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্রর মুখপত্র ‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হিসেবেও জীবনানন্দ কিছুদিন কাজ করেন। প্রভাতকুমার দাস (পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ: পৃষ্ঠা ৪৩) লিখছেন, ‘সাহিত্যের একপ্রান্তে প্রতিক্রিয়াশীল এবং অন্যপ্রান্তে অতি প্রগতিবাদের মধ্যবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদের সাহিত্যচেতনার প্রতিষ্ঠা অর্জন করার জন্যই এই কেন্দ্রের সূত্রপাত।’

কলকাতা সিটি কলেজে ১৯২২ সালে প্রথম চাকরির শুরুটা ভালো হলেও ছয় বছরের মাথায় ১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাসে কলেজের রামমোহন রায় হোস্টেলে সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অপ্রীতিকর ঘটনার পরে কলেজে ছাত্রসংখ্যা কমে যায় এবং কলেজটি আর্থিক সংকটে পড়ে। তখন লোকবল কমানোর প্রক্রিয়ায় সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে জীবনানন্দের চাকরিটা চলে যায় (সিটি কলেজ স্মরণিকা, ২০০৭)।

এরপর বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগ দিলেও কাজটি ভালো না লাগায় এবং কলেজের পরিবেশ ও সহকর্মীদের আচরণ—সবকিছু মিলিয়ে মাস তিনেক পরে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে প্রথমে বরিশাল পরে আবার কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে থাকতেন ৬৬ হ্যারিসন রোডে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে। তখন মূলত গৃহশিক্ষকতা করতেন। এরপর দিল্লির রামযশ কলেজে যোগ দিলেও সেখানেও পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা মেনে না নিতে পেরে দেশে ফিরে আসেন।

অধ্যাপনা নিয়ে জীবনানন্দের ভেতরে বরাবরই একধরনের হতাশা বা অভিমান ছিল। বরিশাল থেকে ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই প্রভাকর সেনকে লেখা চিঠিতে সেই খেদ বা অভিমান: ‘এখনও অধ্যাপনাই করতে হচ্ছে। কিন্তু মনে হয় এ পথে আর বেশিদিন থাকা ভালো না। যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি? এইবার নতুন পটভূমি নেমে আসুক।’ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও তাঁর অসন্তুষ্টির সীমা ছিল না।

৫৫ বছরের জীবনে জীবনানন্দ বেকার থেকেছেন প্রায় আট বছর। কর্মজীবনের শুরু ১৯২২ সালে, অর্থাৎ ২৩ বছর বয়সে। সে হিসাবে ৩২ বছরের কর্মজীবনে বেকার থেকেছেন প্রায় ২৪ ভাগ সময়। এর মধ্যে ১৯২৮ সালে সিটি কলেজের চাকরি চলে যাওয়ার পর ১৯২৯ সালে বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগদানের মধ্যবর্তী সময়ে কিছুদিন বেকার ছিলেন। এরপর দিল্লির রামযশ কলেজের চাকরিচ্যুতির পরে ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ একটানা পাঁচ বছর বেকার। ১৯৪৮ সালে ‘স্বরাজ’ এবং পরে ‘দ্বন্দ্ব’ ছেড়ে দিলে ১৯৫১-১৯৫২ সালে প্রায় তিন বছর এবং মৃত্যুর আগের বছর ১৯৫৩ সালেও মাস চারেক বেকার ছিলেন।

প্রশ্ন হলো জন্মস্থান বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরিটা বেশ সম্মানজনক এবং ক্ষুদ্রার্থে ‘বিশুদ্ধ’ হওয়ার পরও কেন তিনি এটি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন। কেন শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় গিয়ে ফের সংবাদপত্রে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন। কেন সব ধরনের কাজ থেকে অবসর নিয়ে কেবলই লেখালেখিতে মগ্ন হতে চাইলেন। আলোচনা হতে পারে, যখন চাকরির জন্য এখানে-ওখানে ধরনা দিচ্ছেন, এ-ওর কাছে চিঠি লিখছেন, ইংরেজির শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ইনস্যুরেন্সের দালালির মতো আপাত সম্মানজনক নয়, এমন কাজেও রুটিরুজির নিশ্চয়তা খুঁজছিলেন।

আরেকটি প্রশ্ন, ‘বিশুদ্ধ চাকরি’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? চাকরি বলতে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় শিক্ষকতাই করেছেন। সেখানে তিনি কতটুকু সুখী ছিলেন বা শিক্ষক জীবনানন্দের স্বরূপ কেমন ছিল, সেটিও আমাদের জানা প্রয়োজন।

সর্বশেষ কর্মস্থল হাওড়া গার্লস কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বকুল মজুমদার (মহাপ্রয়াণে কবি জীবনানন্দ দাশ, গার্লস কলেজ পত্রিকা: পৃষ্ঠা ২৬) লিখছেন: ‘ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রয়োজনের বেশি একটি কথাও তিনি কোনোদিন বলেননি। ক্লাসে পড়া বোঝাবার সময় কোনো ছাত্রী মনে হয় এতটুকুও অন্যমনস্ক হত না; জানি না এটা তার ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শের গুণ নাকি তাকে শ্রদ্ধা করার জন্য। তিরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা—এমনকি উপদেশের নীরস নীতিকথাও তার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন পায়নি।’

আরেক ছাত্রী প্রীতি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়: ‘অবাক হয়ে গেলাম তার পড়ানোর পদ্ধতিতে, প্রতিটি কথাকে তিনি বিভিন্ন ইংরেজিতে সাত কি আটবার বলছেন আমাদের বোঝানোর জন্য। অপূর্ব তার পড়ানো, চেষ্টা করেও কেউ অন্যমনস্ক হয়ে যেতে পারবে না। তার আকর্ষণীয় বাকভঙ্গি সরিয়ে আনবে তাকে অন্যমনস্কতা হতে।’ (যদিও জীবনানন্দ শেষ দিকে নিজের বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। ধীরগতির ট্রামের নিচে পড়ে যাওয়া এই অন্যমনস্কতারই কারণ বলে মনে করা হয়।)

প্রীতি আরও লিখছেন: ‘ক্লাসে পড়াবার সময় তিনি হাতের একটি বিশেষ ভঙ্গি করতেন। সেই বিশিষ্ট ভঙ্গির মাঝে তার অন্তরের অপরিসীম শক্তি ফুটে উঠত। সেই বিশিষ্ট ভঙ্গিমা আমি আর কারুর দেখিনি। আর বিস্মিত হতাম তার বক্তৃতা দেবার ক্ষমতায়, তার সুগভীর স্বর যখন সমস্ত ক্লাসের মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে আবার তা প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অপূর্ব রহস্যময় আবহাওয়ার সৃষ্টি করতো।’

জীবনানন্দ তাঁর ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এ সমাজে টাকার গৌরবের কাছে অন্য কোনো কিছুর উজ্জ্বলতা দাঁড়াতে পারে না। প্রফেসর তার শূন্য পকেট নিয়ে কি জ্ঞানের প্রমাণ দিতে পারবেন? সে শূন্য কুম্ভের ঠনঠনানি দেশ শুনতে যাবে কেন? প্রফেসরের হাতে টাকা আসতে থাকলে তিনি কলেজ ছেড়ে দিয়ে চেম্বার অব কমার্সের চাঁই হয়ে দাঁড়াবেন। তখন তাঁর কথাবার্তার জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞানের মূল্য বেড়ে যাবে।’ অন্যত্র বলেন, ‘পৃথিবীর টাকাকড়ি কাড়াকাড়ির ব্যাপারে উত্তেজিত হওয়া যাদের স্বভাব তাদের পক্ষে আত্মদান করে শিক্ষকতা করা সম্ভব নয়।’

চাকরিবাকরি বিশেষ করে শিক্ষকতা নিয়েও তার যে অসন্তুষ্টি ছিল, সেটিও ফুটে ওঠে তাঁর কোনো কোনো চিঠিতে। বরিশাল থেকে ১৯৪২ সালের ৩১ অক্টোবর নলিনী চক্রবর্তীকে (ছোট ভাই অশোকানন্দের স্ত্রী) লেখা চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘অধ্যাপনা জিনিষটা কোনোদিনই আমার তেমন ভালো লাগেনি। যে সব জিনিষ যাদের কাছে যে রকমভাবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই। এই কাজে মন তেমন লাগে না, তবু সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরণার চেয়ে বেশী জাগে তা স্বীকার করি।’

চিঠিতে চাকরিহীন জীবনে পরিচিতজনদের কাছে বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরী, অনিল বিশ্বাস, হরপ্রসাদ মিত্র—প্রমুখের কাছে এ বিষয়ে বুদ্ধিপরামর্শ চেয়েছেন। ১৯৫১ সালের ২৩ নভেম্বর অনিল বিশ্বাসকে লেখেন, ‘আমি আজকাল বড্ড মুস্কিলের ভিতর আছি, কাজ খুঁজছি, কলকাতায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কিছু করতে পারেন? কালকের কাগজে দেখলাম Jangipur College এ (Murshidabad) একজন ইংরেজির লেকচারার চায়। আমার বর্ত্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে ও সব জায়গায় এ ধরনের কাজেও যেতে দ্বিধান করলে চলবে না।’ দেখা যাচ্ছে, ১৯৫১ সালে অর্থাৎ ৫২ বছর বয়সী একজন অধ্যাপক একটি অখ্যাত কলেজের লেকচারার পদে চাকরি পেতেও তিনি প্রস্তুত। এসব চিঠিতে তাঁর আর্থিক দীনতা খুব স্পষ্ট। নিজে একজন আদর্শবান শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও কেবল আর্থিক দীনতা ও অনিশ্চয়তার কারণে শেষতক শিক্ষকতা পেশাকে খুব একটা ইতিবাচক চোখে দেখেননি বলে মনে হয়। স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে তাঁর সাংসারিক জীবনের যেসব টানাপোড়েনের কথা শোনা যায় বা জানা যায়, সেখানেও এই আর্থিক অনটন একটা বড় কারণ নিঃসন্দেহে।

একাধিকবার কলেজ ও সংবাদপত্রের (স্বরাজ) চাকরি থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর দারিদ্র্য তাঁর পিছু ছাড়ছিল না। আবার শুধু পয়সা রোজগারের জন্য চাকরি করার বিষয়টিও তাঁকে পীড়িত করত। ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসের নায়ক সুতীর্থ বলছেন, ‘নিরেট পৃথিবীতে টাকা রোজগার করতে গিয়ে মূর্খ ও বেকুবদের সঙ্গে দিনরাত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মনের শান্তি সমতা বিনষ্ট হয়ে যায়।’

বেকারত্বের সময়কালে ১৯৩২ সালের একটি ঘটনা। যে বছর তাঁর বয়স ৩৩। কাকতালীয়ভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতাও (কেউ কথা রাখেনি) এই ৩৩ বছরকে কেন্দ্র করে। লিখেছিলেন, ‘তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি।’ জীবনানন্দও চাকরিহীনতার কালে দিগ্‌ভ্রান্ত। কী করবেন বা কী করতে পারবেন, সেসব ভেবে ভেবে উদ্‌ভ্রান্ত। সব কাজ তো আর ধাতে সইবে না। ইংরেজিতে মাস্টার্স, তার ওপর কবি। কবিরা এমনিতেই সংবেদনশীল। পেটের তাগিদে কাজ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ১৯৩২ সালে তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র রেল কোম্পানিতে গার্ডের চাকরির সন্ধান দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মন সায় দেয়নি জীবনানন্দের। এমনকি রাজমিস্ত্রির কাজ করবেন কি না, দিনলিপিতে তাও লিখেছেন। ‘না ওটা তাঁর ধাতে সইবে না। পেটে খিল মেরে রেখে ও রকম বাঁশের মাচায় চেপে সিমেন্ট জমানোর কাজ করতে অথবা ইটের পাঁজার মোট বইতে যে নার্ভ-এর জোরটা লাগে, তা তাঁর নেই।’

বিশের দশকে ইংরেজিতে মাস্টার্স এক পরিপূর্ণ যুবক, যাঁর ক্যারিয়ারটাও শুরু হয়েছিল শিক্ষকতার মতো একটি সম্মানজনক পেশার হাত ধরে, সেই মানুষটিকেই কি না রেলের গার্ড কিংবা রাজমিস্ত্রির কাজ করবেন কি না, তা নিয়েও ভাবতে হয়। আরও বছর তিনেক এভাবে টানাপোড়েনের ভেতরে, অস্থিরতা আর উদ্বেগের ভেতরে থেকে ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে ১৯৩৫ সালে। যোগ দেন জন্মশহর বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে, যেখান থেকে আইএ পাস করেছিলেন ১৯১৭ সালে।

বরিশাল বিএম কলেজের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে নানা রকম কাজ করে ১৯৫১ সালের বেকারত্বের কালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিতে একজন গবেষণা সহকারী পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেখে সেখানেও আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে ইন্টারভিউতেও ডাকা হয়নি। আরেকটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজের প্রফেসর পদের জন্য। জীবনানন্দ তখন ওই কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক নরেশ গুহ এবং বাংলার অধ্যাপক কবি শুদ্ধসত্ত্ব বসুর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

কলকাতার উত্তরে দমদম কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেখে জীবনানন্দ যোগাযোগ করেন তাঁর ব্রজমোহন কলেজের সহকর্মী এবং ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপ্যাল নরেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে; যিনি কয়েক মাস আগেও জীবনানন্দের ল্যান্সডাউন রোডের বাসায় এসেছিলেন। চাকরিটা পাওয়া কত জরুরি তা তিনি নরেন্দ গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেন এবং এই বলে তাঁকে কিছুটা লোভও দেখান যে তিনি (জীবনানন্দ) আত্মজীবনী লিখছেন, যেখানে নরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম থাকবে; নরেন অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু জীবনানন্দ এই চাকরিটাও পাননি।

চাকরিজীবনের শুরু থেকেই তিনি অস্থিরতায় ভুগেছেন। কোনোখানেই যেন ঠিক খাপ খাচ্ছিলেন না। এর মূল কারণ সম্ভবত গোটা জীবনে তিনি ‘বিশুদ্ধ চাকরি’র সন্ধান পাননি। আর এই চাকরি খোঁজাখুঁজির বিষয়ে তিনি নিজেও মানসিকভাবে খুব যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। একধরনের অপরাধবোধ কাজ করেছে মনের ভেতরে।
রূপসী বাংলার একটা কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি—
‘কড়ির পাহাড় খুঁজে ঘুরিতেছ, ঘুরিছ হাঁড়ের মরুভূমি।’
তার চাকরি অন্বেষণের একঘেয়েমির বহিঃপ্রকাশ ‘বলিল অশ্বত্থ সেই’ কবিতায়—
‘যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!’
তবে জীবনানন্দ দাশ যেই সময়ে জন্মেছিলেন এবং অধ্যাপনার মতো একটি পেশায় রুটিরুজির সন্ধান করেছিলেন, আজকের বাস্তবতা তার চেয়ে ঢের আলাদা। এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা যথেষ্ট সম্মানজনক এবং শিক্ষকেরা এখন ভালো মাইনে পান। জীবনানন্দ সারা জীবন যে ‘বিশুদ্ধ চাকরি’র পেছনে ছুটেছেন, আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করলে এবং কোনো কলেজে অধ্যাপনা করলে আর যা-ই হোক, মৃত্যু-অবধি তাঁকে আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে থাকতে হত না। অবশ্য এই টানাপোড়েনের মধ্যে না থাকলে তাঁর কলম থেকে কালজয়ী সব কবিতা ও উপন্যাস বেরোতো কি না, তাও সন্দেহ।
---------
তথ্যসূত্র:
১. উপন্যাস ‘জলপাইহাটি’: জীবনানন্দ রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড, ঐতিহ্য, ২০০৬
২. প্রবন্ধ ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’: জীবনানন্দ রচনাসমগ্র চতুর্থ খণ্ড, ঐতিহ্য, ২০০৬
৩. শিক্ষক জীবনানন্দ, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আত্মবিকাশ, মার্চ-মে ২০১৪
৪. জীবনানন্দ দাশ, শ্যামল দত্ত, কনিশ, খড়গপুর সিলভার জুবিলী হাইস্কুল, ২০১০
৫. খড়গপুরনিবাসী জীবনানন্দ গবেষক কামরুজ্জামানের সাক্ষাৎকার
৬. জীবনানন্দ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৯
৭. হাওড়া গার্লস কলেজ পত্রিকা, জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা, ১৯৫৫
৮. পত্রালাপ জীবনানন্দ, প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত
৯. সিটি কলেজ স্মরণিকা, ২০০৭
১০. অনন্য জীবনানন্দ, ক্লিন্টন বি সিলি, প্রথমা, ২০১১
১১. রদ্যাঁ, কবীর চৌধুরী, শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৯৪