শুধুই কি রং তামাশা আদিখ্যেতা?

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মেলার সঙ্গে রং তামাশার ব্যাপার আছে। তা সে যে মেলাই হোক। বারোয়ারি মেলা থেকে কৃষি মেলা, বাণিজ্য মেলা, শাড়ি মেলা, গাড়ি মেলা, এমনকি বউ মেলা—সব মেলাতেই নানা কিসিমের রংঢং থাকে। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষের সেখানে যেতে ভালো লাগে। শুনে আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক, বইমেলা এর বাইরের কিছু না। বহু লোক বইমেলায় বই কিনতে যায়। বই নিয়ে ভালোমন্দ দু–চার কথা বলতে কিংবা শুনতেও যায়। তবে ছুটির দিনে ঘরে আটকা থেকে মেলার মাঠে খেলাচ্ছলে বাতাসা খেতে খেতে খানিক তামাশা দেখে সময় পার করতে আসা লোকের সংখ্যাও নেহাত কম থাকে না। তবে আমরা যা-ই বলি না কেন, মেলার আয়োজকেরা ঠিকই বুঝতে পারেন, এই পাঠবিমুখ দর্শনার্থীরাই বইমেলাকে সরগরম করে রাখেন। তাঁদের কারণেই বইমেলা সত্যিকারের মেলা হয়ে ওঠে।
পাঠবিমুখ লোকের বইমেলার প্রতি এত আকর্ষণ কেন হবে? এই প্রশ্ন যাঁদের মনে ফুচকি মারে, তাঁরা জেনে রাখুন, বাঙালি চিরকালই উৎসববাজ। পার্বণ ছাড়া তার চলেই না। উপলক্ষ একটা ঠিক করতে পারলেই হলো। তারপর উৎসবে আর খামতি হয় না। উৎসবের সঙ্গে যোগ হয় হুজুগ। হুজুগটা লাগসই না হলে যুগোৎসব জমে না। আমাদের একুশের বইমেলা সেই হুজুগ থেকে রেহাই পেয়েছে—এমন কথা বলা যাচ্ছে না। এই বইমেলা গতকাল শেষ হলো সেই হুজুগের হাত ধরেই।
গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়াকে যে লোকটা নিতান্ত নিরর্থক, অনর্থক এবং অনর্থকরী বদঅভ্যাস বলে সারা বছর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকেন, বইমেলা এলে তাঁর বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী চত্বরে এক চক্কর মেরে দুটো সেলফি তুলে ফেসবুকে না দিলে মান থাকে না। মেলায় আসা সবচেয়ে আলোচিত বই কিনে তার কভার ফেসবুকে ছড়ানোর সাহিত্যচর্চায় তাঁকে এ সময় আগ্রহী হতে দেখা যায়। অনেকে আবার বই কেনার ঝামেলায় না গিয়ে শর্টকাটে মারেন। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে স্মার্ট ফোনে গোটা কয়েক বইয়ের ছবি তুলে ফেসবুকে ‘আজকের সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি নয়নাভিরাম স্ট্যাটাস ছুড়ে দেন।
সত্তরের দশকে মুক্তধারার কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা ছালা বিছিয়ে বইয়ের পসরা সাজিয়ে শুরুটা করেছিলেন। তখন বইমেলা একটি মোলায়েম এবং সীমিত পরিমাপের প্রচার অনুষঙ্গ ছিল। সেই ছালা বিছানো জায়গায় এখন কোটি কোটি টাকার বই কেনাবেচা হয়। এটি নির্মল আনন্দের বিষয় হতে পারত। কিন্তু যখন দেখা যায়, বইমেলার সঙ্গে বিদ্যাচর্চার বড় অসদ্ভাব, তখন কপালে চিন্তার রেখা দেখা যেতে বাধ্য।
প্রাথমিক স্তরে উৎসাহের প্রধান জোগানদার ছিলেন প্রকাশকেরা। মেলাটি এখন উদ্যোক্তাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক অনুভবে পরিণত হয়েছে। এখন মফস্বলে ও পাড়ায়–মহল্লায় একুশের বইমেলা করা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি জেলা শহরে এমনকি আধো-গ্রাম, আধো–শহর গোছের অঞ্চলেও বইমেলার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন মোটামুটি সবার মধ্যে এই ধারণা দাঁড়িয়ে গেছে: ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার ব্যবস্থা না করতে পারলে পাড়ার আর মান থাকে না।
বাংলা একাডেমির বইমেলা তো বটেই, মফস্বলের বইমেলাও শুধু বই কেনাবেচার মধ্যে আটকে নেই। এর সঙ্গে পার্বণের ছোঁয়া লেগে গেছে। বইমেলার অঙ্গ হিসেবে এবারও এখানে নানা ধরনের সাহিত্য সভাটভা হয়েছে। বই নিয়ে লেখক চত্বরে টেলিভিশনের সামনে খুব দামি দামি কথা হয়েছে। মেলা উপলক্ষ করে নারী-পুরুষ সবাই বেশ সেজেগুজে হাওয়াই মিঠাই চাটতে চাটতে এসেছেন। মেলায় চলমান জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনতে তাঁরা পেছনের চেয়ারে বসে দু–তিনবার আলোচকের বক্তব্যে সমর্থনসূচক ঘাড় নেড়েছেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখান থেকে সরে গেছেন। এক কোনায় সদ্য প্রকাশিত নিজের চটি সাইজের কবিতার বইটি হাতে নিয়ে দু–চারজন সাগরেদবেষ্টিত হয়ে কোনো এক তরুণ কবি প্রতিষ্ঠানবিরোধী ঝাঁজালো বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর পাশে হয়তো বিদগ্ধ ব্যক্তিদের কোনো পার্থিব-অপার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে কোনো ঘুপচিতে কেউ জাদু খেলা দেখিয়েছেন। উঠতি দু–একজন চিত্রশিল্পী রং তুলি দিয়ে দর্শনার্থীদের হাত কিংবা গালে ফুল–পাখি এঁকে দিয়ে টু পাইস কামিয়ে নিয়েছেন। খাদ্যরসিকদের জন্য মেলার ভেতরেই ছিল নানা পদের খাবারদাবার।
এককথায় বইমেলা আর বইয়ে আটকে থাকেনি। সব ছাপিয়ে এটি নিজেদের দেখবার এবং দেখাবার একটা জম্পেশ উৎসব হয়ে উঠেছিল। মেলার বাইরে ছোট পরিসরে হলেও ঝলমলে শাড়ি-গয়না-সালোয়ার পাওয়া গেছে। লাউডস্পিকারে উচ্চ নিনাদে সদ্য আগত বইয়ের নাম ও লেখকের নাম ভেসে এসেছে খানিক পরপর। সন্ধ্যায় আলো-অন্ধকারে কোনো কিশোরী কারও পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কারের মুগ্ধতায় হতবাক হয়েছে।
বইমেলা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসবের মতো একটি উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ মেলা নিয়ে আমাদের আকুলিবিকুলি আছে। আদিখ্যেতাও আছে।
আগে খুব সাদামাটা মেলা হতো বলে পুঁজিপতিরা এদিকটা তেমন আসতেন না। কিন্তু গন্ধ শুঁকে বৃহৎ পুঁজির মালিকেরাও এখন বইমেলার দরজায় উপস্থিত। ফলে মেলা এখন ধীরে ধীরে করপোরেট চেহারা পাচ্ছে। এটি বিনোদন শিল্পে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে যা দাঁড়াচ্ছে, তা হলো বইমেলায় প্রচুর লোক আসছে। লোক দেখানো বই কেনাও হচ্ছে। কিন্তু বই পড়ার রুচি তৈরি হচ্ছে না। ক্রেতা কেন পাঠমনস্ক পাঠক হচ্ছে না, তা যদি ভাবা যায় এবং ভাবনার পর কারণটি বের করে যদি লাগসই ওষুধটি দেওয়া যায়— তাহলে হয়তো সিরিয়াস পাঠকের সংখ্যা বাড়বে। সরকার কিংবা প্রকাশকেরা সিরিয়াস পাঠক বাড়ানোর প্রকল্প নিতে পারে। পাঠক বাড়লে সারা বছর বইয়ের চাহিদা থাকবে। বইমেলাকে আর হুজুগের বিনোদন মেলা মনে হবে না। এতে প্রকাশকদেরও লাভ বই ক্ষতি হবে না।