আশা-জাগানিয়া বইমেলা

বইমেলার টানে ছুটে এসেছিলেন বিদেশিরাও। ছবি: অন্য আলো
বইমেলার টানে ছুটে এসেছিলেন বিদেশিরাও। ছবি: অন্য আলো

ফ্রেব্রুয়ারি এলেই কী এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে চলে বইমেলা চত্বরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড় থেকে হেঁটে যখন মেলায় পৌঁছাই, মনটা ভরে যায়। বইপ্রেমী এত মানুষ! এত তরুণ! ফের আশাবাদী হই। এদের কেউ বইয়ের খোঁজ নিতে এসেছে, কেউ এসেছে বই কিনতে। কেউবা নিতান্তই আড্ডা দিতে—বইয়ের আড্ডা, সাহিত্যের আড্ডা।
এবারের বইমেলায় সব মিলিয়ে দিন পনেরো যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাতে যে অভিজ্ঞতা হলো, এককথায় সেটি খুবই আশা জাগানিয়া।
আগের চেয়ে এবারের বইমেলা ছিল আরও গোছানো ও পরিকল্পিত। স্টলবিন্যাস ছড়ানো ছিল বিস্তৃত পরিসরে। ফলে গা ঘেঁষাঘেঁষি ভিড় ছিল না। পাঠক ও দর্শনার্থীরা স্বস্তি নিয়ে হাঁটতে পেরেছে। এ বছর মেলার সময় রাত ৯টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছিল, যা খুবই ইতিবাচক একটি দিক। (যদিও প্রবেশের সময় ছিল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত)। স্টলের পাশাপাশি বড় জায়গাজুড়ে প্যাভিলিয়নের পরিকল্পনাও খুব সুন্দর। চারপাশ থেকেই পাঠকেরা বই দেখা ও কেনার সুযোগ পেয়েছেন।
মেলার স্টলগুলো ঘুরে দেখা গেল, প্রতিবারের মতো এবারও উপন্যাস ও বড় গল্পের বই-ই বেশি চলেছে। সৃজনশীল বইয়ের পাশাপাশি এবার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মননশীল বই এনেছেন প্রকাশকেরা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের প্রাচুর্য ছিল নিঃসন্দেহে মন ভালো করার মতো ঘটনা। এসব বই বিক্রিও হয়েছে দেদার। এর মধ্যে তরুণ পাঠকদের সবচেয়ে বেশি টেনেছে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের বই। এ ছাড়া দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই ছিল চোখে পড়ার মতো। সৃজনশীল বইয়ের মধ্যে অন্যবারের চেয়ে এবার মানসম্মত কবিতার বই এসেছে বেশিসংখ্যক তরুণ পাঠকদের মধ্যে কবিতার বই নিয়ে আগ্রহও ছিল বেশ।

বিচিত্র ধরনের বইয়ের প্রতি এবার তৃষ্ণা ছিল পাঠকদের। ছবি: অন্য আলো
বিচিত্র ধরনের বইয়ের প্রতি এবার তৃষ্ণা ছিল পাঠকদের। ছবি: অন্য আলো

বইমেলায় মানুষের ঢল দেখে ফি বছর নিন্দুকেরা বলে থাকে, ‘মানুষ বই কেনে না, শুধু ঘুরতে আসে আর চটপটি-ফুচকা খেয়ে সেলফি তুলে বাসায় ফিরে যায়।’ কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ উল্টো। প্রচুর মানুষকে দেখা গেল দুহাত ভর্তি করে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে মেলা থেকে ফিরে যাচ্ছেন। বিশেষত তরুণেরা বই কেনায় ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। ‘কী বই কিনলেন’ কৌতূহলবশত বেশ কজন তরুণ-তরুণীকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া গেল, ‘অনুপ্রেরণাদায়ী বই, ক্যারিয়ারসংক্রান্ত বই, মুক্তিযুদ্ধের বই, প্রযুক্তি শেখার বই ইত্যাদি।’
পুরোনো জনপ্রিয় ও ভালো লেখকদের বই চলেছে যথারীতি। এর বাইরে এবারের বইমেলার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, অনেক নতুন লেখকের বই ‘বেস্ট-সেলার’ তকমা পেয়েছে। তবে তরুণ ক্রেতাদের অভিযোগ, বইয়ের দাম নিয়ে। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। একজন গুণী তরুণ গল্পকারের ৯৬ পৃষ্ঠার একটি গল্পগ্রন্থের দাম লক্ষ করলাম ৪০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠার) দাম পড়ছে ৬০ টাকা! এটা কি যথেষ্ট বেশি নয়?
মাসব্যাপী শিক্ষার্থী ও তরুণ পাঠকদের মুখে একটা অভিযোগ এসেছে ঘুরে-ফিরে, মেলায় কোনো চায়ের স্টল নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা চত্বরে মাত্র তিনটি খাবারের কর্নার ছিল। তা-ও খাবারের দাম ছিল খানিকটা চড়া। উচ্চমূল্যের খাবার ও কফিশপ থাক, ক্ষতি নেই। তা বলে চায়ের আড্ডা ছাড়া বইমেলা! কেমন যেন লাগে। ফলে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পথিকদের জন্য ভবিষ্যতে কি ‘আড্ডা কর্নার’ নামে কিছু রাখা যায় না? আর ২১ ফেব্রুয়ারির মতো পয়লা ফাল্গুন (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই কি বইমেলা খোলা রাখা যায়? কেননা মেলায় যত বেশি সময় দর্শনার্থী থাকবে, তাতে লেখক ও প্রকাশক দুপক্ষরেই তত লাভ।
এ বছর, বইমেলা শুরু হয়েছিল পয়লা ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। শুক্রবার দিয়ে শুরু হয়েছিল বলে প্রথম দিন থেকেই মেলাতে দর্শক উপস্থিতি ছিল বেশিমাত্রায়। দ্বিতীয় শুক্রবার থেকে বই-কেনা বাড়তে থাকে, মেলা হয়ে ওঠে জমজমাট। আর ১৩ ফেব্রুয়ারি বা পয়লা ফাল্গুন থেকে দৃশ্যত মানুষের ঢল নামে বইমেলায়। শেষ দিন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। এদিকে শাহবাগ, ওদিকে নীলক্ষেত মোড় এবং অন্যদিকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ছিল লোকে লোকারণ্য। যখন বলা হচ্ছে প্রযুক্তি মানুষকে বইবিমুখ করছে, পুঁজিবাদ মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে সময়, তখন বইমেলায় এই জনসমুদ্রের দেখা পাওয়া নিঃসন্দেহে এক মধুর অভিজ্ঞতা।
সবশেষে ভিন্ন প্রসঙ্গের ছোট্ট একটা কথা বলি। এবার তিন দিনের জন্য কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলাম। তুলনা অবান্তর, তা-ও বলতে ইচ্ছা করছে, কলকাতার চেয়ে আমাদের ঢাকার বইমেলায় পাঠকের উপস্থিতি বহুগুণ, বিক্রিও বেশি। ঢাকা যে এখন বাংলা সাহিত্যের রাজনীতি হয়ে উঠেছে, আমাদের অমর একুশে বইমেলা সে কথাই পুনর্বার জানান দেয়।