আইসক্রিম সোশ্যালে ভ্যালোরির দীর্ঘশ্বাস

নর্থ ভিলেজের আইসক্রিম সোশ্যালে বাচ্চাদের ক্লাউন সেজে আনন্দ দিচ্ছিল আজারবাইজানের নাজিম হাসানোভার।  ছবি: লেখক
নর্থ ভিলেজের আইসক্রিম সোশ্যালে বাচ্চাদের ক্লাউন সেজে আনন্দ দিচ্ছিল আজারবাইজানের নাজিম হাসানোভার। ছবি: লেখক

আইসক্রিম সোশ্যালে এসে খানিক আড্ডার প্রয়োজনে পার্টিতে চেনাজানা কেউ আছে কি না, তার তালাশে হলরুমের এদিক–ওদিকে তাকাই। ডাইনিং রুমে আজারবাইজানের ডক্টরেল স্টুডেন্ট নাজিম হাসানোভার সঙ্গে দেখা হয়। সে পার্টিতে মা-বাবার হাত ধরে আসা বাচ্চাদের ক্লাউন সেজে আনন্দ দিচ্ছে। তার মাথায় রংধনু রঙের পরচুলা, গলায় বেঢপ সাইজের টকটকে লাল একটি বো-টাই। বুঝতে পারি, নাজিমের সঙ্গে আজ আড্ডার সম্ভাবনা জিরো। আমার পরিচিত অন্য এক রিচার্স স্কলার ইন্দোনেশিয়ার ইউরিপ যে রকম মনোযোগ দিয়ে বাটিতে ভ্যানিলা আইসক্রিম ওঠাচ্ছে, তাতে আমার সঙ্গে কথা বলার কোনো আগ্রহ তার আছে বলেও মনে হয় না। পেস্তাবাদামের চূর্ণ মেশানো এক বাটি আইসক্রিম এবং সফট ড্রিংকসের ক্যানটি হাতে আমি বেরিয়ে আসি বারান্দায় কাঠের ডেকটিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের আমহার্স্ট শহরে নর্থ ভিলেজের বাসিন্দাদের এক বড় অংশ তাবৎ দুনিয়ার নানা দেশ থেকে আগত ডক্টরেল স্টুডেন্টস, ভিজিটিং স্কলারস ও পোস্ট ডক্টরেল রিসার্চাররা। এরা ছায়াতরু ও ঝোপঝাড়ে শ্যামল এবং দামে সস্তা হাউজিং কমপ্লেক্সটিকে ভালোবাসে। মূলত দূর দেশ থেকে আগত মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে যাতে পরিচিত হয়ে গড়ে তুলতে পারে একটি কমিউনিটি,Ñসে জন্য নর্থ ভিলেজের হাউজিং ম্যানেজমেন্ট প্রতি মাসে ‘আইসক্রিম সোশ্যাল’ বলে একটি পার্টির আয়োজন করে থাকে। এসব পার্টিতে আন্তর্জাতিক স্কলাররা ছাড়া দু–চারজন আমেরিকান একাডেমিকসও যোগ দিয়ে থাকেন। এঁদের অনেকেই দীর্ঘদিন হয় যুক্ত আছেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের সঙ্গে। কেউ কেউ পড়াশোনা এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম চাকরি–বাকরিও করে থাকেন। এঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ভ্যালোরি ডনাবান, জাতীয়তায় ইনি আমেরিকান। ভ্যালোরি কাঠের ডেকে জড়ো হওয়া মানুষজনদের গুচ্ছ থেকে আলাদা হয়ে বেশ খানিকটা দূরের একটি পিকনিক টেবিলে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে একা বসে আছেন। মাঝবয়সী এ নারী অনেক দিন হয় ডক্টরেল স্টুডেন্ট হিসেবে ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। অত্যন্ত সদালাপি এ নারী আইসক্রিম সোশ্যাল ইত্যাদিতে উদ্যোগ নিয়ে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে হাসি–ঠাট্টায় হামেশা পার্টি সরগরম করে রাখেন। আজ ভ্যালোরি বিচ্ছিন্নভাবে একা বসে আছেন দেখে অবাক লাগে।

পিকনিক টেবিলের লাগোয়া বেঞ্চে বসে আমি জানতে চাই, ‘হোয়াটস আপ ভ্যালোরি, হোয়াট ইজ গোয়িং অন?’ ভ্যালোরি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আই অ্যাম নট সিওর আই ওয়ান্ট টু টক অ্যাবাউট দিস রাইট নাউ। ও লর্ড! অ্যাম সো স্কেয়ার্ড।’ ভ্যালোরি কোনো কারণে আতঙ্কে আছেন এবং তা নিয়ে কথা বলতে চান না, আমি তা বুঝতে পেরে নীরব হয়ে বসে থাকি। পরোপকার করার একটা বাতিক আছে ভ্যালোরির। বছর দুয়েক আগে স্প্রিংফিল্ড শহরের স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস নামে একটি ইউনিভার্সিটিতে আমি খণ্ডকালীন অধ্যাপনার কাজ পাই। আমার তখন গাড়ি ছিল না। ভ্যালোরি এ কলেজের কাছাকাছি কোথায় যেন কাজ করতেন। আমাকে তিনি তাঁর গাড়িতে লিফট দিয়ে কাজে নিয়ে যেতেন এবং ফিরিয়ে আনতেন। শুধু তা–ই নয়, গুয়াতেমালার এক অবিবাহিত নারী অপ্রত্যাশিতভাবে নির্দিষ্ট মেয়াদের ছয় সপ্তাহ আগে যখন প্রিম্যাচিওর শিশুসন্তানের জন্ম দিয়ে স্বাস্থ্য–সংক্রান্ত দুর্গতির মধ্যে পড়েন, তখন ভ্যালোরি তাঁকে বারবার হাসপাতালে নিয়ে যান। শিশু জন্মের পর প্রয়োজনে বেবি সিটিং করে এবং কখনো–সখনো অবিবাহিত নিঃসঙ্গ মাকে রান্না করা খাবার তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিয়েও সাহায্য করেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ভ্যালোরি গলে যাওয়া আইসক্রিমের বাটিতে চামচ নাড়াচাড়া করতে করতে বলেন, ‘বনডেজ ইজ গিভিং মি হার্ড টাইম। আমার কাছে টাকাপয়সা নেই, কিন্তু সে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে আমাকে লইয়ারের সাহায্য নিতেই হবে। তোমার জানাশোনা কোনো ক্রিমিনাল আইনজীবী আছে কি, যার কাছে আমি কম পয়সায় সাহায্য পেতে পারি?’ বনডেজের সঙ্গে তাঁর কনফ্লিক্ট হচ্ছে শুনে আমি ব্যথিত হই বটে, কিন্তু খুব একটা আশ্চর্য হই না। কারণ দিন কয়েক আগে হাউজিং কমপ্লেক্সের যৌথ পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে আমি ভ্যালোরিকে বনডেজের সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা–কাটাকাটি করতে দেখেছি। ভ্যালোরিকে আমি অনেক দিন ধরে জানি, উনি ঝগড়াঝাঁটি করার মানুষ নন। বিষয়টি তাঁর ওপর চাপানো না হলে তিনি কোনো দ্বন্দ্বে অবশ্যই জড়াতেন না।

আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের কৃষ্ণাঙ্গ নারী বনডেজ নর্থ ভিলেজের একটি অ্যাপার্টমেন্টে বাস করার জন্য আলাবামা থেকে মাস আষ্টেক আগে এখানে আসে। তরুণী বনডেজ যখন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে তার শিক্ষাজীবন শুরু করে, তখন সে শুধু আর্থিকভাবেই বিপর্যস্ত নয়, মানসিকভাবেও ছিল দারুণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। স্বামীর সঙ্গে কেবল ডিভোর্স হয়েছে। তারা কোর্ট-কাচারি করছে একটি সন্তানের কাস্টডি বা লালন–পালনের অধিকার নিয়ে। প্রথম দিকে বনডেজের অ্যাপার্টমেন্টে কোনো ফার্নিচার ছিল না। ভ্যালোরি সারভাইবাল সেন্টার নামে এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার জন্য চেয়ার–টেবিল ও বিছানাপত্রের ব্যবস্থা করে দেন। বনডেজের গাড়ি ছিল না, তাই সপ্তাহে দুদিন তিনি তাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যেতেন গ্রোসারি স্টোরসে। এমনকি তাকে নিজের পুরোনো কম্পিউটার ও প্রিন্টার ইউজ করার জন্য দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে বনডেজ ইউনিভার্সিটিতে ভালো চাকরি পায়। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হওয়ামাত্র সে দু–কামরার একটি অপেক্ষাকৃত বড় অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করে। ইদানিং বনডেজ বেশ কিছু ফার্নিচার, কম্পিউটার, ডিভিডি ইত্যাদি কিনেছে। তার জিনিসপত্রের লটবহর এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অন্য অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করার সময় ভ্যালোরি তাকে ফিজিক্যালি হেল্প করেছেন। তিনি শনিবারের সমস্ত সকাল বনডেজের চেয়ার–টেবিল, টেলিভিশন ইত্যাদি ক্যারি করে নতুন অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গেছেন।

বনডেজের নতুন অ্যাপার্টমেন্টে আসার দুদিন পর থেকে তার সঙ্গে ভ্যালোরির দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। বনডেজ পাবলিকলি বলছে যে ভ্যালোরি জিনিসপত্র ক্যারি করার সময় তার কম্পিউটারের এক্সটারনাল হার্ডড্রাইভ এবং তার গ্র্যান্ডমাদারের স্মৃতিবিজড়িত ডায়মন্ডের আংটি চুরি করেছেন। ভ্যালোরি এ দুটি দামি দ্রব্য অচিরে ফেরত না দিলে সে পুলিশে যাবে বলেও শাসিয়েছে। প্রমাণস্বরূপ সে ভ্যালোরিকে একটি ফটোগ্রাফ দেখিয়েছে। ফটোগ্রাফে ভ্যলোরি এক্সটারনাল হার্ডড্রাইভটি হাতে নিয়ে বনডেজের অ্যাপার্টমেন্টে তার কম্পিউটার প্রভৃতি মুভ করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,বনডেজ কখন এ ধরনের ছবি তুলল? এর জবাব বনডেজ নিজেই তাঁকে দিয়েছে। জানিয়েছে যে তার অ্যাপার্টমেন্টে টেডি বিয়ার বা বাচ্চার খেলনা তোলার ভালুকটির ভেতরে লুকানো ছিল স্পাই ক্যামেরাটি। তাতে ভ্যালোরির ছবি উঠেছে। ভ্যালোরির ধারণা, বনডেজকে তথাকথিত চোরাই মাল ফেরত না দিলে তাঁকে হয়তো মোটা অংকের টাকা জরিমানা দিয়ে কোর্টে এই ঝামেলার ফয়সালা করতে হবে।

বিষয়টি পুলিশ অব্দি গড়ালে হয়তো ভ্যালোরির জন্য ঝুট-ঝামেলা হবে বিস্তর। থানা-পুলিশ এবং কোর্ট-কাচারিতে উকিল ছাড়া লড়া মুশকিল। এ দেশে উকিল–মোক্তারের খরচ অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র ছাত্রদের লিগ্যাল সাপোর্ট বা আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি সংস্থা আছে। আমি পরদিন খোঁজ-খবর নিয়ে এ সংস্থার টেলিফোন নম্বর, ই–মেইল অ্যাড্রেস ইত্যাদি তাঁকে জোগাড় করে দেব বললে ভ্যালোরি আমার দিকে তাকান। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।

আজকের আইসক্রিম সোশ্যালে বনডেজ আসেনি। তবে পার্টি-পর্বে বিদেশ থেকে সদ্যাগত পুরুষ স্কলারদের সান্নিধ্যে সেক্স অ্যাপিল ছড়ানোর প্রবণতা তার মধ্যে আছে। মাস তিনেক আগে তিউনিসিয়ার এক পুরুষ ডক্টরেল স্টুডেন্টের সঙ্গে দারুণভাবে বাহুলগ্না হয়ে মাঝরাত অব্দি সে ড্যান্স করে। তার পরদিন ছেলেটির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে। প্রমাণস্বরূপ দু-চারজনকে সে একটি ফটোগ্রাফও দেখায়। তবে বিষয়টি কোর্ট-কাচারি অব্দি গড়ায়নি। নর্থ ভিলেজের কানাঘুষায় শুনেছি যে তিউনিসিয়ার ছেলেটি ঘাবড়ে গিয়ে ক্যাশ পেমেন্ট করে বিষয়টি অতঃপর মিটিয়েছে। ভ্যালোরির নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে আমি বিশদভাবে অবগত। সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় বনডেজের স্পাই ক্যামেরার ব্যবহারও আমাকে চিন্তাগ্রস্ত করেছে। আইসক্রিম সোশ্যালে এসে আজ উদ্বেগে ভেঙে পড়া আমার প্রিয় মানুষটির দিনযাপন যেন দুর্বিষহ হয়ে না ওঠে, তার জন্য আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি।