আড়ালে থাকা বইগুলো

>

বিশ্বসাহিত্যে এমন অনেক শিল্পোত্তীর্ণ বই আছে, যেগুলো সেভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেনি। তাতে কী? আলো না পেলেও কালের অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি সেসব বই। যাঁরা সাহিত্যের নিবিড় পাঠক, তাঁরা আজও খুঁজে খুঁজে ঠিকই সেসব বই পড়েন। চলুন পরিচিত হওয়া যাক আড়ালে থাকা এমন কিছু বইয়ের সঙ্গে।

থেরেস রাকিন

প্যারিসের নোংরা–আবর্জনাময় এক গলি, যেখানে সূর্যকিরণ পর্যন্ত পৌঁছায় না। সেই গলির শেষ মাথার একটি বাড়িতে বাস করত উনিশ শতকের সবচেয়ে রূপবতী এক নারী—থেরেস। সে বিয়ে করেছিল তার চাচাতো ভাইকে। কিন্তু চাচি ছিল সাক্ষাৎ দজ্জাল। ফলে নানা অশান্তির ভেতর দিয়ে দিনযাপন করতে হয় তাকে। এই অপরূপ সুন্দরী রমণীর জীবনে আসে দ্বিতীয় প্রেম। কিন্তু স্বামীর প্রতি তার প্রেমের তো কমতি নেই। তাহলে সে কী করবে এখন? দুটো প্রেম কি একই সঙ্গে চালিয়ে যাবে? এমন এক মনস্তাত্ত্বিক গল্প নিয়ে এমিল জোলা লিখেছিলেন থেরেস রাকিন। কিন্তু বইটি কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেনি। তবে জোলা লেস রগন, জার্মিনাল, নানা ইত্যাদি লিখে ঠিকই আলো ছড়িয়েছেন বিশ্বসাহিত্যে।

ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন

জর্জ অরওয়েল বিখ্যাত হয়েছেন অ্যানিমেল ফার্ম লিখে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব দান করেছে। বয়ে এনেছে প্রভূত খ্যাতির সম্ভার। কিন্তু তাঁর লেখা প্রথম বই ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডনও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বইটির পাতায় পাতায় রয়েছে তাঁর বিশ্বসাহিত্য দখল করার পূর্বাভাস। গল্পটা অরওয়েলের নিজের জীবনের। প্যারিসের এক রেস্টুরেন্টে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতেন তিনি। ছিলেন ঘরছাড়া। সেসব দুঃখদীর্ণ দিনের গল্পই আছে এই বইয়ে। উপন্যাসটি পড়লে আজও যেকোনো পাঠকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, বেদনায় কেঁদে ওঠে হৃদয়—এতটাই মর্মস্পর্শী অরওয়ের ভাষা। কিন্তু বইটি অরওয়েলের অন্যান্য বইয়ের তীব্র আলোর নিচে হারিয়ে গেছে।

সিকাস্তা

নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক ডরিস লেসিংয়ের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি সিকাস্তা। উপন্যাসটিতে তিনি পবিত্রগ্রন্থ কোরআন ও বাইবেলের আলোকে মানব প্রজাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। কিন্তু বইটি পাঠক সাদরে গ্রহণ করেননি। সম্ভবত সে কারণেই লেসিংও কল্পকাহিনি লেখার দিকে আর মনোযোগী হননি। তবে সাহিত্যবোদ্ধারা মনে করেন, সিকাস্তা একটি সফল বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। যেসব পাঠক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পছন্দ করেন, তাঁদের পাঠ্যতালিকায় এখনো থাকে ডরিস লেসিংয়ের এই বই। লেসিং পরবর্তী সময়ে গ্রাস ইজ সিংগিং, কিলিং হার্ট, দ্য গোল্ডেন নোটবুক ইত্যাদি লিখে বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান হয়েছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০৭ সালে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার।

আ র‌্যাগ ইন হার্লেম

বইটির লেখক চেস্টার হাইমসকে বলা হয় আমেরিকার কালো লেখক। তিনি ‘হার্লেম’ গোয়েন্দা সিরিজ লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে পেয়েছেন ফ্রান্সের গ্র্যান্ড পিক্স দ্য লিটারেচার পুরস্কার। তাঁর উপন্যাস থেকে তৈরি করা চলচ্চিত্রগুলো পেয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে চেস্টার হাইমসের আ র‌্যাগ ইন হার্লেম পাঠকের আনুকূল্য পায়নি। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে লেখক চমৎকার স্বাদু গদ্যে তুলে ধরেছেন হার্লেমের অলস দিনগুলো। বইটা যখন লিখছিলেন, তখন হার্লেমেই বসবাস করছিলেন চেস্টার। চেস্টারের অন্যান্য বইয়ের মতো এটি তুমুল জনপ্রিয়তা না পেলেও সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক আজও বইটির সন্ধান করেন এবং পড়েন।

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট, ব্রিটানিকা, নিউইয়র্ক টাইমস ও বায়োগ্রাফি
গ্রন্থনা: মারুফ ইসলাম