এলিয়টের নিষ্ঠুর এপ্রিল আর মির্জা গালিবের হেমন্ত

>

দিনপঞ্জিতে এখন এপ্রিল মাস। টি এস এলিয়ট তাঁর কবিতায় এপ্রিলকে কেন নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করেছিলেন, আর মির্জা গালিবের হেমন্তই–বা কেমন ছিল?

দুই ভূখণ্ডের এই দুই কবি টি এস এলিয়ট ও মির্জা গালিব
দুই ভূখণ্ডের এই দুই কবি টি এস এলিয়ট ও মির্জা গালিব

সুন্দর কবিতা বলে যার নামডাক, সেই রকম সব কবিতা প্রথমবারের পাঠে সব সময় অর্থবোধ করে না। কবিতা নিজেই যেকোনো সংস্কৃতির সবচাইতে সূক্ষ্মতম প্রকাশ। যা চালু আছে তার বাইরে কিছু বলা ভালো কবিতার একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই হিসেবে সেই কবিতা প্রচলনের চাইতে অন্য রকম রূপক ব্যবহার করে। যাকে ভুলে গেছি বা অবজ্ঞা করেছি এমন কোনো সাংস্কৃতিক সূত্র সে হাতে ধরিয়ে দেয়। পুরোনো জেনে যাকে আধেক আঁখির কোণে চেয়েছি, তাকে সে নতুন অর্থ দিয়ে চমকে দেয়। কালে কালে এগুলো চিনে নিতে সময় লাগে। কিন্তু অনভ্যস্ত প্রথম পাঠে সে ধাঁধা লাগায়। অভ্যাসের ঘরে নতুনকে হাজির করে সে। সেই অতিথি যদি নিজগুণে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে তো ভালো। এখানে জবরদস্তি খাটে না।

টি এস এলিয়ট ১৯২২ সালে ওয়েস্ট ল্যান্ড বা পোড়ো জমি প্রকাশ করলেন। এর প্রথম স্তবকেই সেই অভ্যাসের ঘরে ধাক্কা দিল:

April is the cruellest month, breeding

Lilacs out of the dead land, mixing

Memory and desire, stirring

Dull roots with spring rain.

Winter kept us warm, covering

Earth in forgetful snow, feeding

A little life with dried tubers.

এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, জন্ম দেয়

লাইলাক মৃত জমি থেকে, স্মৃতি আর

বাসনা মিশিয়ে, ভোঁতা শিকড়গুলোকে

বসন্তবৃষ্টির জলে চাঙা করে তোলে।

আমাদের ওমে রেখেছিল শীত, স্মৃতিহীনতার

তুষারে পৃথিবী ঢেকে, শুকনো আলুতে

খাবার জুগিয়ে ছিল সামান্য জীবন।

(পোড়োজমি, টি এস এলিয়ট

অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ)

কবিতার শুরুটা খুব প্রসিদ্ধ। কিন্তু এর অর্থ বের করতে গিয়ে পাঠককে হয়রান হতে হয়। এই হয়রানিও এর সিদ্ধির এক কারণ বটে। কবিতার এ অংশে ফুল ফোটার আর বসন্ত আসার কথা হচ্ছে। কিন্তু এমন এমন মন খারাপ করা আমেজ কেন? আর শীতকাল তো কর্কশ। তার জন্য এমন স্মৃতিকাতরতা! কেমন সে শীত যে কিনা ওমে রাখে! বসন্তের উষ্ণতার বিপরীতে শীতের জন্য বিলাপ! আর এপ্রিল ক্রূরতম মাস? কেন? প্রথম যখন পাঠকের সামনে হাজির হলো এই কবিতা, সন্দেহ নেই, শুরুতেই তা প্রথার আরামে অভ্যস্ত পাঠককে হতোদ্যম করেছে।

এপ্রিল নিষ্ঠুরতম—এ ধারণা একেবারে নতুন নয়। এলিয়টের পূর্বপুরুষ এটা ভালোই জানতেন। তাঁদের জন্য এটা হচ্ছে খাজনা দেওয়ার মৌসুম। ফসল হোক না হোক, খাজনা মওকুব নেই। সারা বছর যেমন কাটুক, এপ্রিলের খাজনা–আতঙ্ক এর পরের মে মাসের বসন্তের উষ্ণতাকেও ছাপিয়ে যায়।

আবার পরপর বিপরীতের দ্বন্দ্ব মানুষের সুখের ওপরে ছাপ ফেলে। এপ্রিল এসেছে। সামনে বসন্তের সূর্য, ফুলের ঝলক। কিন্তু যে মানুষ শুধু অন্ধকার দেখে চোখ সইয়েছে, সে এই আলোয় ভরা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কী নিষ্ঠুর বিপরীতের খেলায় মাতে! শীতে না হয় সব ঠান্ডা, মৃত। হতোদ্যম মানুষের ভেতরের জগতের সঙ্গে তার কোনো তফাত নেই। কিন্তু বসন্তের উচ্ছল প্রাণের সঙ্গে সে এখন কোন খেলা খেলবে?

এলিয়টের ব্যক্তিজীবন খুব সুখের ছিল না। যখন তিনি পোড়ো জমি লিখছেন, তখন স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে বিয়ে ভাঙতে চলেছে। ভিভিয়ানের মানসিক আর শারীরিক বিপর্যস্ততা ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলেছে। সব মিলিয়ে এলিয়ট নিজে নার্ভাস ডিজঅর্ডারের শিকার হয়ে আছেন। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে ভিভিয়ানের গোপন প্রেম চলছিল বলেও লোকমুখে জোর আলাপ চালু ছিল। এ রকম কয়েক বছর কাটানোর পর এলিয়ট আলাদা হয়ে যান। ভিভিয়েন পুরোপুরি মানসিক সংলগ্নতা হারান। মানসিক হাসপাতালে নয় বছর কাটিয়ে তিনি মারা যান। এই নয় বছরে কখনো আইনত স্ত্রীকে একবারও দেখতে যাননি এলিয়ট। পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে এই অসুখী বিয়ে পোড়ো জমি লেখার অনুভূতিতে রসদ জুগিয়েছিল।

ওয়েস্ট ল্যান্ড–এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ, ১৯২২
ওয়েস্ট ল্যান্ড–এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ, ১৯২২

বাহির আর ভেতরের এই দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ এলিয়ট প্রাচীন গ্রিক ঐতিহ্যেও পেয়ে থাকতে পারেন। এপিকিউরাস ছিলেন সুখবাদী দার্শনিক। কিন্তু সেই সুখ বাঁধহীন নয়, বরং বাঁধ দিয়েই পেতে হয়। তিনি বলতেন যে সংযমের মধ্যেই সর্বোচ্চ সুখ পাওয়া যায়। বিলাসে ডুবে যাওয়া চারপাশের জীবনকে শেষতক একঘেয়ে করে দেয়। ফলাফল সুখহীনতা। এলিয়টের এই কবিতায় বর্ণনায় যে সুখহীনতা, বসন্তের উচ্ছলতা তাকে আরও প্রকট করবে, এতে সন্দেহ নেই। সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর দেশে বিদেশে বইয়ে আবদুর রহমানের বয়ানে একটা গল্প বলেছিলেন। পাঞ্জশীর গ্রামে সেই বহু রকম বরফ পড়ার অনবদ্য বর্ণনা! সেখানে শীতের তুষার ঝড়ে বরফ চাপা পড়া মানুষ সেই বরফের ওমেই বেঁচে থাকে। এলিয়টের অন্তরে শীতের অন্ধকার নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ বাইরের শীতের সেই উষ্ণতা নিয়ে বেশ থাকে। ঝামেলা বাধায় এপ্রিল। সে বসন্তের সম্ভাবনাকে মেলে ধরে। অন্তরে আর বাহিরে তখন তাল মেলে না তালে। এই এপ্রিল মৃত বন্ধ্যা জমিনে স্মৃতি আর বাসনার মিশেলে শুষ্ক শেকড়ে বসন্ত বৃষ্টি সেচে ফুলের সম্ভাবনার কথা বলে। এতদিন বাহির আর ভেতরের অন্ধকার একাকার হয়েছিল। এপ্রিল তার বিচ্ছেদের কথা বলে। এপ্রিল তো নিষ্ঠুরতম। সন্দেহ কী!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সাদা মানুষদের জগৎকে পরিত্রাণ দেওয়ার অহমিকা তীব্রভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। পুরো পশ্চিমা জগতে তখন ওমর খৈয়ামের রুবাই বিস্ময়কর রকম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারা খৈয়ামের মধ্যে এক ধরনের নির্বিচার সুখবাদ খুঁজে তাতে বুঁদ হয়ে যায়। ওদিকে নিজেদের মধ্যে বীভৎস রক্তপাত দেখে ইউরোপ হতবাক! এলিয়ট এই ইউরোপে বাস করেই পোড়ো জমি লিখেছেন।

আরেক তুলনা দেখা যাবে এদিকের ভারতবর্ষে। মোগল যুগ শেষ। আসছে ইউরোপের হাত ধরে আজকের আধুনিককাল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত নতুনকে কবিতায় স্থান দিতে ব্যর্থ হয়েছিল গালিবের সময়কার প্রথাগত কাব্য। শরাব আর সাকির সেই পুরাতন ভূমিকা আর একে ধরতে পারছিল না। মির্জা গালিবের জন্য নতুন কাব্যতত্ত্ব হাজির করলেন। নতুন সময়ের সঙ্গে শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টি করতে না পারলে কবিতা কেবল জীর্ণ বিষয়ের কোলাহল হয়ে রয়ে যায়। ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে গালিব জানালেন যে পুরাতন ব্যবহারে শব্দ জীর্ণ হয়ে যায়। এর জন্য দরকার নতুন সময়ের সঙ্গে শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টি করা। একই সময়ে ইংল্যান্ডে শেলিও তাঁর ‘আ ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ প্রবন্ধে প্রায় একই ধারণা ব্যক্ত করছেন।

মোগল শাসনের পতনের পর ১৮৫৭-এর নিষ্ঠুর প্রাণক্ষয় শেষে অবসাদগ্রস্ত মির্জা গালিবও বসন্তে দেখতে পাচ্ছেন নিষ্ঠুর নতুন প্রাণের বিজয় বার্তা। তবুও তাঁর চোখের সামনে কেবল নৈরাশ্যের অন্ধকার। সেখানে দিন আর রাতের তফাত জানতে চাওয়া অর্থহীন। একজন অসহায় ভারতবর্ষীয়র চোখের সামনে স্তবকে স্তবকে আধুনিককাল নিজেকে মেলে ধরছে। যা কিছু মহান, মহিমাময় সব ধসে পড়ছে অসহায়ভাবে। সেই মির্জা গালিবের কাছে পাতাঝরা হেমন্ত আর বসন্তের মাঝে কোনো ফারাক নেই:

হেমন্ত কী? বসন্ত কাকে বলে?

যেকোনো মৌসুমেই

সেই আমি, সেই খাঁচা আর ডানা

পালক হারাবার মাতম

আমার বিরান দুঃখঘরের দেয়াল-দরজায়

জন্মেছে সবুজ ঘাস

যার বসন্ত এমন, তার পাতাঝরা

হেমন্তের গল্প কী বলব!

আমার দেয়াল-দরজা ভেদ করে

সবুজ জন্মায় গালিব

আমি বিরাণ মরুতে আর ঘরে বসন্ত এসেছে

স্মৃতির এই পরিচিত গলিপথ ধরে আসা-যাওয়ার মধ্যে স্বস্তি আছে। মনে থেকে যাওয়া কথার অতীত আর বর্তমান এক হয়ে যায় শীত আর বসন্তের সঙ্গে। স্মৃতিও ধূসর হয়ে আসে চলে যাওয়া সময়ের হাত ধরে। বসন্ত সেই নিষ্প্রাণ ধূসরতায় জল ছুঁইয়ে ফিরিয়ে আনে বেদনাকে। বৃক্ষের প্রিয় পাতা বিসর্জন দেওয়া শীত ভুলে যাওয়ার কথা বলে। বসন্ত আবার তাকে ডেকে আনে। সেই বিসর্জন মেনে নেওয়া শীতের সমর্পণ বহমান অতীত, স্মৃতিও বটে। সেই অতীত এখন অনাগত বসন্তের সামনে অসহায়। শুকনো শেকড়ে অনিচ্ছুক প্রাণ জোগাচ্ছে বসন্তের বৃষ্টিজল। বসন্তের আগমনের আগে পারস্যেও বৃষ্টি হয়। সেই সাংস্কৃতিক স্মৃতি মির্জা গালিব মনে রেখেছেন। তাঁর কবিতাতেও শীতের অন্ধকার আকাশ নিজের বেদনার জগতে বিরহের শীতল জীবনকে মেনে নিয়ে জীবনকে যাপনের সমার্থক:

বসন্ত মেঘের বর্ষণ শেষে উন্মুক্ত আকাশ

আমার কাছে

যেন বিরহ বেদনার অশ্রুতে

নিজেই ভেসে যাওয়া

মনে না করলে কি ভোলা সম্ভব! ভুলে থাকতে চাওয়া, সে তো আসলে ভুলে থাকাকেই ভুলে থাকতে চাওয়া। এই বসন্তের তুলনায় শীতের বিবশতা তো আশীর্বাদ! শীত তো ভুলে থাকতে দিয়েছিল। বসন্ত কেড়ে নেবে সেই অবলম্বনও।