'নিজের ভাষায় মনের ভাব যতটা সহজে প্রকাশ করতে পারি, স্প্যানিশে তা সম্ভব না'

>

মনিরুল ইসলাম। ছবি: খালেদ সরকার
মনিরুল ইসলাম। ছবি: খালেদ সরকার

বরেণ্য চিত্রকর মনিরুল ইসলাম। ফেসবুকে যিনি নিজের পরিচয় লিখেছেন ‘মনির আর্টিস্ট’ নামে। কিছুদিন আগে এ শিল্পী পেয়েছেন স্পেনের সম্মানসূচক ‘রয়েল স্প্যানিশ অর্ডার অব মেরিট’। বাংলাদেশ ও স্পেনে তাঁর দুই জীবন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর সেই জীবন সম্পর্কে। কথা বলেছেন নিজের শিল্পভাবনা ও কাজ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

এ কে এম জাকারিয়া: আপনি দীর্ঘ সময় স্পেনে ছিলেন, এখন বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে। একজন শিল্পীর জন্য দেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? দেশ-বিদেশ কেমন পার্থক্য তৈরি করে?

মনিরুল ইসলাম: শেষ পর্যন্ত দেশ নিজের জায়গা। দেশের বাইরে যত কাজই করি না কেন, দিন শেষে নিজেকে শিকড়বিহীন গাছের মতো মনে হয়। পরিবেশগত কারণে আমরা দেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকি। যাঁরা পাহাড়ি এলাকায় বাস করেন, তাঁরা পাহাড় ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। আবার যাঁরা সমুদ্রের ধারে থাকেন, তাঁরও সমুদ্র ছেড়ে কোথাও যেতে নারাজ। জন্মের পর থেকে আমাদের পরিবার, যেখানে আমরা বড় হই, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতিগুলো স্মৃতি হিসেবে জমা হয়। এক গবেষণার কথা শুনেছি, ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত কেউ যেখানে থাকে, সেই জায়গার প্রভাব তার জীবনে সব সময় থেকে যায়। ৫০ বছর আমি দেশের বাইরে ছিলাম। কিন্তু দেশের মাটির প্রতি টান একটুও কমেনি। আমার জন্য ছবি আঁকা বা কাজ করে যাওয়াই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, তার প্রভাব নিশ্চয় থাকে। কিন্তু ছবি আঁকার সময় কোথায় বসে তা করছি, তা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।

জাকারিয়া: যে ভাষায় মানুষ কথা বলা শেখে সেটাও তো গুরুত্বপূর্ণ। স্পেনে আপনাকে স্প্যানিশ শিখতে হয়েছে, সেই ভাষায় কথা বলতে হয়েছে। আমরা যাকে মায়ের ভাষা বলি, সেই ভাষা কতটুকু ভূমিকা রাখে একজন শিল্পীর জীবনে?

মনির: জীবনের প্রয়োজনে একজন শিল্পী যেখানেই যান না কেন, নিজের ভাষা তাঁর শিল্পে বড় ভূমিকা রাখে। আমরা নিজের ভাষাতেই কল্পনা করি, ভাবি। একজন শিল্পীর ভেতরের সব সৃষ্টি তাঁর আপন ভাষাতেই শুধু নতুন করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। স্পেনে যাওয়ার পর স্প্যানিশ ভাষাটাকে বেশ ভালো করেই রপ্ত করতে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার নিজের ভাষায় মনের ভাব যতটা সহজে প্রকাশ করতে পারি, স্প্যানিশে তা সম্ভব না। মাতৃভাষার যে অনুভূতি, তার বিকল্প কিছু হতে পারে না। আমার ছবিতে কোনো না কোনোভাবে এর প্রভাব থাকবেই।

জাকারিয়া: এটা বলা হয়ে থাকে যে একজন শিল্পী যে ইমেজ তৈরি করেন, তা তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু নয়। আপনি জন্মেছেন ও বড় হয়েছেন বাংলাদেশে, আর শিল্পী জীবনের বড় সময় কেটেছে দেশের বাইরে। কোন ইমেজগুলো আপনার সামনে এসেছে বা আপনি এঁকেছেন।

মনির: আমি যেসব জায়গায় থেকেছি, বড় হয়েছি বা এখন থাকছি, সেখানকার নানা ইমেজ আমার মনে গেঁথে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। আমার ছবিতে নানাভাবে এসবই উঠে এসেছে। অনেক ইমেজ অনেক সময় আমাদের চোখে আটকে থাকে। এখন সেই ইমেজকে আপনি কীভাবে তুলে ধরবেন, সেটা হলো গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের বিবর্তনে ছবির ধরন ও ইমেজের প্রকাশ বদলে যাবে, এটাও স্বাভাবিক। একজন শিল্পী তাঁর মনে গেঁথে থাকা ইমেজগুলোই নিজের ভঙ্গিতে ও নতুন ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন।

নিজের স্টুডিওতে মনিরুল ইসলাম। ছবি খালেদ সরকার
নিজের স্টুডিওতে মনিরুল ইসলাম। ছবি খালেদ সরকার

জাকারিয়া: আপনি যে সময়ে শুরু করেছিলেন তখন থেকে নতুন অনেক কিছু হতে হতে এখন কোথায় এসে ঠেকল?

মনির: অনেক বদল হয়েছে। মাধ্যমের বদল হয়েছে। আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন অনেক মাধ্যম ছিল না। জলরং আর তেলরঙের আঁকিবুঁকিই ছিল সম্বল। এখন মাধ্যমের শেষ নেই। প্রকাশের ভঙ্গিতেও অনেক বদল এসেছে। এখনকার শিল্পীদের অনেকেই পেইন্টিং থেকে বের হয়ে গেছেন। তাঁরা ইন্টেরিয়র, গ্রাফিকস—এসবে চলে গেছেন। সেখানে শিল্পের এক নতুন ধারা তৈরি হলেও শিল্পের ছোঁয়া হয়তো কম। তবুও ভালো কাজ হচ্ছে। আগের দিনে একজন শিল্পী একাই আসলে অনেক ধরনের কাজ করতে পারতেন। আমি যদি বলি সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পী কে, তাহলে অবশ্যই দা ভিঞ্চির নাম বলতে হবে। তিনি আট-দশটি বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন। তাঁর জ্ঞান থেকেই পরে শিল্পের নানা রকম ধারার সৃষ্টি হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সুর, ছবি কোথায় নেই তিনি।

জাকারিয়া: এখন তো বিশ্ববাস্তবতা বদলেছে। দুনিয়া খুলে গেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে জ্ঞান সব হাতের মুঠোয়।

মনির: বর্তমানের এই বাস্তবতাকে অস্বীকার বা বিরোধিতা করার কিছু নেই। ভালো দিক হচ্ছে, এর কারণেই আজ একজন শিল্পী সহজেই বিশ্বের অনেক শিল্পীর কাজ দেখতে পাচ্ছেন। আবার এই কারণেই একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এবং প্রযুক্তির দক্ষতা নিয়ে পাল্লা দেওয়ার ঘোড়দৌড় তৈরি হয়েছে। একজন শিল্পীর এ থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিল্পী হবেন স্বাধীন। তাঁকে নিত্যনতুন বিষয় জানার পাশাপাশি নতুন করে চিন্তা করার মানসিকতাও রাখতে হবে। হালের সঙ্গে তাল মেলাতে অনেকেই এখন নতুন ধারার ছবিতে অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু তারা পুরোনো জিনিস দেখে শিখতে সময় ব্যয় করে না।

জাকারিয়া: আপনি শিল্পীর স্বাধীনতার কথা বললেন, শিল্পীরা তো আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন হয়েছেন। মাধ্যমের গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে।

মনির: এটা ঠিক যে শিল্পীরা এখন আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন হয়েছেন। শিল্পীর এখন কোনো বাধা নেই। আগে তাঁকে রাজার মুকুটই আঁকতে হতো বারবার। পুরোনো চার্চে গেলে চোখে ভাসে শুধু বাইবেলের ছবি। কিন্তু এখন একজন শিল্পী সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে শিল্পের দুনিয়ায় এখনো কিছু সংকট থেকে গেছে। শিল্পীরা সবাই নতুন কিছু করার জন্য উন্মুখ। কিন্তু দীর্ঘদিন আমাদের শিল্পে নতুন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে না। সময়কে হার মানিয়ে সামনে ছুটে যাওয়ার মতো ছবি কিন্তু আমরা আর পাচ্ছি না।

জাকারিয়া: আপনি একসময় এচিং করতেন। মনে আছে আপনি আমাকে বলেছিলেন এচিংয়ে আপনার আর কিছু কারার নেই বলেই আপনি সরে এসেছেন। এখন যদি ফর্মের কথা বলি তা হলে আপনি দীর্ঘ সময় ধরে বিমূর্ত ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। আপনার কি কখনো মনে হয়নি যে বিমূর্ত কাজে আপনার আর নতুন কিছু করার নেই, এটা ছেড়ে অন্য কিছু করি?

মনির: আমরা আসলে প্রকৃতি থেকে শিখি। আমার ছবির সব অনুপ্রেরণা আমি প্রকৃতির রূপ থেকে পেয়েছি। প্রকৃতির বাইরে গিয়ে আসলে ইমেজ তৈরি করা কঠিন। তবে আমার ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয় যে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না ঠিক কী করা উচিত। বিশাল ক্যানভাসে অনেক কিছু আঁকা যায়। তখন ধন্দে পড়ে যাই, আমার কী আঁকা উচিত আর কী আঁকা উচিত না।

জাকারিয়া: আপনাকে দেখেছি কাগজে রং লাগান তা আবার নষ্ট করেন। আবার রং চাপান। রেখা টানেন। এর ওপরও আবার কাজ করতে থাকেন। কখন বুঝতে পারেন যে ছবিটি শেষ হয়েছে?

মনির: ছবি কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার ধারণা আসলে শিল্পী নিজেও রাখেন না। শিল্পীকে ঠিক বুঝে নিতে হয় ছবির প্রাণটা কোথায়। সেটা মিললেই শিল্পীকে ছবি আঁকা থামিয়ে দিতে হবে।

জাকারিয়া: কয়েক বছর ধরে দেখছি আপনি নতুন ধরনের কাজ করছেন। ক্যাটালগ বা ম্যাগাজিনের পাতায় কাজ করছেন। কাজগুলো ম্যাগাজিন বা বই আকারেই আছে। এই আইডিয়া কীভাবে এল?

মনির: আমার বাসায় অনেক আর্ট জার্নাল, ক্যাটালগ ও ম্যাগাজিন জমেছিল। ভাবলাম এগুলো নিয়ে কী করা যায়। নতুন একটা সাদা কাগজ দেখলে এখন আমার ভয় লাগে। কোথা থেকে কী শুরু করব সেটাই ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু পুরোনো কাগজে বা ম্যাগাজিনের পাতায় যে ছবি, দৃশ্য বা দাগ থাকে, তা থেকে আমি যেন নতুন কোনো ছবির আন্দাজ করে উঠতে পারি। চার বছর ধরে আমি ম্যাগাজিন ও ক্যাটালগে কাজ করছি। ভেবে দেখছি যে নতুন কিছু করা যায় কি না। ফর্মে ও টেক্সচারে নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছি আমি।

জাকারিয়া: এগুলোর ভবিষ্যৎ কী?

মনিরুল: আমি প্রদর্শনী করি না গত সাত বছর। আমি এই যে ছবিগুলো এঁকে চলেছি এগুলো নিয়ে কারও সঙ্গে আমার কোনো চুক্তি নেই। কেউ এই ছবিগুলো কিনতে এলেও আমি দিই না। আমার এই ছবিগুলো শুধু আমার। এই কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক আনন্দ পাচ্ছি আর আমার স্বাধীনতাকে উপভোগ করছি। এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কোনো নির্দিষ্ট ভাবনা নেই। এগুলো নিয়ে একটা বইও হতে পারে। কয়েক হাজার কাজ করেছি, কিন্তু এক শটিও শেষ করিনি। আমি জানি না এই ছবিগুলো কবে শেষ হবে। আমার কাছে এগুলো হিডেন ট্রেজার।

জাকারিয়া: আপনি দীর্ঘ সময়ে স্পেনে থেকেছেন, সম্প্রতি স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পেয়েছেন...

মনিরুল: আমি স্পেনে ছিলাম প্রায় ৫০ বছর। সেখানে গিয়ে আমার চিন্তাধারা বদলে গেছে। সেখানে না গেলে হয়তো আজ আমি যা তা হতাম না। আমরা মুখে যা-ই বলি না কেন, দিন শেষে কোনো প্রদর্শনীতে যখন ছবি বিক্রি হয়, যখন কোনো পুরস্কার মেলে, তা একজন শিল্পীকে প্রশান্তি দেয়। শিল্পীদের নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দেয়। এমন কিছু অর্জনের জন্য আমাকে স্থানীয় অনেক শিল্পীর চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিদেশের মাটিতে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হয়েছে।

আরেক প্রস্থ মনিরুল ইসলাম

● মনিরুল ইসলামের ডাকনাম রফিক।

● ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সিনেমা দেখার পাগল। এমনকি বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিলে বাবার পকেট থেকে পয়সা চুরি করেও সিনেমা দেখেছেন।

● ছেলেবেলায় বাবার অফিসের স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক পোস্টার দেখে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ জন্মে।

● পড়াশোনায় এ শিল্পীর ছিল বেজায় অমনোযোগ। পরপর তিনবার মেট্রিক (এখন এসএসসি) ফেল করেছিলেন তিনি। কিন্তু আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গেলে অবশ্যই মেট্রিক পাস করতে হবে। তাই এর পরের বছর দেখা যায় প্রথম শ্রেণিতে মেট্রিক পাস করেছেন তিনি।

● রান্না করতে ভীষণ ভালোবাসেন মনির। বিভিন্ন ধরনের স্প্যানিশ রান্নায় তাঁর হাত আছে। অতিথিকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করেন তিনি।

● ঢাকা কিংবা স্পেনের বাসায় বাজার, রান্না থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া কিংবা ঘর মোছা—সবই নিজের হাতে করেন মনির।

● তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষা ইউরোপে ‘স্কুল অব মনির’ নামে পরিচিত।

● তাঁর একমাত্র ছেলে আরমান ইসলাম পেশায় এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ার। এখন পড়ছেন স্পোর্টস নিউরোলজি নিয়ে।

সূত্র: মনিরুল ইসলামের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার