আলোকের এই ঝরনাধারায়

বাংলা একাডেমির সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খান ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীসহ শান্তিনিকেতনের আড্ডায় বাংলাদেশি অতিথিরা
বাংলা একাডেমির সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খান ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীসহ শান্তিনিকেতনের আড্ডায় বাংলাদেশি অতিথিরা

কোন অংশে প্রিয়তা কতটা, কিংবা কার কাছে কী পরিমাণ ভালোবাসা, তা বোঝার এবং জানার জন্য একটি ফলবান বৃক্ষের শীর্ষদেশ বেছে নেওয়া যেতে পারে। বিষয়টি এমন, সময় ও সুযোগমতো সেখানে অবস্থান করে লক্ষ করতে হবে তলদেশের। স্বগোত্রের কয়েকজন ব্যক্তি হয়তো ক্রাচে ভর দিয়ে ঊর্ধ্বমুখে পরম বিস্ময়ে দৃশ্যটি অবলোকন করছে। কেউবা চশমা খুলে কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে অবস্থানটি বোঝার প্রচেষ্টায় রত। অপরদিকে এক পক্ষ যষ্টি হাতে অপেক্ষায়, নাগালে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার বাকিরা বুঝিবা বুকে হাত দিয়ে আহরিত ফলটি অধিকারের জন্য উদ্গ্রীব।

চিত্রটি যখন কল্পনা থেকে বাস্তবে প্রবেশ করে, তখন চতুর্দিকে অন্তহীন কোলাহল। তার আবার নানান মাত্রা, নানান সূত্র। ‘আরে, ও তো ছিল নুনের তরফে—কীভাবে ফলবান বৃক্ষের সন্ধান পেল?’ অন্যদিকে তখন বাজছে, ‘নুন আর ফুল, এ কেমন রস?’ কানকথা, হাওয়াকথা, ধরাকথা, গড়াকথা...সব নিয়েই তো মাঠ পেরিয়ে নদী, জল ডিঙিয়ে অরণ্য, আর অরণ্যের অভ্যন্তরে হৃদয়ের তোড়!

বেলা বেড়ে বেড়ে পোক্ত হচ্ছে মাটি, শক্ত হচ্ছে ঘাঁটি। মর্যাদার মাপটুকু তাপ শুষে ঘাম ঝরায়, কল্পনায় ধরা পড়ে জল্পনার স্বর্ণফসল! দূরের ডাকে সুরের ভেদটুকু বুঝে নিয়ে রচিত হতে থাকে পদমাফিক যাত্রাছন্দ!

দুই: আকাশের বিপত্তি ঢের। রোদ সামলাতে সামলাতে মেঘ ঝাঁপ দেয়। বলা নেই, কওয়া নেই পাখি এসে বুক ফুলিয়ে ডানা উড়িয়ে এলোমেলো করে দেয় চলতি হাওয়া। আর বজ্রবাবু তো চোখ রাঙিয়ে গলা ফাটিয়ে তেড়েফুঁড়ে বুক কাঁপিয়ে নামে।

এহেন আকাশে কলের পক্ষীর উড্ডয়ন বেশ কায়দাকানুনের হতে হয়। নইলে যেকোনো মুহূর্তে নৌকার মতো দোল দেবে, চাই কি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে ঘটাবে পেল্লায় কাণ্ড। এতসব কূট-সম্ভাবনা সত্ত্বেও কিন্তু কলের পক্ষীকে আস্থায় নিয়ে উড়তে হয়। দূরপাল্লার যাত্রায় উড়োজাহাজ তো আজকাল সঙ্গী হওয়ার জন্য বন্দরে মুখ উঁচিয়ে আছে। কত কোম্পানির কত রকমের জাহাজ, কত কত তার কায়দা-কেতা। তবে এবারের পথ সামান্যই এবং সেহেতু সময়ও ঘণ্টার কাঁটাকে এক দাগের বেশি পেরোতে দেয় না। ঢাকা-কলকাতা—সকাল দশটার কিছু পরে উড়ে এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া। বিষয় ‘বঙ্গীয়’র আয়োজনে ‘বিশ্বসভা’; স্থান: শান্তিনিকেতন। কলকাতা থেকে এক বাসভর্তি সাধুজন এবং তাদের লটবহর নিয়ে শান্তিনিকেতন পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ফুরিয়ে গেল। ঠাঁই হলো রতন কুঠিতে। এ এক অন্য শিহরণ—যেন রবীন্দ্রনাথ সম্মুখের আমলকী বাগান থেকে ফিরে গেছেন বলেই রথীন্দ্রনাথ বড় শিল্পসুষমায় কুঠির আসবাব সাজিয়েছেন। বসার কেদারায়, খাওয়ার আসনে, দেয়ালের ছবিতে কী ঘরের মেঝেতে দিনবদলের রেখা পড়লেও ছায়াটুকু কিন্তু আজও মুছে যায়নি।

তেরো নম্বর ঘর, তুমি কি আপন না পর?

তিন: সকালে শরীর বেয়াড়া হলো বেজায়। লুচি-তরকারির তেলের বাহার ঘাম ঝরিয়ে জ্বালা ধরিয়ে এমন দশা করল যে পিয়ার্সন হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হলো। এক স্লিপভর্তি ওষুধের নম্বর হিসাব করা দুরূহ বিধায় শীর্ষেরটি দিয়েই দুপুর কাটানো গেল।

বিকেলটি সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে ঢুকে পড়ল ‘বঙ্গীয়’র উদ্বোধনী আয়োজন নিয়ে। শান্তিনিকেতনের বাংলাদেশ ভবন, ভারী ভারী মানুষের চাপ নিতে না পেরে বিদ্যুৎ–হারা হলো কিছুক্ষণের জন্য। তার মধ্যেও সারি সারি চেয়ারে বসা মহাজন সমাবেশের হেলদোল নেই। বক্তা ও বক্তব্য পাল্লা দিয়ে ঘড়ির কাঁটাকে হার যখন মানাল, তখন নয়টা। ভোজন ও তৎপরবর্তী নৃত্যগীত অবসরে যে যাবে, তার ব্যবস্থা কে করে? সাহিত্য-সংস্কৃতির ‘বিশ্বসভা’য় আয়োজকদের পরিকল্পনা এবং বাংলা ভাষাসেবীদের ধৈর্যের পরীক্ষা চাক্ষুস না করলে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

কী লীলায় কারে যে মিলাও তা শুধু তুমিই জানো গুরুদেব!

চার: ফুল ছিল টেকনো ইন্ডিয়ার বোলপুরস্থ পাবলিক স্কুলে, ছিল সংগীত ও নৃত্য। সকাল পার করা এ আয়োজনটির আন্তরিকতা স্পর্শ করে গেল প্রাণ। দূরদূরান্ত থেকে—এমনকি বাংলাদেশ থেকেও পড়ালেখার জন্য আসা ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে মুখর ঘরটি ছিল অতি আপন। ‘আলোকের এই ঝরনাধারায়’ আমরা কজনও যেন পুণ্যস্নান করার অবকাশ পেলাম।

আজ এপ্রিল ফুল। তার মধ্যেও ‘বঙ্গীয়’র বাংলাদেশ ভবনের অনুষ্ঠানমালা ছাপিয়ে পাওয়া গেল এক অন্য আবেশ। দিনটি রোদের তাপে যত না, তারও চেয়ে বেশি পরিপার্শ্বের খরবায়ুতে এলোমেলো হয়ে যায়। বাংলাদেশ ভবনের গ্রন্থাগার কি দিল সামান্য সুবাতাস?

পাঁচ: ভোরবেলা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাটল। পথ বিলি দিয়ে তিনি ভুবনডাঙায় নিয়ে এলেন। পৃথিবীর সব রৌদ্র যেন এখন বোলপুরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। নষ্ট মোবাইল, ছেঁড়া পাঞ্জাবি, ঝলসে যাওয়া শাড়ি যখন একসঙ্গে ডাক দিল, তখন তো সবাই বসন্তের বাতিল কোকিল। নতুনেরে পাব বলে ফিরে আসে কোপাই তীর, বটমূল, মাটির ঘর—সুন্দর যে সেখানে আসন পেতেছে! বিকেল-সন্ধ্যা পালা করে আবৃত্তি-গান-নাটকে মজে থাকে। ভাতের থালায় মুরগি দশাপ্রাপ্ত হলেও রাতের ভূতেরা (!) কিন্তু হানা দেয় তেরো নম্বরের দরজায়। শেষ প্রহরের খণ্ড ঘ্রাণ মণ্ডসম, লেগে থাকে নৈশ প্রান্তরে, লাল সুরকি বিছানো পথে।

ছয়: ফিরতে হবে বলেই ফেরা। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শুরু—মোটে তো মাত্র পাঁচ দিনের বাস—উড়োজাহাজের ঢাকা-শান্তিনিকেতন; তার মধ্যেই ভাষা, তার মধ্যেই আশা। স্বপ্ন তুলে দিয়েছিল শিখরে, বাস্তব তাকে মাটিতে নামিয়ে বলল: দেখো তো চেনো কি না!

রবীন্দ্রনাথ, আপনি জানেন ওঠা-নামার বৃক্ষটি শক্ত মাটি পেলে মূলে অনড় থাকে!

আর তীরবর্তী কুজনেরা কেবল কুকথারই ইজারাদার।