কালো সীমানার রক্তাক্ত জীবন

সাদত হাসান মান্টো
সাদত হাসান মান্টো

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, সেই বিভক্তি সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক মহাদাঙ্গা, দেশান্তরি, ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও লুটপাট, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারীর সার্বিক লাঞ্ছনা ইতিহাসের পাতায় যতটা চিত্রিত, তার চেয়ে কম চিত্রিত নয় কথাসাহিত্যে, বিশেষত উর্দু, হিন্দি ও পাঞ্জাবি সাহিত্যিকদের কলমের তুলিতে।

উল্লিখিত দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে যাঁর কলম সবচেয়ে সচল ছিল, তিনি ক্ষণজন্মা উর্দু সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টো। আমরা যদি ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার ইতিহাস না–ও পড়ি, যদি পড়ি শুধু ওই দাঙ্গাকে নিয়ে লেখা মান্টোর গল্পগুলো, তাহলেই চোখের সামনে দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে দাঙ্গার স্বরূপ, দাঙ্গার বীভৎসতা এবং তার দূরপ্রসারী পরিণতির ছবি।

এত দিন আমরা শিহরিত ও বিমোহিত হয়েছি মান্টোর দাঙ্গাকেন্দ্রিক ‘খোল দো’, ‘ঠান্ডা গোশত’ ও ‘টোবাটেক সিং’–এর মতো গল্প পড়ে। সরাসরি উর্দু থেকে এই প্রথম জাভেদ হুসেন মান্টোর সিয়াহ হাশিয়ে বইটি অনুবাদ করেছেন কালো সীমানা শিরোনামে। এ বইয়ের প্রতিটি গল্প ১৯৪৭ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে রচিত। এই দাঙ্গার যে বীভৎসতা, মানবিকতার চূড়ান্ত ভূলুণ্ঠন—মান্টো তাঁর তীব্র-তীক্ষ্ণ-সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, এককথায় তা নজিরবিহীন।এই বইয়ের গল্পগুলোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, অনুবাদক জাভেদ হুসেনের ভাষায়, ‘ফর্মের জায়গা থেকে এই গল্পগুলো এক বিস্ময়। এক লাইন, দুই লাইনের গল্প। কখনো সাত শব্দ, কোথাও বারো শব্দের গল্প। কিন্তু সব গল্পই সম্পূর্ণ।’ এ-রকম ৩২টি গল্প আছে বইটিতে।

‘দয়া’ গল্পটা এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। দাঙ্গার নিষ্ঠুরতার চেহারা যে কত বিচিত্র, এ গল্পের ভেতর দিয়ে তা উঠে এসেছে। গল্পটি এ রকম: ‘আমার চোখের সামনে মেয়েটাকে মেরো না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, লোকটার কথা রাখো। মেয়েটাকে ওই দিকে নিয়ে চলো।’

এভাবেই এ গল্পের সমাপ্তি। এ যেন বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুকে পাওয়া। এক বিন্দু রক্ত থেকে এক সাগর রক্তের বিস্তারকে দেখতে পাওয়া।

‘বিশ্রাম’ গল্পটা মাত্র দু-লাইনের। অথচ ওই দুই লাইনেই বলা হয়ে যাচ্ছে এমন দুই চরিত্র ও চিত্রের কথা, যার পাঠ মুহূর্তে মনকে শিহরিত করে তোলে। গল্পটি এমন:

‘আরে মরেনি! এখনো বেঁচে আছে!’

‘থাক দোস্ত...খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি।’

এ গল্প সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

আমাদের অনুবাদ সাহিত্যে কালো সীমানা সংযোজনস্বরূপ এক গ্রন্থ। তুলনাবিহীন এ গ্রন্থের অনুবাদক জাভেদ হুসেনকে আন্তরিক অভিনন্দন। অভিনন্দন এ বইয়ের যে দীর্ঘ ভূমিকা তিনি লিখেছেন, তার জন্যে। ভূমিকার উপসংহারে তিনি বলেছেন, ‘দেশভাগের প্রতিদিনের বাস্তবতা, তার আতঙ্ক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ছাপিয়ে আমাদের আজকের চেতনা আর অবচেতনায় সমানভাবে হানা দেয়। সমকালে রামুতে পোড়া মন্দিরের ছাইয়ের মধ্যে স্মিত হাসির বুদ্ধ, গুজরাটের দাঙ্গা, পাকিস্তানের শিয়া মহল্লায় নির্বিচারে আগুন বা খ্রিষ্টানদের প্রার্থনার সময় নির্বিচার গুলিবর্ষণ মান্টোকে বারবার ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তিনি আজ সহজে কোনো শরীর খুঁজে পান না, যে শরীর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার সাহস রাখবে।’

কালো সীমানা
কালো সীমানা

মান্টো সম্পর্কে এর চেয়ে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য আর কী হতে পারে!

আমরা জাভেদ হুসেনের কাছ থেকে কালো সীমানার মতো আরও অভাবিত অনুবাদ-কর্ম চাই।

কালো সীমানা
সাদত হাসান মান্টো
উর্দু থেকে ভাষান্তর: জাভেদ হুসেন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৯
পৃষ্ঠা ৭৮, দাম: ১৮০ টাকা।