আজও 'গোয়ের্নিকা'

১৯৩৭ সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্যারিসে পাবলো পিকাসো আঁকতে শুরু করেন তাঁর জগৎখ্যাত চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’
১৯৩৭ সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্যারিসে পাবলো পিকাসো আঁকতে শুরু করেন তাঁর জগৎখ্যাত চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’
>

১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল স্পেনের স্বৈরাচার ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর অনুরোধে জার্মানি ও ইতালি যৌথভাবে আক্রমণ চালায় স্পেনের প্রত্যন্ত গের্নিকা গ্রামে। আজ সেই গের্নিকা আক্রমণের ৮২তম বার্ষিকী। নিজের স্বদেশিদের ওপর নিষ্ঠুর এই আক্রমণের পরপরই পাবলো পিকাসো এঁকেছিলেন জগৎখ্যাত একটি ছবি—‘গোয়ের্নিকা’। কী আছে যুদ্ধবিরোধী এই চিত্রকলায়? ‘গোয়ের্নিকা’র দিকে আরেকবার ফিরে তাকিয়ে জানা যাক সেসব।

শিল্পের কি ভূমিকা আছে জীবন কিংবা পৃথিবীকে বদলে দেওয়ায়? নাকি সে অবসরের শৌখিন অনুষঙ্গ মাত্র? উত্তর জটিল বটে। আদিম মানুষ একদা এঁকেছিল আলতামিরা গুহায়। আর সেই গুহাচিত্রই আন্দোলিত করেছিল পাবলো পিকাসোকে। পিকাসো, যিনি তাঁর চিত্রকলা দিয়ে বিশ শতকে এসে শিল্পের যুগবদল ঘটিয়েছেন। বিস্ময়কর শিল্পী হিসেবে সাড়া জাগানো পিকাসোকে আত্মতুষ্ট ইউরোপের বাইরেও শিল্পের যে ঋদ্ধ দুনিয়া রয়েছে, তা আকৃষ্ট করেছিল।

স্বাভাবিকভাবেই চিত্রকলার ভূমিকা তাঁর কাছে আরও বেশি কিছু। তাই ‘গোয়ের্নিকা’ প্রসঙ্গে তিনি বলতে পারেন, ‘ঘর সাজানোর জন্য চিত্রকলা নয়, শত্রুর বিরুদ্ধে এবং নিজেকে রক্ষার অস্ত্র হলো চিত্রকলা।’ পিকাসো চেয়েছেন, ছবিকে ছুঁতে গেলে দর্শককে রক্তাক্ত যেন হতে হয়। যেন হাজার ব্লেড পোঁতা আছে ছবির জমিনে, কাছে গিয়ে ছুঁতে গেলেই আঙুলে রক্ত ঝরবে।

যদি তা না-ই হবে, তবে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল যেদিন বিশ্বের সামনে ইরাকের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে নামবেন, সেদিন কেন সেখানে ‘গোয়ের্নিকা’কে ঢেকে দেওয়া হবে? ‘গোয়ের্নিকা’র একটি ট্যাপেস্ট্রি সংস্করণ ছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রবেশপথে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ২০০৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একটি অযৌক্তিক যুদ্ধের যৌক্তিকতাই মিডিয়া মারফত পৃথিবীর সামনে ব্যাখ্যা করতে এসেছিলেন পাওয়েল। কেমন হতো, যদি যুদ্ধবিরোধী এই চিত্রকলার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন তিনি এটা করতেন?

কী এমন আছে এই ‘গোয়ের্নিকা’তে, যে যুদ্ধবাজকে তার বিষয়ে রয়ে-সয়ে চলতে হয়?

পিকাসো এঁকেছিলেন বিহ্বল হয়ে। তাঁর সঙ্গে সমস্ত ইউরোপও ছিল বিহ্বল। কারণ, এমন পরিকল্পিতভাবে বেসামরিক মানুষের ওপর গণহত্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের পরীক্ষা তারা এর আগে দেখেনি।

১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল। উত্তর স্পেনের বাস্ক প্রদেশের শান্ত গের্নিকা গ্রামে সেদিন ছিল সোমবার, হাটের দিন। স্পেনের প্রাচীন সভ্যতার গর্ব এই গ্রাম। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষের আনাগোনায় বিকেলটা সরগরম। এমন সময়ে তাদের ওপর শুরু হলো বোমাবর্ষণ। প্রথম দফার পর একটু বিরতি পড়ল। এ সময় বাঁচার জন্য যারা আশপাশে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিল, হামলা থেমে গেছে ভেবে আহতদের বাঁচাতে বেরিয়ে এল তারা। তখনই তাদের ওপর শুরু হলো কার্পেট বম্বিং। চলল টানা তিন ঘণ্টা। মারা গিয়েছিল দু শ থেকে আড়াই শ মানুষ। কেউ বলে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। বেশির ভাগই ছিল নারী, শিশু আর নিরস্ত্র মানুষ। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গের্নিকার ঐতিহ্যবাহী বসতিগুলো।

তখন আজকের মতো অহরহ মৃত্যু ছিল না। যুদ্ধাস্ত্রও ছিল না এতটা আধুনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় এই মৃত্যুগুলো অ্যাডলফ হিটলারের জেনারেল উপহার দিতে চেয়েছিলেন ২০ এপ্রিল হিটলারেরই জন্মদিনে। তবে প্রস্তুতির কিছু গড়বড় হওয়ায় উপহারটা দিতে ছয় দিন দেরি হয়ে যায়। বিশ্বযুদ্ধের মহড়া হিসেবে নাজিদের বোমারু বিমানের ক্ষমতা পরীক্ষার জন্যই ঘটল এই হত্যাযজ্ঞ। স্পেনে সে সময় চলছিল গৃহযুদ্ধ। আর স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর অনুরোধ করেছিলেন স্বদেশিদের ওপর আক্রমণটা চালানোর জন্য।

টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক জন স্টিয়ার দুদিন পর পৌঁছালেন গের্নিকায়। তাঁর প্রত্যক্ষ বিবরণ টাইমস-এর বরাতে অন্য পত্রিকায় দেখলেন স্পেনে জন্ম নেওয়া পিকাসো। দিনটা ছিল পয়লা মে। সে সময় তাঁর বয়স ৫৫ বছর। এর আগে জানুয়ারি থেকেই স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকারের হয়ে একটি ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা ঠিক এগোচ্ছিল না পিকাসীয় গতিতে।

কিন্তু আক্রান্ত স্বদেশের খবরটা শিল্পীকে যেন কাঁপিয়ে দিল। ১১ মে ১৯৩৭। বিশাল ক্যানভাসে কাজ শুরু করলেন পিকাসো। কিউবিস্ট রীতিতে মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ২৫ দশমিক ৬ ফুট প্রস্থ ও ১১ দশমিক ৫ ফুট দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তেলরঙের ম্যুরালটি শেষ করলেন তিনি।

এই ‘গোয়ের্নিকা’ কোনো সুখকর চিত্র নয়। জগতের সমস্ত আনন্দের রং শুষে নিয়ে কেউ এখানে ফেলে গেছে শুধুই কালো, ধূসর আর সাদা। নিষ্প্রাণ শিশুকে কোলে নিয়ে হাহাকার করছে মা। তার সুচালো জিহ্বায় আর্তনাদের ধার যেন গায়ে এসে লাগে। আছে একাধিক নারী, প্রত্যেকেই ক্লিষ্ট। কেউ যুদ্ধে গলে যাওয়া পা টেনে যেন ছুটে চলেছে, কেউ অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে প্রদীপ ধরে আছে। উদ্‌ভ্রান্ত ঘোড়া, সৈনিকের বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বিখণ্ডিত হাতে ধরা তলোয়ার মাটিতে পড়ে আছে, পাশেই ছোট্ট একটা ফুল। একটা ভীষণ ষাঁড়। একটা মুরগি। কোনো কিছুই স্বস্তি আনে না, কোনো আরাম কিংবা শান্তি নেই এখানে। কেবল মৃত্যু, ভেঙে পড়া, তীক্ষ্ণ হাহাকার।

 ‘গোয়ের্নিকা’ ভিন্নরকম যুদ্ধের চিত্র। স্পেনের ফ্রান্সিসকো গয়্যা এর আগে এঁকেছিলেন যুদ্ধের ছবি। এবার আঁকলেন পিকাসো। তাঁদের পূর্ববর্তীদের ছবিতে দেখতে পাই, যুদ্ধ শৌর্যের, বীরের ও কীর্তির। পেশিবহুল দেবতাদের মতো সৈন্যরা সেখানে তলোয়ার উঁচিয়ে শক্তির বিজয় ঘোষণা করছে। সেই ছবিগুলো যুদ্ধের উদ্‌যাপনের।

কিন্তু এটা যুদ্ধের উদ্‌যাপনের ছবি নয়। মানুষ যুদ্ধে জেতে না কখনো, কেবলই হারায়—‘গোয়ের্নিকা’ সেই কথাই বলে। তাই মা ও শিশুর চিরায়ত শান্তির প্রতীক এখানে তীক্ষ্ণ বিলাপরত। এ ছবিতে পিকাসো একবার লাল রং ব্যবহার করেছিলেন। পরে তা মুছে ফেলেন। রঙের সমস্ত নাটকীয়তা বর্জন করে সৃষ্টি করলেন সাদা-কালোর নিরেট বুক ভারী করা দুঃসহ এক জগৎ। যেন নিরাবেগ ভঙ্গিতে সাদা-কালোয় কেবল ঘটনাকেই বিবৃত করছে সে।

সবার তেমন না-ও লাগতে পারে। তাই ‘গোয়ের্নিকা’ বিষয়ে পিকাসোর কাছে নির্দিষ্ট করে জানতে চেয়েছেন অনেকেই। তিনি বলেননি। কারণ, তা বলা যায় না। তারপরও নাছোড়বান্দা অনেকে ছাড়েনি তাঁকে। শেষে অতিষ্ঠ পিকাসো বলেছেন, ‘এই ষাঁড়টা হলো একটা ষাঁড় আর এই ঘোড়াটা হলো একটা ঘোড়া। তারা যা, ঠিক তার জন্যই আমি তাদেরকে এঁকেছি।’ তবে বারবারই তিনি বলতে চেয়েছেন, অনুভব করার কথা, মানুষ হিসেবে যেটা জরুরি। বলেছেন, কেউ তো খোঁজে না পাখির গান কেন সুন্দর, ফুলটা কেন সুন্দর? তবে কেন চিত্রকলার ক্ষেত্রেই এমন ‘কারণ’ সন্ধানে নামতে হবে? শিল্পী তো নিজেও জানেন না কেন তিনি এমন আঁকলেন? তিনি কেবল জানেন, ‘যা ভেবে শুরু করেন, শেষ হওয়ার পর ছবিটা আর তা থাকে না, তা বদলে যায়।’

তাঁর ভাষ্যে, ‘চিত্রকলা হলো একজন অন্ধ মানুষের কাজ। যা দেখে তা সে আঁকে না, তা-ই আঁকে যা সে অনুভব করে।’ আর এর অর্থ, ‘প্রতিবার দেখার সঙ্গে সঙ্গে বদলেও যায়।’

‘গোয়ের্নিকা’ আঁকার ৩০ বছর আগেই পিকাসো থিতু হয়েছেন প্যারিসে। নির্বাচিত প্রজাতন্ত্রী সরকারকে পরাস্ত করে স্পেনে সে সময় চলছে ফ্রাঙ্কোর দুঃশাসন। প্যারিসে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য সেখানকার স্প্যানিশ দূতাবাস পিকাসোকে ১৯৩৭ সালের জানুয়ারিতে একটি ম্যুরাল আঁকার দায়িত্ব দিয়েছিল। ফ্রান্সের ওই প্রদর্শনী ছাড়াও পরে ‘গোয়ের্নিকা’কে স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ইংল্যান্ডে প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় যুদ্ধবিরোধী প্রচারণার জন্য। সারা পৃথিবীর কাছে এই চিত্র হয়ে ওঠে স্পেনে চলমান গৃহযুদ্ধের একটি বার্তা। শেষমেশ নিউইয়র্কের মডার্ন মিউজিয়াম অব আর্ট-এ ‘গোয়ের্নিকা’র ঠাঁই হয় বিয়াল্লিশ বছরের জন্য। পিকাসোর শর্ত ছিল, গণতন্ত্র না ফেরা পর্যন্ত ‘গোয়ের্নিকা’ও ফিরবে না স্পেনে।

৮ এপ্রিল ১৯৭৩-এ পিকাসোর মৃত্যুর দুই বছর পর মৃত্যু হলো ফ্রাঙ্কোর। আর ‘গোয়ের্নিকা’ বাড়ি ফিরল ১৯৮১-তে। মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া জাদুঘরে রাখা আছে ছবিটি।

কিংবদন্তি ‘গোয়ের্নিকা’ নিয়ে অনেক গল্পই প্রচলিত। যেমন এক গেস্টাপো সৈনিক, প্যারিসে যে পিকাসোর স্টুডিওতে আসে। সেখানে দেয়ালে ‘গোয়ের্নিকা’র একটা মিনিয়েচার ছিল, যুদ্ধের হৃদয়হীনতার সেই চিত্র দেখে সে পিকাসোকে বলে, ‘এটা তোমার কাজ?’ তিনি বললেন, ‘না, তোমার।’

এক সাক্ষাৎকারে পিকাসো বলেছিলেন, ছোটবেলায় একবার নতুন ডরমিটরিতে ওঠার পর তাঁর খুব মন খারাপ লাগছিল। বিষণ্ন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাক থেকে নামালেন একটা বই। পড়ার জন্য তা খুলতেই এর মধ্য থেকে বেরিয়ে এল বিশ্রী একটা পোকা। আঁতকে উঠে তিনি দূরে বই ছুড়ে দিয়ে নিজের মাথাটা লুকিয়ে ফেললেন বিছানার চাদরের নিচে। ‘গোয়ের্নিকা’ প্রসঙ্গে হয়তো এমনই কোনো অনুভব কাজ করেছে। তিনি এ-ও বলেছিলেন, অনেকেই ঈর্ষা করে তাঁর ছবি বিক্রি হয় বলে। ‘যদি তারা জানত, আমার ছবি আঁকার সত্যিকার দামটা কী, তারা কেউই তা শুধতে চাইত না।’ কেননা, প্রতিটি ছবিই যে তাঁর ‘এক শিশি রক্ত’!

সেই রক্ত দিয়ে লেখা যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ইশতেহার ‘গোয়ের্নিকা’র অর্থ আসলে আজকের সময়ে আরও নতুন কিছু। ‘কে নিখুঁতভাবে মানুষের মুখ দেখে: একজন আলোকচিত্রী, আয়না নাকি চিত্রশিল্পী?’ পিকাসো জিজ্ঞেস করেন। বলেন, আত্মায় প্রতিদিন যে ক্লেদ জমা হয়, শিল্পের কাজ তা ধুয়ে পরিষ্কার করা। এটাও বলেন, তোমাকে রক্তাক্ত করাই শিল্পের কাজ।

কী দেখি আমরা ‘গোয়ের্নিকা’র দিকে তাকালে? এমনকি কিছুই না দেখাটাও একটা দেখা। সেটাও সেই ছবির অনেক অর্থের মধ্যে একটা। পিকাসো যে স্বপ্নে ‘গোয়ের্নিকা’ এঁকেছিলেন, তা পূর্ণ হয়নি; বরং সেই বীভৎসতা আরও বেড়েছে। হিটলারদের জন্মদিনের খায়েশি উপহার প্রতিদিন চুকিয়ে চলেছে পৃথিবীর মানুষ। সেই অর্থে, বৃহত্তম ‘গোয়ের্নিকা’র জগতেই এখন আটকা পড়ে আছি আমরা।

সূত্র: পিকাসো: গোয়ের্নিকা, রাসেল মার্টিনের পিকাসোজ ওয়ার, পাবলোপিকাসোডটওআরজি, বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, নিউইয়র্ক টাইমস, ওপেনকালচারডটকম, গ্যালেরিয়ামেয়োরালডটকম