যারা চলে যায়, যারা বেঁচে থাকে

কন্যা পূর্বার স্মৃতিভার সারা জীবন বয়ে বেড়াবেন কবি শিহাব সরকার। গত ৯ এপ্রিল অকস্মাৎ মারা যান তাঁর মেয়ে পূর্বা। ছবি: সংগৃহীত
কন্যা পূর্বার স্মৃতিভার সারা জীবন বয়ে বেড়াবেন কবি শিহাব সরকার। গত ৯ এপ্রিল অকস্মাৎ মারা যান তাঁর মেয়ে পূর্বা। ছবি: সংগৃহীত

প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক বুঝি আর নেই। সোজা বাংলায়, কোনো কোনো মৃত্যু মানুষকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। কাছের মানুষ চলে যাওয়ার পর যে শূন্যতা চেপে ধরে, তার ভার স্বাভাবিকভাবে বহন করার শক্তি কম মানুষেরই আছে। রবীন্দ্রনাথের ছিল, নজরুলের ব্যাপারটা অস্পষ্ট। জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর জন্য লালন করেছেন একধরনের মর্বিড ও রোমান্টিক ভালোবাসা। কিন্তু তিনজনের কেউই মৃত্যুর জন্য স্বাভাবিক টান অনুভব করেননি। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে বলেছিলেন, ‘তুঁহু মম শ্যাম সমান’। এটি জীবনানন্দের নিজস্ব ধরনের মৃত্যুপ্রেমের আরেকটি প্রকাশ। বাস্তবজীবনে রবীন্দ্রনাথও মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারেননি।

মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রিয় সন্তান শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কেউ বুঝতে পারেনি। সারা দিন কাটিয়েছেন স্বাভাবিক ব্যস্ততায়। শোনা যায়, জোড়াসাঁকোর বাড়ির কেউ কেউ গভীর রাতে কবিকে আবিষ্কার করেন ছাদের এক কোনায়। প্রাণপ্রিয় পুত্র শমীর প্যান্ট বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিনি। যক্ষ্মায় কন্যা মাধুরীলতার মৃত্যুর পরও রবীন্দ্রনাথ ভেতরে-ভেতরে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। কাউকে বুঝতে দেননি। এ সময় তিনি অসাধারণ কিছু গদ্য রচনা করেন। সেসবে কন্যার মৃত্যু নিয়ে হাহাকার আছে, কিন্তু আবেগের আতিশয্য নেই। তাঁর ব্যক্তিগত শোক এবং বিষাদে যোগ করেছেন সর্বজনীনতা। এ সময় কবির বিভিন্ন লেখায় মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা এক মাত্রা পায়। সন্তানের মৃত্যুর পর এ রকম সংযম এবং দার্শনিক উপলব্ধি খুব কম বিখ্যাত মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এঁদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধের সমরনায়ক এবং দেশটির ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। প্রিয় দুই বালক-সন্তান এডওয়ার্ড বেকার (৪) ও উইলিয়াম ওয়ালাসের (১১) অকালমৃত্যুর পর লিংকন মানসিক শান্তির জন্য বাইবেলের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করেন। শোনা যায়, ওয়ালাস চলে যাওয়ার পর তিনি তাঁর একান্ত সচিবকে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর ওকেও নিয়ে গেলেন!’

মানুষ যখন জন্মায়, তখন থেকেই তার নিয়তি-নির্ধারিত আয়ু থেকে তার বেঁচে থাকার বিয়োজন ঘটতে থাকে। এক অর্থে মানুষের আয়ু বাড়ে না, বরং কমতে থাকে প্রতি লহমায়। নিয়তিবাদবিরোধীরা অবশ্য এটা মানে না। তাদের কাছে জন্মগ্রহণ একটি আকস্মিক ঘটনা। মৃত্যুও তা–ই। এরপরও মৃত্যুকে ধ্রুব বলে মানতে হয়। প্রিয়জনের মৃত্যু মানুষকে শোকের চাপে কিছুকালের জন্য অচল করে দেয়। কেউ কেউ আজীবনের জন্য সংসারবিবাগি হয়ে যান। আবার বড় মানুষেরা মৃত্যুর ভেতর খুঁজে পান দার্শনিক দ্যুতি। জীবন নতুন এক দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয় তাঁদের সম্মুখে। জড় বস্তু এবং পশুপাখির লয় ঘটে। মানুষের মৃত্যু সে রকম নয়। সৃষ্টির সেরা জীব, মানুষের মৃত্যু রহস্যঘেরা। মৃত্যুর প্রহেলিকার রহস্যভেদ খুঁজতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাচীনকালে গুহাবাসী হয়েছে, বনে-বাদাড়ে এবং তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছে। যথার্থ উত্তর পায়নি। বিজ্ঞানীরা বলেন, বস্তুর ক্ষয়ের মতো মানুষও লয়প্রাপ্ত হয়। কিন্তু ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যু অথবা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কী ব্যাখ্যা। তখনই এসে যায় অতিবাস্তবতা, পারলৌকিক সত্য এবং আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গসমূহ। বিজ্ঞান এখানে নিশ্চুপ।

তাহলে মৃত্যুবিষয়ক সত্য কোনটি? কোনো কোনো আদিবাসী সমাজে মৃত্যু উৎসবের মতো। তাদের কাছে মৃত্যু পঙ্কিল এবং সদাবৈরী পৃথিবী থেকে চিরমুক্তি। এসব সমাজ নানা উৎসবের ভেতর দিয়ে মৃত্যুকে উদ্​যাপন করে মৃত ব্যক্তিকে বিদায় জানায়। প্রাচীন মিসরে, দক্ষিণ আমেরিকার মায়া ও ইনকা সমাজে পরকালে সুখী ও স্বচ্ছন্দ জীবন কাটানোর জন্য মমিকৃত মৃতের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হতো সব ধরনের প্রয়োজনীয় উপকরণ। আব্রাহামীয় ধর্ম—ইহুদিবাদ, খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম এবং প্রাচীন পারস্যের জরাথুস্ট্রীয় বিশ্বাসে মৃত্যু এবং পরবর্তী জীবনের নতুন ব্যাখ্যা দেখি। বৈদিক যুগ এবং এর পরের বৌদ্ধ সমাজে মৃত্যুবিশ্বাস এবং এ–সম্পর্কিত পারলৌকিক আচারাদি ভিন্ন ছিল বহু আগে থেকে। মূলকথা, বিশ্বাসীর কাছে মৃত্যু এবং এর পারলৌকিক মর্ম সব বিতর্কের ঊর্ধে।

এরপরও বলতে হয়, মৃত্যুশোক সবশেষে একান্তই একজন মানুষের নিজস্ব মর্মদাহ। কন্যা পূর্বার স্মৃতিভার আমি বয়ে যাব সারা জীবন আমার নিজস্ব ধরনে। আইসিইউতে মেয়েকে রাত বারোটায় দেখতে গেলাম। ওর মুখটা ফোলা ফোলা। আমি বললাম, ‘মা চিন্তা নেই। সব ভালো।’ মেয়ে বলল, ‘ বাবা, আমি কি বাঁচব?’ বলে কী মামণি! দ্রুত বেরিয়ে এসে চোখ মুছলাম। রাত একটায় মেয়ে নেই।

যে মানুষটি চলে গেছে, তার কত না ছোট–বড়, খুঁটিনাটি স্মৃতি জীবিতকে তাড়িয়ে ফেরে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অজস্র অমর গান আছে মৃত্যু নিয়ে। আছে শেক্​সপিয়ারের নাটকের সংলাপ। এগুলো বাঁচার প্রেরণা জোগায় আমাদের।