ষাটের লাজুক নক্ষত্র

হায়াৎ সাইফ (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪২—১২ মে ২০১৯)
হায়াৎ সাইফ (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪২—১২ মে ২০১৯)

গত দুই দশকে সাহিত্য ও অন্যান্য পুরস্কার যখন একটি সন্দেহজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তখন গত বছর ৭৬ বছর বয়সে কবি হায়াৎ সাইফ একুশে পুরস্কার পেলেন। এটি ছিল স্বস্তির একটি বিষয়, কেননা অনেকেই ভাবতেন অনেক অনেক আগেই তাঁকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। তবে এই ভেবে তাঁরা সান্ত্বনা পেতে পারতেন যে কাজী নজরুল ইসলাম ৭৭ বছর বয়সে, কবি জসীমউদ্‌দীন ৭৩ বছর বয়সে ও কবি সুফিয়া কামাল ৬৫ বছর বয়সে একুশে পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু বিড়ম্বনাময় বাস্তব তো এই যে তাঁর সতীর্থ ও অনুজেরা অনেক আগেই পুরস্কারে ভূষিত হয়ে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিলেন।

হায়াৎ সাইফ ষাটের দশকের প্রধান একজন কবি, অথচ তাঁর তেমন পরিচিতি ছিল না। এ জন্য দায়ী তিনি নিজেই! বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে বিখ্যাত হওয়ার খাতিরে বহুলপ্রজ হতে হয়। পত্রপত্রিকার সংখ্যা প্রচুর; এগুলোতে নিয়মিত প্রকাশ করতে হয়। তিনি কবি যশোপ্রার্থী ছিলেন না। শুক্রবারের সাময়িকী বা ঈদসংখ্যায় প্রকাশের জন্য কোনো দিন ব্যগ্রতা প্রকাশ করেননি। যা লিখেছেন বা প্রকাশ করেছেন, তা প্রচারে একবিন্দু মনোযোগ দেননি। ফলে বাংলা একাডেমির মহাজনেরা তাঁর কবিতা বিবেচনা করার তাগিদ বোধ করেননি। তাজ্জব হয়ে অনেকে বলেছেন, হায়াৎ সাইফই সাম্প্রতিক কালের একমাত্র কবি, যিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারের পইঠায়
পা না রেখেই একুশে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন

হায়াৎ সাইফ সম্পর্কে বলা যায় তিনি সেই কবি, যাঁর ‘হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’ ছিল। উচ্চপদস্থ চৌকস আমলার সর্বগুণে গুণান্বিত হায়াৎ সাইফ (সাইফুল ইসলাম খান) ব্যস্ত দাপ্তরিক জীবনের শেষে ঘরে ফিরে আত্মস্থ হয়ে নিজের সঙ্গে কথোপকথনে মগ্ন হয়েছেন; জগৎ ও আত্মার ক্রন্দনসংগীত কলমে ধারণ করেছেন; স্বীয় উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাকে কল্পনায় জারিত ও চিন্তায় পরিশ্রুত করে শব্দ-পদে ধ্বনিতে সাজিয়ে তুলেছেন; কবিতাকে হাতকড়া দিয়ে কাগজে নামিয়েছেন—কখনো প্রকাশ করেছেন, কখনো করেননি।

উচ্চাকাঙ্ক্ষাবিহীন হায়াৎ সাইফ নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন:

‘আমার তো কোনো নিগূঢ় ইচ্ছে নেই

উৎকাঙ্ক্ষাও ধরিনি বুকের তলে,

আশা ছিল শুধু ঈর্ষা ও ক্রোধহীন

একটু সময় যেন স্বাধিকারে চলে।’

এই কবির জমা-খরচের খাতায় অজস্র স্মরণীয় পঙ্‌ক্তিমালা রয়েছে, যা না হয়েছে পঠিত, না হয়েছে আলোচিত। তবে সুপুরুষ হায়াৎ সাইফ যখনই সুকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেছেন, তখনই ধ্বনি-ব্যঞ্জনায় একটি আসর জমে উঠেছে। তাঁর কবিতা কেবল পড়ারই নয়, শোনারও বটে। এর মধ্যে শব্দ ও ছন্দের সমন্বয়ে এমন একটি সুর বহমান, যা সঠিক আবৃত্তিতে ধ্রুপদি সংগীতের মতোই শ্রুতিমধুর হয়ে বিভাসিত হয়। সাংগেতিকতা হায়াৎ সাইফের কবিতার অন্যতম কূললক্ষণ।

একদা বলেছিলেন, ‘কথা কখন কী করে কবিতা হয়ে ওঠে বলা কঠিন।...একমাত্র কবিতার ভাষাতেই সেই যাদুর সৃষ্টি হয়, যা আমাদেরকে ভাষার স্বাভাবিক প্রয়োজন ও প্রয়োজনীয়তার অতিরিক্ত একটা অনন্যের অনুসন্ধান দিতে পারে। তার প্রতীকে, চিত্রকল্পে, ধ্বনিতে ও ব্যঞ্জনায় একটা নতুন কিছু আবিষ্কৃত হয়।’ কবিজীবনের শুরু থেকেই তিনি এই দুরূহ শর্তগুলো পূরণ করে কবিতা সৃষ্টি করে গেছেন:

 ‘...আমার সমগ্র জাগরণ ও নিদ্রা স্বপ্ন

          ও চেতনা স্থৈর্য ও চঞ্চলতা

যেন কেন্দ্রীভূত একটি চৈতন্যের ভেতরে

           আবর্তিত হতে থাকে

 আন্দোলিত হতে থাকে

           নিঃশেষিত হতে থাকে

পাপের জন্যে নয় পুণ্যের জন্যে নয়

জীবনের জন্যে নয় মৃত্যুর জন্যে নয়

বিলাসের জন্যে নয় কৃচ্ছ্রতার জন্যে নয় প্রকৃতির জন্যে নয়

পুরুষের জন্যে নয়

কেবলমাত্র চলমানতার জন্যে

আমার ভেতরে নদী

          বাহিরেও নদীর উপমা।’

হায়াৎ সাইফের কাব্যে কখনো কখনো সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অকপট উত্তরাধিকার পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু কাব্যবোধ, রূপবন্ধ, শব্দব্যবহার ও বাগভঙ্গিতে তিনি ছিলেন মৌলিক, স্বকীয়। হায়াৎ সাইফের বিপন্ন পৃথিবী আত্মসংকটের তীব্রতায় কম্প্রমান।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। ১২ মে ২০১৯ দিবাগত মধ্যরাতে প্রয়াণ হলো। বাংলাদেশের কবিতার আকাশ থেকে বিদায় নিল ষাট দশকের একটি লাজুক নক্ষত্র। কিন্তু তাঁর কবিতা বেঁচে থেকে জীবন ও মৃত্যু, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দোলাচলে সদা কম্প্রমান আধুনিক মানবচিত্তে আলোড়ন তুলে যাবে।