মার্কেটের টানে

ছুটির সঙ্গে ছোটাছুটির যোগ আছে। জগতে নানা কিসিমের ছুটি রয়েছে। একেক কিসিমের ছুটিতে একেক কিসিমের ছোটাছুটি হয়। ছুটিটা যদি ঈদের হয় তাহলে সেই ছোটাছুটিতে দুটি পর্ব থাকে। এক পর্বের ছোটাছুটি হয় নাড়ির টানে ওরফে বাড়ি টানে, আরেক পর্বের ছোটাছুটি হয় মার্কেটের টানে।

নাড়ির টান পর্বে বাস–ট্রেনের টিকিট ঘরে বিরাট লাইন পড়ে। ঈদের আগমুহূর্তে রাস্তা থেকে নদী, নদী থেকে আকাশ—সবখানে জ্যাম লাগে। মৌচাকে ধোঁয়ার মশাল ঠেকানোর পর মৌমাছি যেভাবে দিগ্​বিদিক ছোটাছুটি করে, তেমনি ঈদের আগে ‘মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে’ সব নাড়ির টানে বাড়ির পানে ছুটতে থাকে।

ঘরমুখো ছোটাছুটির আগে মার্কেটের টানে যে ছুট দেওয়া হয়, সেটিই আসলে আসল ছোটাছুটি। এই ছোটাছুটিকে কেউ বলে ‘কেনাকাটা’, কেউ বলে ‘শপিং’।

অন্য কাজের ব্যস্ততা যতই থাক, ঈদের বাজারে নীলক্ষেত টু খিলক্ষেত চষে বেড়ানোই সবার এই সময়ের প্রধান কাজ। দিনভর বিভিন্ন মার্কেটে ঢুকে ‘গুটিকখানিক’ বুটিক ওলট–পালট করে সন্ধ্যার আগে সব মিলিয়ে একটামাত্র থ্রি–পিস কিনে বাড়ি ফেরা ‘আপারা’ এই সময় সবচেয়ে বেশি ছোটাছুটির আনন্দ উপভোগ করেন। ওদিকে ‘ভাই’য়েরাও কম যান না। কেনাকাটায় তারাও ওস্তাদ। রাস্তা থেকে শপিংমল—সবখানে এখন শপিংয়ের পাশাপাশি চলছে কাচের মধ্য দিয়ে দেখে না কিনে ঘরে ফেরা, ইংরেজিতে ভদ্রলোকেরা যাকে বলেন ‘উইন্ডো শপিং’।

ঈদের দু–তিন দিন আগে থেকেই ‘কী পেলি?’ , ‘কী নিলি?’ , ‘কী দিলি?’—এই সব শর্ট কোয়েশ্চেন শুরু হয়ে যাবে। জবাবটা যত দূর মোক্ষম করা যায়, সেই চেষ্টায় কেনাকাটার এই ছুটোছুটি। সেই ছুটোছুটির মধ্যে শুধু শাড়ি, থ্রি–পিস, জামা, প্যান্ট নিয়ে আলাপ হয় না, এসবের মধ্যে হাঁড়ি–পাতিলের দরদামও উঠে আসে। কান খাঁড়া রাখলে জামাকাপড়ের দোকানে বসেও কন্যা–জায়া–জননীর আলাপ থেকে দরদামসহ তাঁদের হাঁড়ির খবর পাওয়া যায়। শপিং আর হাতা-খুন্তির জলজ্যান্ত গপ্প—সব মেলে সেখানে। তাদের সেই আলাপে পরিবার,
স্বজন ও বন্ধুত্বের ইকুয়েশনগুলো সম্পর্কে বিনা পয়সায় একটা ধারণাও পাওয়া যায়:

‘ননদ আর বোনকে কি এক বাজেটে আনা যায় বল?’

‘জানেন আপা, আমার কাজের মেয়েটাকেও এ বছর পাখি ড্রেস দেব ভাবছি।’

‘দূর আপা! পাখি ড্রেস তো পুরোনো হয়ে গেছে, বাহুবলী টু–ও এখন ব্যাকডেটেড! এখন চলছে শারারা আর জারারা ড্রেস।’

‘আলমারিতে এতগুলো কাতান থাকার পরও খালি কাতান কাতান করো!’

‘দ্যাখ না সাদাটা মানাবে তো আমাকে?’

‘আচ্ছা নানুর জন্য কোন শাড়িটা নেব বল তো ঝুমু?’

— ওপরের সংলাপগুলোর মতো এই রকমের কত কথা কানে আসে এই সময়ে।

আসলে খাটেরতলা থেকে আগরতলা, মাদারটেক থেকে হাইটেক—আমরা যতই এগোই না কেন, ভাঁড়ার ঘরের চাবি আর ঈদের বাজারের ছড়ি—এ দুটো গিন্নিকুল হাতছাড়া করবেন না। সে তিনি রোজগেরেই হোন বা ফুলটাইম গৃহবধূই হোন।

ঈদবাজারে কিছু পুরুষকেও পাওয়া যাবে যাঁরা শপিংয়ে আগ্রহী, কিন্তু তাঁদের মতামতও শপিং ম্যানিয়াক নারীকুলের দাপটে শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না। এ রকমই বোধ হয় ‘গ্লোবাল পরিবার’।

অতি আমোদের কথা, সুশীল মধ্যবিত্তের জীবনে এখন যোগ হয়েছে অনলাইন শপিং। ঈদের বাজারে সময় বাঁচাতে সেখান থেকে আঙুলের ডগার খোঁচায় শপিং করা যাচ্ছে। তবে অনলাইনেও ‘বে–লাইন’ আছে। সেই ‘বে–লাইন’ থেকে মাল কিনলে নির্ঘাত ধরা খেতে হয়।

শপিংমল আর ‘অনলাইনমল’–এর বাইরে আছে ‘ফুটপাতমল’। এই ফুটপাতমলকে প্রতিনিয়ত শপিংমলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে টিকে থাকতে হয়। ঘড়ি থেকে টি-শার্ট, জুতো থেকে রোদচশমা, শাড়ি থেকে ইমিটিশনের গয়না—সব মেলে সেখানে। সেখানে আরেক জীবন। সেখানে আরেক আনন্দ। লেখার এ পর্যন্ত এসে ইস্তফা দিতে হলো, কারণ, ‘হেড অফিস’–এর আদেশে আমাকেও যে এখন ছুটতে হবে মার্কেটে!