নাড়ির টানে নারীর টানে

চাচাতো ভাই দাউদের ফোন—ভাইয়া, ঈদে বাড়ি যাবেন?

আমি থম মেরে বসে থাকি, কোনো উত্তর দিতে পারি না। কয়েকটা ঈদ থেকেই আমার এমন দশা। ঈদে বাড়ি যাচ্ছি কি না কেউ জানতে চাইলেই, আমি লা জবাব।

এমনিতে ঢাকায় ঈদ কাটানোর চেয়ে দুরূহতম কিছু নেই—পরিচিতরা নিজ নিজ গ্রামে চলে যান, নাহলে চলে যান নেপাল-ভুটান। কেউ কেউ যান ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে; তবে তাঁরা আমার পরিচিত নন। আর যাঁরা ঢাকায় ঈদ করেন, যাঁরা আসলে ঢাকারই মানুষ, তাঁরাও আমার অপরিচিত। ফলে ঈদটা কাটে একান্তই নির্বান্ধব। বান্ধবহীন দুঃখ উদ্​যাপন করা যায়, উৎসব একেবারেই যায় না। ঈদে আমার ঢাকা মরুভূমি হয়ে যায়। নিজেকে কেবলই এক উটকো উট মনে হয়। মনে হয় হেথা নয় হেথা নয়…অন্য কোথা…!

তা অন্য কোথা তো আসলে গ্রাম! ঢাকায় কেউ কেউ যেটাকে দেশ বলে। আর আমরা বলি বাড়ি। ঢাকার এই বাড়ি-বাসার খেলাটাও মজার। কে যেন সেদিন বলছিল...মানুষ যেখানে শুধু রাত কাটায় সেটা বাসা; আর যেখানে বসবাস করতে চায় সেটা বাড়ি। হায়, আমাদের ঈদ আর আমাদের বাড়ি…তার ভেতরে কিলবিল করে টিকিটের লম্বা লাইন, ট্রেন-বাস-লঞ্চের নানা অব্যবস্থাপনা আর ভ্রমণ-স্মৃতির দুঃসহ কষ্ট। পণ্ডিতেরা বলেন, কষ্ট ছাড়া কি কেষ্ট মেলে? আমরা বলি রাধিকা হতে মন সায় তো দেয় না গুরুদেব। সারা বছর কষ্ট করেই তো থাকি এই শহরে, একবার বিদায় দে, কষ্ট ছাড়া ঘুরে আসি! ওরা বলে, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী!

তা ওই তরী (পড়ুন: লঞ্চ) হোক বা বাস বা ট্রেন—ঠাঁই যে থাকে না তা কে না জানে! মানুষ এবং মানুষ এবং শুধুই মানুষের মধ্যে যে যাত্রাটা আমরা করি তা নিতান্তই অমানুষের। ট্রেনে আমরা আমাদের ঘাড় রাখি অন্যের ভুঁড়িতে, পা রাখি অন্যের উরুতে—ভঙ্গি যা দাঁড়ায় তাতে যে কেউ মনে করতে পারে ভরতনাট্যম করছি! আর বাসে তো উঠি সুড়ঙ্গে ঢোকার সরঞ্জাম নিয়ে। কে জানে কখন কোন রাস্তায় কত দিনের জন্য আটকা পড়ি! বিস্কুট থেকে পাউরুটি, পানি থেকে পাওয়ার ব্যাংক—সব যদি ঠিকঠিক না থাকে তাহলে বড়ই বিপদ! প্রথম তিনটি না থাকলেও হয়তো টিকে থাকা যায়, কিন্তু মনে রাখবেন পাওয়ার ব্যাংক লাগবেই। ওটা না থাকলে মোবাইলে চার্জ থাকে না। আর চার্জ না থাকলে ফেসবুক কি থাকবে? চেকইন? তার কী হবে? চেকইন ছাড়া ঈদ-ভ্রমণ হতে পারে, আপনারাই বলুন?

ফেসবুকে কিন্তু অনেকেই লেখেন—‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা!’ কেউ কেউ একটু বেশি মজা করতে চান। নাড়ির জায়গায় লেখেন নারী। মানে নারীর টানেই নাকি বাড়ি ফেরা! আমাদের তাতে আপত্তি কী? যাঁরা যান নাড়ির টানে যান, নারীর টানেও তো যান। প্রেমিকা, স্ত্রী, কন্যার কথা যদি ছেড়েও দিই...মা তো থাকেন সেখানে! আর থাকে মায়ের মতো মায়াময় গ্রাম, নদী, ছায়াপথ। কয়েকবার তো এই টানে টিকিট কেটে একেবারে শেষ মুহূর্তেও বাসে চেপেছি। আট ঘণ্টার পথ ১৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে পৌঁছাতে পারিনি। কোন অজায়গায় শত শত বাস আর হাজার হাজার মানুষ নিয়ে সেলফি তুলে, প্রকৃতি তুলে, দুরবস্থা তুলে অনেককে অকারণ গালাগালি করেও কোনো সমাধান পাইনি।

তাই ভয় হয় খুব! না জানি ঈদে বাড়ি যেতে গিয়ে এবার কোন বিপদে পড়ি!

বন্ধুরা কেউ কেউ উড়োজাহাজে করে চলে যান। আমি জ্যামভেজা মহাসড়কে তাঁদের শাপশাপান্ত করি। বসে থাকতে থাকতে থাকতে পিঠ ধরে যায়, পেট কখনো খুলে যায় কখনো নেমে যায়। মনে হয়, ভ্রমণ এত বড় কেনে!

তবু আমরা যেতে চাই বাড়ি। ছুটি পেলেই ছুটে যেতে চাই। ক্লান্তিক্লিষ্ট শরীরে এলিয়ে পড়তে চাই নিজের পুরোনো ঘরে, পুরোনো বালিশ আর বিছানায়, পুরোনো ঘ্রাণের ভেতর। কিছু কল্পনা আর কিছু আধো-অন্ধকার বাস্তবতার ভেতর। মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য হলেও মনে হয় আমরা শ্বাস নিচ্ছি, মনে হয় বেঁচে আছি, কী বিস্ময়, আজও বেঁচে আছি!

দাউদ পিছু ছাড়ে না। ফোন করেই যায়—ভাইয়া, যাচ্ছেন না এবার? হ্যালো?

আমি টিকিটের লাইনে দাঁড়াই। বিস্তর ধাক্কাধাক্কি হয়, কেউ পান কেউ পান না। আমি পাই। আমার হৃৎপিণ্ড ছলকে ওঠে। যাচ্ছি তাহলে এবার? কিন্তু একটা লম্বা স্থবির অজগরের মতো মহাসড়ক আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।

একটা অসম্ভব দোটানায় ভরা ভ্রমণের জন্য আমি ব্যাগ গোছাতে থাকি—কিসের টানে, কে জানে!