অপস্রিয়মাণ সিনেমা হলের সংস্কৃতি ইনিয়ারিতুর কাছে একটা মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি

সদ্যসমাপ্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন মেক্সিকান চলচ্চিত্র পরিচালক আলেহান্দ্রো গনসালেস ইনিয়ারিতু। সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন নিউইয়র্ক টাইমসকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে। এখানে সমসাময়িক চলচ্চিত্রের সংকট নিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি বলেছেন এ শিল্পের নান্দনিকতা ও দর্শন নিয়েও। অস্কারের ইতিহাসে গত উনসত্তর বছরের মধ্যে ইনিয়ারিতুই প্রথম চলচ্চিত্রকার, যিনি পরপর দুবার সেরা নির্মাতার পুরস্কার জিতেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন সময়ে দ্য গার্ডিয়ান ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ নির্মাতার প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের সমন্বয়ে এই লেখা।
আলেহান্দ্রো গনসালেস ইনিয়ারিতু
আলেহান্দ্রো গনসালেস ইনিয়ারিতু

মাঝেমধ্যে কানে হেডফোন জুড়ে নিয়ে কম্পিউটারে সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন ইনিয়ারিতু। কিন্তু তিনি জানেন, ছবিটা তিনি ‘দেখছেন ঠিক-ই, কিন্তু অনুভব করছেন না’। একইভাবে গাড়িতে বসে স্পিকারে মোজার্ট শোনা আর ১২০ জন বাদকের সমবেত বাদনে মোজার্ট শোনার মধ্যে যে পার্থক্য, তাঁর মতে, সে অভিজ্ঞতার পার্থক্য একজন মানুষকে চিরকালের মতো রূপান্তরিত করে দিতে পারে। এই সূক্ষ্মদর্শী শিল্পী ইনিয়ারিতুর ঠিক ‘তিনি’ হয়ে ওঠার পেছনে সিনেমা হলে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা অনেকটা মাতৃজঠরের মতোই। তাই অপস্রিয়মাণ সিনেমা হলের সংস্কৃতি তাঁর কাছে একটা মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি।

পৃথিবীব্যাপী চলচ্চিত্রের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নবীন চলচ্চিত্রনির্মাতার জন্য প্রচলিত কোনো পথ কি আর অবশিষ্ট আছে? ইনিয়ারিতু বলেন, বাস্তব দুনিয়ার মতোই শিল্পের দুনিয়াও একই রকম উভয় সংকটে ভুগতে যাচ্ছে, যেখানে ৯৯ শতাংশ অতি দরিদ্র আর বাকি এক শতাংশ অতি ধনী। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও ওই ১ শতাংশ বিপুল বাজেটের ছবিগুলো ঠিকই হলগুলোতে প্রদর্শিত হবে, কিন্তু দুর্ভাগ্য বাকি ৯৯ শতাংশের, যেগুলোর হয়তো নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মে সরাসরি স্ট্রিমিং হবে, সিনেমা হলের ভাগ্য ঘটবে না। এটাকে দুর্ভাগ্য মানেন তিনি। এভাবে মানুষ তার সংস্কৃতির একটা বিশাল অংশ হারাচ্ছে।

তাঁর মতে, এ মুহূর্তে দুটো যুদ্ধ চলছে—‘একটা বিপুল অর্থনির্ভর শিল্প, যে ক্রমাগত বলছে, “তোমার ঘর থেকে বের হয়ো না, পৃথিবী একটা বিপৎসংকুল জায়গা, গোষ্ঠীগত বিশ্রী সব অভিজ্ঞতা। সিনেমা হলে যেয়ো না, রেস্টুরেন্ট, শপিং মলে যেয়ো না, তুমি তোমার ঘরের মধ্যে থাকো। পৃথিবীটাকে আমরা তোমার ঘরের মধ্যে এনে দিচ্ছি।” এই যুদ্ধের আরেকটা দিকে পুঁজিবাদ বলছে, “বেরিয়ে এসো তোমার ঘর ছেড়ে, অভিজ্ঞতা নাও—আর হ্যাঁ, টাকা খরচ করো।”’ ইনিয়ারিতুর দৃষ্টিতে আমাদের ওপর প্রথম যুদ্ধটা জয়ী হয়ে যাচ্ছে। কেননা, আমরা ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। আর এই আলোচনা সিনেমা আর এ–বিষয়ক রোমান্টিক ভাবনার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আরও অনেক বড় কিছু।

একজন নির্মাতা কি তাঁর ছবিকে যাপন করেন? ইনিয়ারিতুর কাছে, ‘প্রতিটি চলচ্চিত্রই আসলে নিজের একটা বর্ধিত অংশ।’ জীবন ও চলচ্চিত্রের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্পষ্ট রেখা থাকে, যা একসময় মিলিয়ে যেতে শুরু করে আর ছবিতে যা ঘটছে, সেটাই তীব্র বাস্তব হয়ে তাকে ঘিরে ধরতে থাকে।

এই কারণেই কোনো বানানো সেটে নয়, একেবারে শূন্যের ৪০ ডিগ্রি নিচের তাপমাত্রায় প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে যাওয়া পরিবেশে ইনিয়ারিতু দ্য রেভেনান্ট-এর শ্যুটিং করেছেন। কোনো কৃত্রিম আলো ছাড়াই দৃশ্যধারণ হয়েছে। কিন্তু দিনের সেই প্রাকৃতিক আলোও পাওয়া যেত মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। তাঁর দৃষ্টিতে, যত উন্নত প্রযুক্তির শরণ নেওয়া যাক না কেন, বাস্তবের আস্বাদ বাস্তবকে দিয়েই সবচেয়ে ভালো পাওয়া সম্ভব। এই দৃষ্টান্তে ইনিয়ারিতু কয়েক বছর আগে পেরুর ফুটপাতে তাঁর ভুট্টা খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। সেই ভুট্টা মুখে দিয়ে এক ঝটকায় মেক্সিকোতে তাঁর শৈশবে খাওয়া ভুট্টার কথা মনে পড়ে গেছে, চোখে প্রায় পানি চলে এসেছে। মেক্সিকোর সমুদ্রতীরে গিয়ে যখন তিনি আম খেয়েছেন, তাঁর মতে, প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন সেই আমের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের জেনেটিক্যালি মডিফায়েড আম একেবারে ‘স্বাদহীন’। অকৃত্রিমতা এ নির্মাতার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই তিনি মনে করেন, কম্পিউটারে বানানো ‘নকল’ দৃশ্যের চেয়ে বাস্তব দৃশ্যই ছবিকে প্রাণ দেয়।

এই কারণে তাঁর ছবিতে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও সত্যিকারের মহিষের যকৃৎ খেয়ে দেখিয়েছেন, বরফজলের নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন আর ইনিয়ারিতু সত্যিকারের একটি তুষারধসও তৈরি করেছেন ছবিকে বাস্তব করে তুলতে। ছবিতে দেখিয়েছেন, অর্থলোভী মানুষ কীভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, প্রাণী হত্যা করছে, আদি বাসিন্দাদের ঠকাচ্ছে। আবার বার্ডম্যান ছবিটি এমনভাবে নির্মিত, দেখে মনে হয় একটা মাত্র দীর্ঘ শটে পুরো ছবিটি ধারণ করা হয়েছে। ইনিয়ারিতু এভাবেই চেয়েছেন। কারণটি তিনি ব্যাখ্যাও করেন তাঁর ভাষায়, ‘আমরা আমাদের জীবনটা যাপন করি কোনো রকম সম্পাদনা ছাড়াই।’

চলচ্চিত্রনির্মাতা ভার্নার হার্টজগের আগুয়রে, দ্য রথ অব গড; আকিরা কুরোসাওয়ার দারসু উজালা; ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার অ্যাপোক্যালিপস নাউ ও তারকোভস্কির আন্দ্রেই রুবলভ-এর মতো ছবিগুলো তাঁকে প্রভাবিত করেছে। এর প্রতিটিতেই প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করে মানুষ।

১৯৬৩ সালের ১৫ আগস্ট মেক্সিকোয় জন্ম নিয়ে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত শহরে বেড়ে ওঠেন ইনিয়ারিতু। ১৭ বছর বয়সে স্কুল থেকে বিতাড়িত হন। তাঁর খারাপ কাজের মধ্যে ছিল চুরি আর বান্ধবীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। এই সব কর্মকাণ্ডের পেছনেও ছিল হেয়ার নামের সিনেমার প্রভাব। রাজকন্যার ধনী বাবা যথারীতি ইনিয়ারিতুকে কঠিন উত্তম-মধ্যম দেবেন বলে তাঁর বাবাকে হুমকি দিলেন। অশ্রুসজল কিশোর প্রেমিক ফোনে মেয়েটিকে ‘গুডবাই, আই লাভ ইউ’ বলে এ পর্ব শেষ করলেন। এর কিছুদিন পরই কার্গো নৌকায় কাজ নিয়ে মিসিসিপি এবং তারপর ইউরোপ ও আফ্রিকাতে গেলেন তিনি। নদী আর জলের সঙ্গে এই সময়ের সখ্য তাঁকে অবচেতনে কতটা প্রভাবিত করেছে, সেটা তিনি বুঝেছেন অনেক বছর পরে; যেদিন হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করেছেন তাঁর প্রতিটি ছবির শুটিং এমন সব জায়গায় করেছেন, যেখানে নৌকা যাওয়া–আসা করে আর এর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি, স্পেনের বার্সেলোনা, মরক্কো ইত্যাদি। এই সময় নিজেকে ইনিয়ারিতুর খুব বোকা মনে হচ্ছিল, কিন্তু এ-ও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘সৃষ্টিশীলতা কোনো যৌক্তিকতার জায়গা থেকে আসে না, বরং এ হলো অবচেতন, আর সচেতন হওয়াটাও উচিত নয়।’