আপাদমস্তক নাট্যনিমগ্ন মানুষ

মমতাজউদদীন আহমদ (১৮ জানুয়ারি ১৯৩৫—২ জুন ২০১৯)
মমতাজউদদীন আহমদ (১৮ জানুয়ারি ১৯৩৫—২ জুন ২০১৯)

সময়টা ২০০১ সালের অক্টোবর মাস। ৫ তারিখের রাত, ঘড়িতে ১০টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। নির্বাচন-উত্তর সহিংসতায় সারা দেশ বিপন্ন—জ্বলছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের বাড়িঘর, নির্যাতিত হচ্ছে নারী, রাজনীতি আর ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করছে মানুষ। এমন এক অন্ধকার সময়ে রাত ১০টায় বেজে উঠল আমার ল্যান্ড ফোন। খানিকটা আতঙ্ক নিয়েই তুলে নিলাম রিসিভার। তবে ‘হ্যালো’ বলার আগেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল: ‘আমি মমতাজউদদীন আহমদ। বিশ্বজিৎ, আমি যে খুব নিরাপদে আছি, তা নয়। তবু, আপনি যদি নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন, তাহলে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। শিপ্রাসহ দ্রুত আমার বাড়িতে চলে আসুন।’—এই আমার মমতাজ স্যার, আমাদের মমতাজউদদীন আহমদ, বাংলা নাট্যসাহিত্যের অসামান্য লেখক মমতাজউদদীন আহমদ।

২ জুন মমতাজউদদীন আহমদ চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ১৯৩৫ থেকে ২০১৯—একেবারে যে কম সময়, তা তো বলা যাবে না, তবু মনে হয় বড় অকালেই চলে গেলেন মমতাজ স্যার। এখনো তো তাঁর অনেক কাজ বাকি আছে, এখনো তো তাঁর আকাঙ্ক্ষিত মহানাটকটি লেখা হয়নি, এখনো তো রঙ্গমঞ্চে তাঁর সেরা অভিনয়টা হয়ে ওঠেনি। মমতাজউদদীন আহমদ—কত তাঁর পরিচয়—অধ্যাপক, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, মুক্তিযোদ্ধা—সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তবে বাংলাভাষী মানুষের কাছে তাঁর প্রথম ও শেষ পরিচয় নাট্যকার হিসেবেই। নাট্যকার পরিচয়ে নিজেকে মেলে ধরতে তাঁর আগ্রহেরও কোনো শেষ ছিল না।

মৌলিক ও রূপান্তর মিলিয়ে ২৫টা নাটক লিখেছেন মমতাজউদদীন আহমদ। এ ছাড়া আছে বেতার নাটক, রয়েছে টেলিভিশন নাটক। এ দুই মাধ্যমেও তাঁর নাটক আছে ত্রিশের বেশি। তা ছাড়া মঞ্চ-বেতার-টেলিভিশন-চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে রেখেছেন উজ্জ্বল উপস্থিতির স্বাক্ষর। ১০টার মতো চিত্রনাট্য লিখেছেন, নাট্যবিষয়ক বই ও নিবন্ধের সংখ্যাও অনেক। সব মিলিয়ে আপাদমস্তক একজন নাট্যনিমগ্ন মানুষ। নাটকই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-প্রাণ। নাটকের মাধ্যমে নিজেকে মেলে দিতে চেয়েছেন তিনি, নাটকের মাধ্যমে চেয়েছেন মানুষকে জাগাতে, নাটককে অস্ত্র বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ভাবা যায়, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজার হাজার জনতার সামনে তিনি মঞ্চস্থ করছেন স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—এসব নাটক। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিখাদ ও অটুট। তাই সেই উত্তাল দিনে সরকারি চাকুরে মমতাজউদদীন স্বাধীনতার নাটক রচনা ও মঞ্চায়নে রেখেছেন অসম সাহসিকতার পরিচয়।

মমতাজ স্যার বিশ্বাস করতেন বাংলা নাটকের বৃহত্তম ক্ষেত্র বাংলার লোকজীবন ও লোককাহিনির মধ্যে নিহিত। নাটকের মধ্যে তিনি দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন বাংলার জীবন ও জনদপকে, বাংলার লোকায়ত লোকসকলকে—উচ্চারণ করেছেন, দৃঢ়কণ্ঠে, এই কথা: ‘বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় অভিনব কোনো বিশেষ কিছু চাইনি আমি। তবে বাংলাদেশের নাটকে বাংলাদেশকে চেয়েছে আমার মন। আমি হৃদয় খুলে বসে আছি, দীর্ঘ ষাট বছর এমন নাটক দেখব আমি, যেখানে আমার প্রকৃতি, অরণ্য, পশু, মানুষ এবং আমার প্রেম কথা বলে। এমন ক্রন্দন দেখব, যেখানে আমার মায়ের ব্যাকুল দুটি আঁখি সজল হয়ে থাকে।’ এই বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষায় স্থির থেকে মমতাজউদদীন আহমদ লিখে গেছেন একের পর এক নাটক।

তাঁর নাটকে আমরা লক্ষ করি, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা আলোড়ন-বিলোড়ন, মূল্যবোধের সংকট, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি এবং উত্তরণের আহ্বান। শিল্পী মমতাজউদদীন আহমদের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে নিখিল নিরাশার প্রান্তরে বাস করেও তিনি মানুষকে শোনান আশার সংলাপ, তাঁর সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে অনিঃশেষ শান্তিকামী আলোর অপরূপ উৎসব।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজ বাস্তবতাকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে তাঁর নাট্যভুবন। আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, বরং হাস্য-কৌতুকময় বিষয়বস্তুর মাধ্যমে জীবনের কোনো গভীরতর সত্যের সন্ধানই মমতাজউদদীন আহমদের নাট্যসাহিত্যের প্রধান প্রবণতা। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর নাটকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় শিল্পিতা পেয়েছে। এ ধারায় তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বিবাহ, কী চাহ শঙ্খচিল, বকুলপুরের স্বাধীনতা, এই সেই কণ্ঠস্বর ইত্যাদি।

মমতাজউদদীন আহমদ বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্যকে পৌনঃপুনিকভাবে তাঁর নাটকে ব্যবহার করেছেন শিল্প উপাদান হিসেবে। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর সাতঘাটের কানাকড়ি। এ নাটকে শিল্পরূপ পেয়েছে বাঙালির সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চেতনা। শোষকের বিরুদ্ধে সমুত্থিত বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর এক বিশ্বস্ত নাট্যদলিল এই নাটক। মমতাজ স্যারের নাট্যভুবনের বিশাল এলাকাজুড়ে আছে নির্মল ও পরিশীলিত কৌতুক ও হাস্যলাস্য। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, তাঁর হাস্য লাস্য ভাষ্য, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার, প্রেম বিবাহ সুটকেস, দশটি রগড় নাটিকা ইত্যাদি রচনার কথা। কেবল মৌলিক নাটক নয়, রূপান্তরিত নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর। জমিদার দর্পণ, নীল দর্পণ, দুই বোন প্রভৃতি নাটক এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। আবার মমতাজউদদীন আহমদের নাটকে আঙ্গিক নিরীক্ষার স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায় রাজা অনুস্বারের পালা নাট্যে। এই রচনায় মৈয়মনসিংহ গীতিকার রূপকল্প ব্যবহার করে নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে অভিনবত্ব ও আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন নাট্যকার।

বাংলাদেশের নাটক তথা শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্যের ভুবনে এক আলোকিত মানুষ মমতাজউদদীন আহমদ। তাঁর নাটক দর্শক-পাঠককে উদ্ধুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, তাঁর নাটক সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধ হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে, আমাদের শোনায় আশা ও আশ্বাসের বাণী। তাঁকে শ্রদ্ধা।