'ছিন্নপত্র'র নদী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক বজরা ‘পদ্মা’ অবলম্বনে অলংকরণ সব্যসাচী মিস্ত্রী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক বজরা ‘পদ্মা’ অবলম্বনে অলংকরণ সব্যসাচী মিস্ত্রী

গাঙ্গেয় বদ্বীপের বিশাল জনপদে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় দুই হাজার নদ-নদী। নদী যেমন বয়ে চলে আঁকাবাঁকা পথে, মানবজীবনের পথচলাও একই ভঙ্গির। নদীর প্রতিটি বাঁক একেকটি বিচিত্র ইতিহাস। বাংলার প্রতিটি নদীর বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, কান্না-হাসি, দুঃখ-বেদনা। রবীন্দ্রনাথ জীবনবাদী একজন কবি। তিনি তাঁর জীবনকে সামগ্রিকভাবে প্রকৃতির বিচিত্র রূপ, রং, গন্ধের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন গভীরভাবে। সে কারণেই আমরা লক্ষ করি, কবির সাহিত্যকর্মে নদী, পালতোলা নৌকা, নদীর দুই ধারে সবুজ ফসলে ভরা খেত, ছেলেদের মাছ ধরা, মাছরাঙা পাখির হঠাৎ করেই নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়া, সদ্য কাটা আমন ধানে বোঝাই নৌকা, দুরন্ত কিশোরদের নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়া, পল্লিকুলবধূর লজ্জামিশ্রিত হাসি, নদীর ঘাটে স্নানরতা নারী, শিশুর কোলাহল, নৌকার মাঝিদের হাঁকাহাঁকি, বানের পানিতে প্লাবিত বাংলার গ্রামের চিত্র ও নদীতীরবর্তী নিসর্গ।

রবীন্দ্রনাথ পেশাগত জীবন শুরু করেন ১৮৯০ সালে, যখন তিনি প্রথম জমিদারি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পান। শিলাইদহ ছিল তাঁর কর্মস্থল। শিলাইদহের কুঠিবাড়ির দেয়ালটি ঢেউখেলানো। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মার ঢেউয়ের রূপক হিসেবে এটি হয়তো তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় জমিদারি দেখাশোনার কাজে প্রথমে শিলাইদহ, পরে শাহজাদপুর ও সবশেষে পতিসরে যাতায়াত করতে হয়েছে অসংখ্যবার। তাঁর চলার পথের প্রধান বাহন ছিল বজরা। তিনি বলতেন বোট। রবীন্দ্রনাথের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল বাংলার নদ-নদী। জীবনের সঙ্গে নদীর প্রবাহ যেন মানবজীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্যের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতি ও মানবজীবনের মধ্যে যে সাদৃশ্য সেটি সুনিপুণভাবে কবি এঁকেছেন ‘বলাকা’ কাব্যে—

শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও/ উদ্দাম উধাও
ফিরে নাহি চাও,/ যা কিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও।
কুড়ায়ে লওনা কিছু, কর না সঞ্চয়,/ নাই শোক নাই ভয়—
পথের আনন্দ বেগে অবাধে পাথেয় কর ক্ষয়।

রবীন্দ্রনাথের রচনায় ঘুরেফিরেই বাংলার যে নদ-নদীগুলোর উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলো হলো—গঙ্গা, পদ্মা, বড়াল, নাগর, আত্রাই, গড়াই, ইছামতী, যমুনা, গোহালা।

কবির বিশাল সাহিত্যকর্মের মধ্যে নদীবিষয়ক কবিতা, সংগীত, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদির সংখ্যা এতটাই বিস্তৃত যে স্বল্প পরিসরে সেগুলোর বর্ণনা মোটেই সম্ভব নয়। বর্তমান পরিসরে কবির ‘ছিন্নপত্র’ থেকে বিভিন্ন সময়ে লেখা তিনটি পত্রের বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরা হলো, যেখানে নদী, নদীতীরবর্তী জনপদ, নিসর্গ ইত্যাদির প্রাণবন্ত বর্ণনা রয়েছে।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে কবি নওগাঁর পতিসর থেকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই পত্রে করতোয়ার অন্যতম প্রধান শাখা নাগর নদের বর্ণনা রয়েছে। ‘ছোট নদীটি ঈষৎ বেঁকে এইখানে একটুখানি কোণের মতো, একটু কোলের মতো তৈরি করেছে—নৌকা ওয়ালারা উত্তর দিক থেকে গুণ টেনে টেনে আসে, হঠাৎ একটা বাঁক ফিরেই এই জনহীন মাঠের ধারে অকারণে একটা মস্ত বোট বাঁধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। লজ্জাশীলা বধূ দুই আঙ্গুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসী কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে, তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে একটি সদ্যঃস্নাত তৈল চিক্কণ বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্তমান পত্র লেখক সম্বন্ধে কৌতূহল নিবৃত্তি করছে—তীরে কতকগুলো নৌকো বাঁধা এবং একটা পরিত্যক্ত প্রাচীন জেলে ডিঙি অর্ধ নিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষা করছে। তার পরে আবার অনেকটা দূর শস্য শূন্য মাঠ মাঝে মাঝে কেবল দুই একজন রাখাল শিশুকে দেখতে পাওয়া যায় এবং দুটো একটা গোরু নদীর ঢালু তটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এসে সরস তৃণ অন্বেষণ করছে দেখা যায়। এখানকার দুপুর বেলার মতো এমন নির্জনতা নিস্তব্ধতা আর কোথাও নেই।’

নাগর নদের তীরবর্তী নিসর্গের এমন জীবন্ত বর্ণনা আর কখনো কোনো শক্তিশালী লেখকের কল্পনায় উঠে আসবে কি না জানি না। কারণ, চিরবহতা নাগর এখন মৃত।

কবি নওগাঁর কালিগ্রাম ত্যাগ করে শাহজাদপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন তাঁর প্রিয় বজরায় চেপে। নাগর নদ পেরিয়ে স্রোতস্বিনী গুড় নদের বুক চিরে বজরাটি একসময়ে বিশাল চলনবিলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। এভাবে বজরা একসময় শাহজাদপুরের কাছাকাছি চলে আসে। কবি সেখান থেকেই ১৮৯১ সালে একটি পত্র লিখে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন—

কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। রবীন্দ্রনাথ এখানে আসতেন বজরায় চড়ে। ছবি: তৌহিদী হাসান
কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। রবীন্দ্রনাথ এখানে আসতেন বজরায় চড়ে। ছবি: তৌহিদী হাসান

‘এখনো পথে আছি। ভোর থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা সাত-আটটা পর্যন্ত ক্রমাগতই ভেসে চলেছি। কেবলমাত্র গতির কেমন একটা আকর্ষণ আছে—দুধারের তটভূমি অবিশ্রাম চোখের উপর দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে, সমস্ত দিন তাই চেয়ে আছি। আমাদের কালিগ্রামের সেই মুমূর্ষুর নাড়ির মতো অতিক্ষীণ স্রোত নদী কাল কোন কালে ছাড়িয়ে এসেছি। সেই নদী থেকে ক্রমে একটা স্রোতস্বিনী নদীতে এসে পড়া গেল। সেটা বেয়ে ক্রমে এমন এক জায়গায় এসে পড়লুম যেখানে ডাঙায় জলে একাকার হয়ে গেছে। তীর এবং জল মাথায় মাথায় সমান একটুও পাড় নেই। অসীম জল রাশির মধ্যে যখন স্থল সবে একটুখানি মাথা তুলেছে জলস্থলের অধিকার নির্দিষ্ট হয়ে যায়নি। চারিদিকে জেলেদের বাঁশ পোতা—জেলেদের জাল থেকে মাছ ছো মেরে নেবার জন্য চিল উড়ছে, পাঁকের উপরে নিরীহ বক দাঁড়িয়ে আছে। নানা রকমের জলচর পাখি জলে শেওলা ভাসছে, মাঝে মাঝে পাঁকের মধ্যে অযত্নসম্ভূত-ধানের গাছ। ভোরের বেলা বোট ছেড়ে দিয়ে কাঁচিকাঠায় গিয়ে পড়া গেল।’

এই নৌবন্দর গুমানী নদীর তীরে। নাম কাছিকাটা। গুমানী নদী চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সবচেয়ে গভীর ও বড় নদী। আত্রাই, গুড়নই বা গুড় নদী, নন্দকূব্জা, বারণই, গদাই, নাগর, বানগঙ্গা প্রভৃতি চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর সম্মিলিত একক প্রবাহ হলো গুমানী। কাছিকাটা নদীবন্দরে এসে কবির বজরাটি শাহজাদপুরের উদ্দেশে সহজে এবং দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য একটি সরু খালের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আরেকটি ছোট নদীতে প্রবেশ করেছে। কবি এই নদীর নাম উল্লেখ করেননি। তবে তাঁর বর্ণনায় নদীটির নাম গোহালা বলে চিহ্নিত করলে ভুল হবে না।

আবার ফিরে যাই কবির বর্ণনায়, ‘ক্রমে খোলা নদীতে এসে পড়লুম। শীতকালে মেঘাচ্ছন্ন ভিজে দিন ভারী বিশ্রী লাগে। সকালবেলাটা তাই নিতান্ত নির্জীবের মতো ছিলুম। বেলা দুটোর সময় রোদ উঠল। তারপর থেকে চমৎকার। খুব উঁচু পাড়ে বরাবর দুই ধারে গাছপালা লোকালয় এমন শান্তিময়, এমন সুন্দর, এমন নিভৃত—দুই ধারে স্নেহ সৌন্দর্য বিতরণ করে নদীটি বেঁকে বেঁকে চলে গেছে—আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরচারিণী নদী। কেবল স্নেহ এবং কোমলতা এবং মাধুর্যে পরিপূর্ণ। চাঞ্চল্য নেই, অথচ অবসরও নেই। গ্রামের যে মেয়েরা ঘাটে জল নিতে আসে এবং জলের ধারে বসে বসে অতি যত্নে গামছা দিয়ে আপনার শরীর খানি মেজে তুলতে চায় তাদের সঙ্গে এর যেন প্রতিদিন মনের কথা এবং ঘরকন্নার গল্প চলে।’

রবীন্দ্রনাথকে একাধারে শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে আসতে হয়েছে। কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে কুষ্টিয়া শহর। সেখানে নিজ বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরের দিন নৌকাযোগে গড়াই নদ হয়ে পদ্মা। এবং শিলাইদহ। গড়াই নদের ওপর রেলসেতু হওয়ার পর নন্দলালপুর স্টেশনে নেমে পালকিযোগে শিলাইদহ আসতেন কবি। শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুরে যেতে হতো বজরায়। পদ্মা পাড়ি দিয়ে ইছামতী, বড়াল ও গোহালা হয়ে শাহজাদপুর। পদ্মা কবির সবচেয়ে চেনা এবং অতি নিকটতম নদী। ‘সোনার তরী’ কাব্য রচনার নেপথ্যে পদ্মার ভূমিকা অপরিসীম।

১৮৯২ সালের ২১ জুন কবি পদ্মার প্রবাহপথ ধরে গোয়ালন্দের পথে অগ্রসর হচ্ছেন। সেদিন চলন্ত বোটে বসে কবি এই পত্র লিখেছেন। শোনা যাক তাঁর সেদিনের অনুভূতি— ‘আজ সমস্ত দিন নদীর উপরে ভেসে চলেছি। আশ্চর্য এই বোধ হচ্ছে যে, কত বার এই রাস্তা দিয়ে গেছি, এই বোটে চড়ে জলে জলে বেড়িয়েছি এবং নদীর দুই তীরের মাঝখান দিয়ে ভেসে যাবার যে একটা বিশেষ আনন্দ আছে সে করেছি, কিন্তু দিন দুই ডাঙায় বসে থাকলে সেটা ঠিকটা আর মনে থাকে না। এই যে একলাটি চুপ করে বসে চেয়ে থাকা দুই ধারে গ্রাম ঘাট শস্যক্ষেত্র চর, বিচিত্র ছবি, দেখা দিচ্ছে এবং চলে যাচ্ছে, নৌকো চলেছে, জেলেরা মাছ ধরছে, অহর্নিশি জলের এক প্রকার আদর পরিপূর্ণ তরল শব্দ শোনা যাচ্ছে, সন্ধেবেলায় বিস্তৃত জলরাশি শ্রান্ত নিদ্রিত শিশুর মতো একেবারে স্থির হয়ে যাচ্ছে।’

কবির জীবদ্দশায় তাঁর লেখা ১৫১টি চিঠি সংকলিত করে ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘ছিন্নপত্র’ নামে। ‘ছিন্নপত্র’র অধিকাংশ চিঠিতেই রয়েছে পূর্ব বাংলা, বিশেষ করে বাংলার উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর বিষদ বর্ণনা। বাংলার প্রায় সব কবি–সাহিত্যিকের রচনায় নদী–সংশ্লিষ্টতা লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনায় নদীর অবস্থান আরও বেশি বিস্তৃত, নদী সেখানে বিশিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত।

লেখক: নদী ও স্থানীয় ইতিহাসবিষয়ক গবেষক